যদি বদলে দেয়া যেতো নিছক এই ছকবাঁধা জীবন। প্রাতঃকৃত্য, খবরের
কাগজ শুঁকে শুঁকে কিছুসময় কাটানো, রুটি-তরকারি, ধোঁয়া-ওগরানো চা,
স্বল্পকালীন দরকারি গার্হস্থ্য কথাবার্তা, অফিসে দৌড়ানো, কাজ-অকাজ,
আড্ডা, নোংরা টয়লেটে আরশোলা পায়ে-মাড়ানো, মলমূত্রত্যাগ, কায়ক্লেশে
ঘরে ফেরা, নৈশ আহার, বেঁচে-থাকা না-থাকার ভাবনা, এই পৃথিবীতে কে
কাহার, নিদ্রা, যেন উন্মাদের লাগাতার কাগজ ছেঁড়া, মৈথুন, নিদ্রা, ভোরে
সদ্যচরের মতো জাগরণ-দুঃসহ এই পুনরাবৃত্তি। মরিয়া জুয়াড়িবৎ সর্বস্ব পণ
রেখে এক দানে জীবনকে পাল্টে ফেলার সাধ ময়ূরের পেখম। এমন কি পারে
না হতে আর নই গৃহী, নির্দিষ্ট কোথাও বারবার আওয়া নেই, নেই ফিরে আসা?
উপেক্ষিত নিসর্গের সঙ্গে আলাপ, শ্যামলিম উপত্যকায় শুয়ে-শুয়ে শ্লথগতি
মেঘের শোভা নিরীক্ষণ, অনূঢ়া, স্বাস্থ্যবতী, কামার্তা গয়লানীর সঙ্গে শয়ন
সুস্নিগ্ধ ঝোপের আড়ালে কিছুক্ষণ, ঘাগরা ওল্টানো, শ্বাসরোধকারী চুম্বন,
ক্ষমাহীন আলিঙ্গন, মিলন, পুনর্মিলন; অনন্তর পাহাড়-বেয়ে-ওঠা, অশ্লীল,
আক্রমণপরায়ণ মানবপিণ্ড থেকে দূরে ভ্রমণ, পাহাড়ি প্রাণীর বিধানবিরোধী
সহযাত্রী; নির্ধারিত বৃত্তিহীন ফলমূল ভক্ষণে ক্ষুধার নিবৃত্তি,-এসব কিছুই কি
সম্ভাব্যতার পরপারে? জীবনকে আত্মদ্রোহে স্থাপন করতে প্রবল ইচ্ছুক আমি
প্রথাছুট, বৈচিত্র্যময় চলমানতায়।


জগৎ-সংসারে কে আছে এমন যার শ্রুতি বিমোহিত নয় ঘন সবুজ পত্রালি
থেকে কিচ্ছুরিত সূর্যরশ্মির মতো কোকিলের সুর, ঝর্ণাজল আর নুড়ির মোহন
সংঘর্ষে উৎপন্ন মৃদু কলম্বর আর জ্যোৎস্নাপ্লাবিত রাত্রির হৃদয় থেকে উৎসারিত
বংশীধ্বনিতে? এমন কারও সন্ধান কি পাব যে আবদুল করিম খাঁর যমুনা
তীরের স্বর্গীয়, চিরব্যাকুল ছলাৎছল, রবিশঙ্করের সেতারের নির্ঝর, য়ুহিদি
মেনহুইনের বেহালা-নিঃসৃত সুরধারায় অবগাহনে অনিচ্ছুক? বন্দনীয় এইসব
সুর থেকেও, হে মেয়ে অনেক মধুর তোমার প্রেমার্দ্রে কণ্ঠস্বর, যা আমার
ভেতরের চাপা আগুনকে উসকিয়ে কখনও দীপান্বিত শবে বরাত, কখনও বা
আবীর-ছাড়ানো বসন্তোৎসব।


সারা দিনমান ইট ভাঙার শব্দ, ঘাম-ঝরানো খাটুনি। আমার মুহূর্তগুলো
ভারী হাতুড়ির অবিরাম পিটুনিতে বিচূর্ণিত। হে মধ্যরাত্রির শান-বাঁধানো
ফুটপাথ, হে নিঃসঙ্গতার কালো সাঁড়াশি, মাঝ মেঘনার লাফিয়ে-ওঠা ডাগর,
রূপসী মাছ, নিষ্পাপ চুম্বনের স্মৃতি, অবসরের আঙুলে ঘূর্ণ্যমান আংটি, পুরানো,
শূন্য বাড়ির অভ্যন্তরীণ প্রতিধ্বনি, দিগন্তের শব্দহীন, ধূসর চিৎকার, দু’জনের
কল্পিত পলায়ন, সংসারবিহীন সংসার, খরার পরে বৃষ্টির তুমুল কত্থক,
নেশাতুর নানা প্রহরের সাইকেডেলিক চিত্রমালা, আঙুলের ডগার কাঠিন্য,
কুকুর কুকুরীর বেআব্রু প্রণয়, হে গা-গুলোনো, নিঃশ্বাস অপহরণকারী গার্হস্থ্য,
হে অন্তর্গত লতাগুল্মঢাকা সন্ন্যাস-তোমাদের কাছ থেকে বহুকাল কর্জ নিয়েছি
বিরল সম্পদ। ধারদেনা চুকিয়ে দেয়ার সাধ অনেক দিনের, অথচ নিষ্ফল শ্রম
আর খঞ্জ প্রেরণায় সতত আমি অধমর্ণ।


তুমি কি জান যখন দুষ্ট বালক আগুন ধরিয়ে দেয় নীড়ে, ছিন্নপালক,
শাবকহারা পাখির তখনকার অভিব্যক্তি? হতে কি পার নৌকো ডোবার মুহূর্তে
যাত্রীর অনুভূতির অংশীদার? জিভ বার করে দেয়া দেয়ালের আর্তনাদের সঙ্গে
তুমি পরিচিত, একথা ধরে নিয়ে বলি, উদ্যানের ফুল, ঝুঁকে-থাকা আকাশ,
আমার সংশয়াকুল মনে বইয়ে দেয় না সুবাতাস। অপরাহ্নের ক্রোড়ে সমর্পিত
ঘাসঘেরা করোটির ওপর প্রজাপতি আর ফড়িং-এর ওড়াউড়ি, প্রায়শ নির্ঘুম
রাতে, হে প্রধান সুন্দরী, তোমার বাসার দিকে ফেরানো আমার মুখ, সম্মোহিত,
তন্নিষ্ঠ, তুমি কি জান?


কী হতো আমার, যদি তুমি না থাকতে? আয়ত তোমার চোখ, সেই জন্যেই
সপ্তর্ষিমণ্ডল, পর্যটক মেঘ, উদ্ভিন্ন গোলাপ। সোনালি তোমার বাহু, সেই জন্যেই
এই আলিঙ্গন, শূন্যতার খুনসুটি, হাওয়ার মাতলামি। স্ফুরিত তোমার ঠোঁট,
সেই জন্যেই তৃষাতুর কথা, অন্ধকারকে দীপান্বিতা-করা হাসি, মদির আগুন
ধরানো চুম্বন, বুজে আসা আমার চক্ষুদ্বয়। নিখুঁত তোমার গলা, সেই জন্যে
কাঁধ-বেয়ে-নেমে আসা চুলের জড়িয়ে ধরা, আমার নিঃসঙ্গতা আর
অনুপস্থিতিকে চুমুক-খাওয়া কণ্ঠস্বর, পথ-হাঁটার ওপর ছড়িয়ে পড়া গান। কী
হতো আমার, যদি তুমি না থাকতে চিররৌদ্র, চিররাত্রিময় এই শহরে? কী
করব আমি, যদি অনিবার্য হয়ে ওঠে দিগন্তে মিলিয়ে-যাওয়া পক্ষধ্বনির মতো
বিচ্ছেদ? সত্যি-সত্যি কুরে-কুরে-খাওয়া বিরহ কি ডিম পাড়বে আমার
অস্তিত্বের অতল গহ্বরে? চাবিফোকর দিয়ে বিশ্বদর্শন সম্ভবপর কিনা, এ নিয়ে
নিজের সঙ্গে বোঝাপড়া করা গ্যাছে মাঝে মাঝে নানা কাজের ফাঁকে। কাটা
মুণ্ডু ভাসমান, বড় রকমের বিস্ফোরণে আসমান ভেঙে পড়বার উপক্রম।
কোথায় লুকিয়ে বাঁচবে, সে-পথ খুঁজতে খুঁজতে সবাই বেসামাল। আমার
চোখে শুধু চাবিফোকর আর তোমার বিপন্ন মুখ। একটি প্রশ্ন ঐন্দ্রজালিকের
মতো আমার নাক বরাবর ছুঁড়ে মারছে মুঠো মুঠো ঝিলিক-দেয়া তারা-কি
হতো আমার, যদি তুমি না থাকতে? টোপর-পরা বিদ্রূপ ব্যালকনিতে বসে পা
দোলায় ঘন ঘন; ধপাস শব্দে চমকিত দেখি নিজেকে মেঝেতে, চোখ দুটো
উল্টে যাচ্ছে, জানলাভেদী সেবিকা জ্যোৎস্না চোখের পাতায় আঙ্গুল বুলোয়!
আমার সঙ্গে কেউ কি ধুলোয় খেলতে আসবে আবার ঘোর অনিচ্ছাসত্ত্বেও
কামড়ে-ধরা কোনও খেলা?


আর কড়া নেড়ে-নেড়ে ক্লান্তির ভারে-নুয়ে-পড়া নয়। এবার দড়াম ঢুকে পড়বো
দস্যুতার শিখায় প্রজ্বলিত। মনঃপূত নয় এই আচরণ, কিন্তু কি করা? নিষিদ্ধ ফল
ভক্ষণের পরে হতচকিত আদমের মতো পাতাময় ত্রিডাল নেব না ভিক্ষা;
জ্যোতির্ময় উন্মাদনা আমাকে উদোম করেছে। চার দেয়াল ডালকুত্তা, ধুলোমাখা
নিভন্ত বাল্বগুলো ড্যাবড্যাবে চোখে তাকিয়ে থাকে, সোফা অতিকায় হাড়গিলা,
ভয়-ধরানো। হাওয়া ভূতুড়ে, শক্ত লতার মতো জাপটে ধরে, মটমটিয়ে ওঠে
হাড়গোড়, মাংস-মজ্জা খসে খসে পড়তে চায়। রামধনু পোশাক ছুঁড়ে দাও, ফিরে
যাই। আমার হৃদয় আঁচড়াচ্ছে বাজপাখি, সী মোরগের সৌজন্যে এখানে আসা না-
আসা। আমাদের দু’জনের মেঘমেদুর সম্পর্ক এখন ঘাতকের মারণাস্ত্রের ছায়া।
ফ্যালফ্যাল তাকিয়ে আছে বুনো জানোয়ারের জ্বলন্ত টিকাবৎ চোখের দিকে।


সুকৌশলে ছাঁটা অনেকখানি, সৈনিকের কদম-ছাঁট চুল যেন। হাওয়ায়
পালকের কুচি, নীলিমার দিকে লোলুপ দৃষ্টি দেয়া মুনাসিব; ওড়া বারণ। স্পষ্ট
কোনও কারণ ওরা বলবে না সহজবোধ্য ভাষায়। ধারণা, হয়ত অমূলক নয়,
অনেক ওপরে, আকাশের জাজিমে আয়েশে গড়ানো অশোভন অভাজনের পক্ষে।
সেখানে সুনীল কক্ষের ফরাসে মখমলী তাকিয়ায় ঠেস্‌ দিয়ে যারা ফরাসি টানে
ফুড়ুক ফুড়ুক, দ্যাখে বাইজীর নাচ ঢুলুঢুলু লালচে চোখে লকলকে লালচে, তারা
শুধু বশংবদ তোতা পাখি পুষে তৃপ্তির ফোয়ারায় গা ভেজায়। সেখানে ঈগল পায়
না আমন্ত্রণলিপি। ওকে তপ্ত কড়াইতে ভেজে ভেজে অভ্যক্ষ কাবাব বানানো ছুঁড়ে
দেবে নোংরা বুদ্বদময় নর্দমায়। কী আশ্চর্য, সবাই দেখতে পায়, ভস্মরাশি থেকে
উত্থিত বিহঙ্গের অবাধ, বর্ণাঢ্য ওড়া মেঘের স্তরে স্তরে। অগ্নিগোলক নির্বাপিত
ওর ডানার ঝাপ্‌টায়, চূড়ান্ত নীলিমাকে সে ছোঁবেই। ওড়ো, হাওয়া কেটে-কেটে,
সূর্যের সোনালি চুলের ভেতর দিয়ে তার অনিঃশেষ ওড়া।

   (মেঘলোকে মনোজ নিবাস কাব্যগ্রন্থ)