একটি হরিণ আজ হয়েছে নিখোঁজ
একটি যুবতী আজ হয়েছে বিধবা
ডোরাকাটা বাঘ তুমি পদত্যাগ করো।
একটি মায়ের বুক হয়েছে ব্যাকুল,
কিশোর ফেরেনি ঘরে, জ্বলেনি সন্ধ্যার বাতি আজ;
নেকড়ে তোমার
পদত্যাগ চাই।
একটি শহর আজ কালকূটে নীল,
বিষধর সাপ তোর পদত্যাগ চাই।
১৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৩
(অপ্রকাশিত/অগ্রন্থিত কবিতা)
==========================
('পদত্যাগ’ কবিতিকার প্রেক্ষাপট সম্পর্কে বলতে হবে, এটি লেখার আগের দিন ঢাকায় ছাত্র-পুলিশ সংঘর্ষ ও সান্ধ্য আইন জারি হয়। বন্ধ ঘোষণা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। পরদিন ১৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকা-চট্টগ্রামের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে সান্ধ্য আইনের কড়াকড়ি করা হয়। কবিতিকাটি পড়ে বোঝা যায়, স্বৈরাচারী এরশাদের রাষ্ট্রপতি পদ থেকে পদত্যাগের দাবিই এটি লেখার মূল অনুপ্রেরণা। কবিতাটিতে সমকালীন বানানরীতি অনুসৃত হয়েছে।
১৪ই ফেব্রুয়ারি ভ্যালেন্টাইন'স ডে হিসাবে সারা বিশ্বে পরিচিত হলেও, বাংলাদেশের ইতিহাসে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ ১৯৮৩ সালের ১৪ই ফেব্রুয়ারি। অনেকে এই দিনটিকে পালন করেন 'স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস' হিসাবে।
এই দিনেই সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে শুরু হয় ছাত্র আন্দোলন, কালক্রমে যেটি গণআন্দোলনে রূপ নিয়েছিল।
তখন জেনারেল এরশাদের সামরিক সরকারের বিতর্কিত শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীরা প্রতিরোধ গড়ে তোলে।
তখনকার শিক্ষামন্ত্রী ড. মজিদ খান ১৯৮২ সালের ২৩শে সেপ্টেম্বর একটি নতুন শিক্ষানীতির প্রস্তাব করেন। সেখানে প্রথম শ্রেণী থেকেই আরবি ও দ্বিতীয় শ্রেণী থেকে ইংরেজি শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা হয়। উচ্চশিক্ষা অর্জনের জন্য মাপকাঠি করা হয় মেধা অথবা পঞ্চাশ শতাংশ ব্যয়ভার বহনের ক্ষমতা।
এই নীতি ঘোষণার পর থেকেই আন্দোলন শুরু করে শিক্ষার্থীরা। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৮৩ সালের ১৪ই ফেব্রুয়ারিতে স্মারকলিপি দিতে শিক্ষার্থীরা মিছিল করে সচিবালয়ের দিকে যাবার সময় পুলিশ গুলি চালায়। এতে জয়নাল ও দীপালি সাহা সহ নিহত হন অন্তত ১০জন।
১৪ ফেব্রুয়ারি সকালে মজিদ খানের শিক্ষানীতি প্রত্যাহার, বন্দীদের মুক্তি, গণমুখী, বিজ্ঞানভিত্তিক ও অসাম্প্রদায়িক শিক্ষানীতির দাবিতে আয়োজিত কর্মসূচিতে হাজার হাজার শিক্ষার্থী শান্তিপূর্ণ মিছিল নিয়ে সচিবালয়ের দিকে এগিয়ে যান। মিছিলটি হাইকোর্ট এলাকায় গিয়ে ব্যারিকেডের কারণে থেমে যায়।
সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতারা যখন তারের উপর দাঁড়িয়ে বক্তব্য শুরু করেন, তখন পুলিশ গরম পানি ছিটাতে শুরু করে। লাঠিচার্জ ও টিয়ার শেল নিক্ষেপও শুরু করে পুলিশ। ছাত্ররা এ সময় ইট-পাটকেল ছুড়লে পুলিশ নির্বিচারে গুলি চালায়। গোটা এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। এ সময় পুলিশের গুলিতে গুলিবিদ্ধ হন জয়নাল নামের এক শিক্ষার্থী। গুলিবিদ্ধ অবস্থায় তাকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মারতে থাকে পুলিশ। এক পর্যায়ে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
গুলির সময় প্রাণ বাঁচাতে ছাত্ররা আশ্রয় নেন পাশের শিশু একাডেমিতে। সেখানে চলছিল শিশুদের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। কিন্তু তাতেও পুলিশ থামেনি। পুলিশের গুলিতে এ সময় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশ নিতে আসা শিশু দীপালি গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায়। অন্য শিশু ও অভিভাবকদের ওপরও পুলিশ লাঠিচার্জ চালায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আহতদের চিকিৎসার জন্য অ্যাম্বুলেন্স পাঠাতে চাইলেও পুলিশ ঢুকতে দেয়নি। এর মধ্যে ছাত্রদের লাশ গুম করে ফেলে পুলিশ।
এদিকে জয়নালের মৃত্যুর খবর পাওয়ার পর ফুঁসে উঠেন ছাত্ররা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার্থী জয়নালকে শেষ বিদায় জানাতে ছাত্র-শিক্ষক, জনতার ঢল নামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায়। জানাজায় অংশ নিতে আসা শিক্ষার্থীদের উপর ফের হামলা চালানো শুরু করে পুলিশ ও বিডিআরের যৌথ বাহিনী। অপরাজেয় বাংলার পাদদেশের সমাবেশ থেকে গণহারে শিক্ষার্থীদের গ্রেপ্তার করতে শুরু করে তারা। শিক্ষার্থীরা প্রতিরোধ করতে গেলে লাঠিচার্জ শুরু করে যৌথবাহিনী।
আক্রমণ থেকে রেহাই পেতে এক পর্যায়ে শিক্ষার্থীরা কলাভবন ও উপাচার্যের কার্যালয়ে ঢুকলে তাদের টেনে বের করে পিটিয়ে ট্রাকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। জয়নালের লাশের সন্ধানে পুলিশ নির্বিচারে লাঠিচার্জ করেছিল চারুকলা অনুষদের শিক্ষার্থীদের ওপর। কেবল সরকারি হিসেব মতেই এদিন ১ হাজার ৩৩১ জন ছাত্রকে গ্রেপ্তার করা হয়।
পরদিন ১৫ ফেব্রুয়ারি জগন্নাথ কলেজের সামনে পুলিশ নির্বিচারে গুলি চালিয়ে হত্যা করে ২ তরুণকে। তেজগাঁওয়ের ঢাকা পলিটেকনিক ইন্সটিটিউটের ২ ছাত্রকে ছাদ থেকে ফেলে হত্যা করা হয়। সদরঘাটে এক শিশুকে বেয়নেট দিয়ে হত্যা করা হয়। এই আন্দোলনের ছোঁয়া লেগেছিল চট্টগ্রামেও। সেখানে পুলিশের গুলিতে শহীদ হয়েছিলেন কাঞ্চন নামের একজন।
এসবের প্রতিবাদে ১৫ ফেব্রুয়ারি ছাত্ররা রাস্তায় নেমে আসেন। ঢাকার নানা এলাকায় পুলিশের সেঙ্গে চলে দিনভর তুমুল সংঘর্ষ। চট্টগ্রামে শহীদ হন মোজাম্মেল নামের এক ছাত্র। এক পর্যায়ে ঢাকা ও চট্টগ্রামের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ২৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বন্ধ ঘোষণা করা হয়।
১৪ এবং ১৫ ফেব্রুয়ারি মোট কতজন শহীদ হয়েছিলেন, তা আজও অজানা। তবে জাফর, জয়নাল, দীপালী, আইয়ুব, ফারুক, কাঞ্চনসহ বেশ কয়েকজনের নাম জানা যায়। এদিন সব লাশই গুম করেছিল এরশাদের পেটোয়া বাহিনী।
ব্যাপক আন্দোলনের মুখে ১৭ ফেব্রুয়ারি সামরিক প্রশাসক হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদ বলেন, 'জনগণের রায় ছাড়া শিক্ষা সম্পর্কে কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে না।' এক প্রেস নোটে বলা হয়, আটক ১ হাজার ২২১ জনকে মুক্তি দেয়া হয়েছে। পরে ১৮ ফেব্রুয়ারি শিক্ষানীতি স্থগিত করে এরশাদ সরকার।
উল্লেখ, শামসুর রাহমান ১৯৮৭ সালে এরশাদের স্বৈরশাসনের প্রতিবাদে দৈনিক বাংলার প্রধান সম্পাদকের পদ থেকে পদত্যাগ করেন। ১৯৮৭ থেকে পরবর্তী চার বছরের তিনি প্রথম বছরে ‘শৃঙ্খল মুক্তির কবিতা’, দ্বিতীয় বছরে ‘স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে কবিতা’, তৃতীয় বছরে ‘সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে কবিতা’ এবং চতুর্থ বছরে ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে কবিতা’ লেখেন। ১৯৯১ সালে এরশাদের পতনের পর লেখেন ‘গণতন্ত্রের পক্ষে কবিতা।’ তথ্যঋণ : বিবিসি বাংলা, প্রথম আলো, দ্যা ডেইলি স্টার।