এখন আমার আশে-পাশে কেউ নেই। ঘর অন্ধকার নয়, একটা
বাতি জ্বলছে। অনুগ্র আলো যেন জাল; আমি স্বেচ্ছা-
বন্দি হয়ে আছি সেই জালে। কেউ নেই আমার পাশে, মুখোমুখি
দাঁড়িয়ে নেই কাউ। কেউ আমার সঙ্গে কথা বলছে না এই
মুহূর্তে। মুহূর্তেগুলো থেমে আসা বৃষ্টির ফোঁটার মতো ঝরছে
আমার ওপর। সময় বয়ে চলেছে একটানা, আমার আয়ুর পুঁজি
ক্ষইয়ে দিয়ে। এখন কোনো বইয়ের পাতায় চোখ বুলোতে
পর্যন্ত ইচ্ছে করছে না, অথচ বইয়ের প্রতি আমার আকর্ষণ
অত্যন্ত তীব্র। প্রহরে-প্রহরে বই থেকে আমি শোষণ করে নিই
আনন্দ, সমৃদ্ধ হয়ে উঠি দিনের পর দিন।
এখন আমার আশে-পাশে কাউকে দেখতে পাচ্ছি না এখন যদি
খাতা খুলে লিখতে শুরু করি, কেউ ঢুকে পড়বে না আমার
ঘরে, কিংবা আমার পেছনে দাঁড়িয়ে ঝুঁকে দেখবে না কি আমি
লিখছি। কোনো উঁকি ঝুঁকি মারবে না কেউ। চারপাশে এখন
নিভাঁজ নিঃসঙ্গতা। আমার একাকীত্ব জলচর প্রাণীর মতো
আলো পোহাচ্ছে। একটু আগে আমার বিচ্ছেদ ঘটেছে
স্বপ্নের সঙ্গে, হয়তো এজন্যেই একটা শূন্যতাবোধ
আপাতত দখল করে নিয়েছে আমাকে। স্বপ্ন ভেঙে গেলে
খুব একলা লাগে। কী স্বপ্ন দেখছিলাম আমি? ঘুম
যখন শরীরকে ত্যাগ করে যায়, তখন কোনো কোনো স্বপ্নের
কথা খুব স্পষ্ট মনে থাকে, যেন চোখ বন্ধ করলেই সেই
স্বপ্ন আবার দেখতে পাবো। এমন কিছু স্বপ্ন দেখি যা
স্বপ্নের মতোই মিলিয়ে যায় অন্তহীন অস্পষ্টতায়।
আমি স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসি। যারা স্বপ্নকে অর্থহীন
বলে উড়িয়ে দেয়, আমি তাদের কেউ নই। আমি স্বপ্নকে
অর্থময় মনে করি। স্বপ্ন বিশ্লেষণে অপটু বলেই সকল
স্বপ্ন আমাদের কাছে অর্থহীন। কী স্বপ্ন দেখছিলাম
আমি? সব কিছু মনে নেই, আবছা হয়ে গেছে অনেক
কিছুই। বহু পথ হেঁটে আমি প্রবেশ করেছি একটা
পুরনো নিঝুম বাড়িতে। ঠিক প্রবেশ করেছি, বলা
যাবে না, বাড়িটার বন্ধ দরজায় কড়া নাড়ছি, অনেকক্ষণ
থেকে; কিন্তু ভেতর থেকে কোনো সাড়া-শব্দ আসছে না।
তবে কি কোনো বাসিন্দা নেই এই নিঝুম বাড়িতে?
দরজা খুললো না দেখে সেখান থেকে অন্য দিকে রওয়ানা
হলাম। তারপর নিজেকে দেখতে পেলাম জনশূন্য,
ধুধু প্রান্তরে। জমি ফেটে চৌচির। কোথাও এক ডগা ঘাস
নেই, এক ফোঁটা পানি নেই। শুধু ঝিঁঝি পোকার
ডাকের মতো একটা শব্দ উঠে আসছে মাটি থেকে। হঠাৎ
যেন মাটি ফুঁড়ে বেরুলো একটা কালো মানুষ। মানুষ
না বলে কংকাল বলাই ভালো। লোকটা মাটির ওপর
বসে পড়লো এবং কোত্থেকে যেন একটা শিশু এসে বসলো ওর
কোল জুড়ে। হাড়-জিরজিরে শিশুটির দু’চোখে জীবনের
দ্রুত পলায়নের দৃশ্য। সেই লোকটা আর শিশুটিকে
দেখে মনে হলো যেন মৃত্যু শুয়ে আছে মৃত্যুর কোলে।
আর কী কী দেখেছিলাম। মনে পড়ছে না।
কিছুতেই মনে পড়ছে না।
স্বপ্নটির কী অর্থ দাঁড়ায় আমি জানি না। স্বপ্ন বিশ্লেষণের
ক্ষমতা থেকে আমি বঞ্চিত। এই স্বপ্ন কেন দেখলাম?
অনেকদিন থেকে একটা বাড়ি খুঁজছি বলেই কি সেই
পুরনো, নিঝুম বাড়িটা দেখা দিলো আমার স্বপ্নে, যে বাড়ি
আমি আগে কখনও দেখিনি? সংবাদপত্রে দেখা
ইথিওপিয়ার অনাহারী মানুষের ফটোগ্রাফই আবার আমার
স্বপ্নে হানা দিলো নতুন করে? এ প্রশ্নের উত্তর আমার
জানা নেই। জোর দিয়ে কিছুই বলতে পারব না। এই
স্বপ্নের অন্তরালে অন্য কোনো গূঢ়ার্থ কি নিহিত?
এই স্বপ্ন আমাকে একলা করে দিয়েছে। এখন আমার আশে-
পাশে কেউ নেই। স্বপ্ন দেখতে আমার ভালো লাগে।
ঘুমের মরুভূমিতে স্বপ্ন তো মরূদ্যান। হারিয়ে-যাওয়া কিছু
চিত্রের খোঁজে স্বপ্ন দ্যাখে আমার কণ্ঠনালী, নাভিমূল,
বাহু, নখ, মাথার চুল। কখনও-কখনও স্বপ্ন আর বাস্তবের
মধ্যে আমি কোনো ভেদচিহ্ন খুঁজে পাই না। কুলুঙ্গিতে
তুলে রাখা কবেকার সবুজাভ দোয়াত ফেরেশতা হয়ে
আমার সঙ্গে কথা বলে যখন, তখন বুঝতে পারি না আমি স্বপ্নের
আচ্ছন্নতায় মজে আছি নাকি বাস্তবের চবুতরায় দাঁড়িয়ে
কবুতর ওড়াচ্ছি একের পর এক।
এখন আমার মাথার ভেতর সুকণ্ঠ কোনো পাখির মতো গান
গাইছে এই শহর। লোকগীতির এই শহর, ডিসকো
নাচের শহর, দোয়া-দরুদ আর মোনাজাতের শহর, ভিখারির শহর,
বেশ্যা দালালের শহর, রাশি-রাশি মিথ্যা বাগানের
শহর, ক্রুশবিদ্ধ সত্যের শহর, বিক্ষোভ মিছিলের শহর,
স্লোগান-ঝংকৃত শহর, কবির মৌচাকের মতো শহর,
শেষ রাত্রির বাইজীর মতো এই শহর। এই মুহূর্তে আমি
যা স্পর্শ করবো তা উন্মোচিত হবে নতুন তাৎপর্য নিয়ে।
গাছের বাকল হবে তরুণীর ত্বক, পথের ধূলো রূপান্তরিত
হবে রাজা সোলেমানের খনির মর্ণিরতা, ভিখারিণীর
কানি হবে সালোমের লাস্যময়ী পট্রবস্ত্র। এখন আমি নিজেকে
স্বর্শ করলে আমার ভেতর থেকে শত-শত ময়ূর
বেরিয়ে এসে পেখম ছড়িয়ে দেবে উঠোন জুড়ে। যদি এখন
আমি খাতার শাদা পাতা স্পর্শ করি, তাহলে সেখানে
বইবে অলকানন্দা, গড়ে উঠবে আর্ডেনের বন, লতাগুল্মে
ঝলসে উঠবে হোমারের স্বপ্নময় হাত।
(হোমারের স্বপ্নময় হাত কাব্যগ্রন্থ)