দীর্ঘ পথ হেঁটেছে সে, তবু তার ক্লান্তি নেই, বিরক্তি নেই
এতটুকু। আরও কিছু পথ বাকি আছে ভেবে তার সত্তা
সরোদের মতো বেজে ওঠে। পথ চলতে কতবার পুরু সবুজ।
ঘাসে গড়াগড়ি খেয়েছে, দেখেছে ঝোপের কান ঘেঁষে
খরগোশের দৌড়, কাঠবিড়ালির ত্রস্ত তাকানো, বাদাম মুখে
নিয়ে গাছের কোটরে লুকানো। কতবার সে গোধূলিতে নদীতীরে
দাঁড়িয়েছি, কতদিন ছুটেছে এক ঝাঁক রঙিন প্রজাপতির
পেছনে, কত রাত ফুলের সুগন্ধ আর গোল চাঁদ তাকে জাগিয়ে
রেখেছে। কবেকার জাহাজডুবি, নাবিকদের হাহাকার আর
মধ্যসমুদ্রে চকিতে ভেসে-ওঠা মৎস্যকন্যাদের গানের কথা ভেবে স্বপ্নে
সে ডুবে গেছে। অনেকটা পথ হেঁটেছে সে, আরও কিছু পথ আছে
বাকি, এ-কথা ভাবলেই মনের ভেতর তার করতালি।
এই দীর্ঘ পথ হাঁটতে গিয়ে সে গল্প জুড়ে দিয়েছে কাছের হরেক
রকম গাছগাছালি আর দূরের আকাশের তারাদের সঙ্গে, ঘনিষ্ঠ
বসে গেছে দোয়েল, কোকিল, বুলবুলি, ঘুঘু আর ডাহুকের মেলায়।
পথ চলতে ওর সখ্য হয়েছে কত মানুষের সঙ্গে, তারা অনেকে সাধারণ,
কেউ কেউ অসাধারণ। এবং এই চলার পথেই সে অন্ধকারে আতশবাজির
মতো জ্বলে উঠে হাত রেখেছে গৌরীর হাতে, ওর কালো চোখের অতল
নির্জনে ডুবে মনে হয়েছে মনে এই মানবীকে যিশু খ্রিষ্টের জন্মের হাজার
বছর আগে থেকে ভালোবেসেছে। গৌরীর কথা কখনও আলিঙ্গন, কখনও
চুম্বন হয়ে স্পর্শ করে তাকে। অনেকটা পথ হাঁটার পর সামনের দিকে
দৃষ্টি ছড়িয়ে ওর মনে হয়, এ পথের শেষ কোথায়, কখন-জানা নেই।
সে জানে, তার এতটুকু ক্লান্তি নেই, বিরক্তি নেই একরক্তি। সে চায়, পথ
যেন ফুরিয়ে না যায় চলার পথে যেন থাকে চঞ্চল প্রজাপতির দল,
গাছের পাতার মৃদু কম্পন, দোয়েলের শিস, মৎস্যকন্যার ঝলসানি, গৌরীর
বাড়িয়ে-দেওয়া সোনালি হাত। পথ চলাতেই যে তার ছন্দোময়
শিহরণ। আচমকা ছন্দপতন তার কাম্য নয় কিছুতেই।
(মেঘলোকে মনোজ নিবাস কাব্যগ্রন্থ)