আমার প্রতিবেশী ভদ্রলোকটিকে বাতিগ্রস্ত বলা
ঠিক হবে না, যদিও তিনি
কিছুট উটকো ধরনের মানুষ আর হর-হামেশা
বলেন মাথা-খারাপ করা কিছু কথা।
বরাবরই দেখে আসছি,
আমার প্রতিবেশীর চুল প্রায় সকল সময়
উস্কো খুসকো, অনবরত ঝাড়েন সিগারেটের ছাই,
আর কথা বলার ফাঁকে ফাঁকে
মটকাতে থাকেন আঙুল। হঠাৎ কোনো কারণে আড্ডায়
তার মেজাজ সাপের ফণার মতো লাফিয়ে উঠলে,
আমি কোনো দ্বিরুক্তি না করে
সারা ময়দান তার হাতেই ছেড়ে দিই। ভদ্রলোক
ভীষণ আসক্ত নিজের কণ্ঠস্বরের প্রতি। তাই বলতে যতটা
ভালোবাসেন, শুনতে ততটা নয়।
অনেকে তাঁকে পছন্দ করে না, কেউ করে বেজার
সন্দেহ। কারো কাছে তিনি সিআইএ-র
এজেন্ট, কেউ তাকে কেজিবি-র দালাল বলে
শনাক্ত করতে আগ্রহী। এ সন্দেহ সন্দেহ খেলা চলে
তাঁর আড়ালে। তিনি টের পান কিনা জানি না। তবে প্রায়শই
‘কী জানেন, সোনার রেকাবিতে আরশোলা
নির্দ্বিধায় হেগে দিতে পারে’ বলে আমার প্রতিবেশী
সিগারেটে তন্ময় সুখটান দেন। এই বাক্যটি তিনি,
বলা যায়, ধুয়ো হিসেবে ব্যবহার করতে পছন্দ করেন।
কোনো কোনোদিন আড্ডায় মাঝখানে
তিনি বেমক্কা বলে বসেন, ‘এ পাড়ায় একটি বাড়িরও
দেয়াল নেই, প্রকৃত কফিন আছে
প্রতিটি উঠোনে।‘ কারুর ভুরু কুঁচকে ওঠে কেউ হাসে
ফিচেল হাসি কেউবা
চেয়ারের হাতলে তবলা বাজাতে শুরু করে, দৃষ্টি
চালান করে জানালার বাইরে।
এ ধরনের কথা যে তিনি আসর মাৎ করার জন্যে বলেন,
তা নয়। এইতো সেদিন অফিসের দিকে
রওয়ানা হয়েছি, আমাদের ব্যাকাট্যারা গলির মোড়ে
দেখা হয়ে গেলো আমার সেই প্রতিবেশীর সঙ্গে,
কাছে ধারে কেউ নেই; কুশল জিগ্যেস না করেই
তিনি বললেন, ‘বুঝলেন রাহমান সাহেব, এ শহরের
প্রতিটি যুবতীর শরীরে মাছে আঁশের মতো
কিছু একটা গজাতে শুরু করেছে, আমি
স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি।‘ তিনি যে মাছের বদলে হিসহিসে
সাপ শব্দটি ব্যবহার করেননি,
সে জন্যে কৃতজ্ঞ বোধ করলাম।
পরদিন তিনি বললেন,
‘আমার টেবিলটা কাল সারারাত কেঁদেছে
ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে আর মাঝে মাঝে গান গেয়েছে
মাথা-বিগড়ে-যাওয়া ওফেলিয়ার মতো।‘
বলা নেই, কওয়া নেই, এক বিকেলে
সিগারেটের ছাই ঝাড়তে ঝাড়তে
‘চঞ্চল টাকা আঁচলে বেঁধেনা’ ব্যাংকের এই বিজ্ঞাপনটি
তিনি এভাবে আওড়ালেন, যেন
কোনো ধ্রুববাক্য উচ্চারণ করছেন।
তাঁর আরো কিছু বেধড়ক উক্তি-
সেদিন দেখলাম চৌরাস্তায় একজন স্যুটপরা মাকুন্দ
গবাগব গিলছে সংস্কৃতির শালপাতা।
আমাদের এই শহর যদি পুরোদস্তুর একটা বার্থ ডে কেক
হয়ে যায়, তাহলে
নিশ্চয় ডগমগে চৈত পরব শুরু হয়ে যাবে চারদিকে।
আচ্ছা বলুনতো আপনারা কি কেউ
শহীদ মিনারের ওপর এক ঝাঁক ধাতব শকুনকে ওড়াউড়ি
করতে দেখেন না সবসময়?
আমার উঠোনে ক্লিওপেট্রার কালের জাহাজ
নোঙর ফ্যালে; কুরোসাওয়ার সাত সামুরাই
চকচকে তলোয়ারের চমৎকার খেলা দেখার মধ্যরাতে;
প্রমেথিউসের টাইটানিক পায়ে গজিয়ে উঠেছে মস্ত গোদ।
আমরা ক’জন মেতেছিলাম ইতিহাসের
গতিপ্রকৃতি নিয়ে। আলোচনা যখন উত্তজনার
চূড়ায় থরো থরো, তখন আমার প্রতিবেশী প্রায় কবিতা
আবৃত্তির ধরনে বললেন,
‘ইতিহাস আঠার মতো আটকে আছে ঝকঝকে
কেতাদুরস্ত কূটনীতিকদের চটপটে পাছায় আর আ’মরি
নিতম্ব উঁচিয়ে-রাখা বিশ্বসুন্দরীদের
প্রতিযোগিতা-লোলুপ চুচিতে।
সত্যি বলতে কি, মানব স্বভাবের কোন্ এলাকায়
আমার প্রতিবেশী অবস্থান,
এ ব্যাপারে আজ অব্দি আমি মনস্থিত করতে পারিনি।
(আমার কোন তাড়া নেই কাব্যগ্রন্থ)