"সনেট" শব্দটি ফ্রান্সের দক্ষিণাঞ্চল আর ইতালির অক্সিটান উপত্যকার ভাষার একটি শব্দ "সনেটো (sonetto)" থেকে এসেছে, যা লাতিন (Latin) শব্দ "সুনো (suono)" থেকে এসেছে, যার অর্থ হলো "a sound বা একটি   ধ্বনি/শব্দ/গান"। অক্সিটান ভাষাতে লেখা সনেটগুলোর মধ্যে কেবল একটা সনেট সমকালীন পাঠকের কাছে পৌঁছেছে।

সনেট মূলত গীতধর্মী মন্ময় বা আত্মনিষ্ঠ কবিতারই একটি ধ্রুপদী রূপশিল্প। একটি ধ্রুপদী নিয়মকে অবলম্বন করে কবির একটিমাত্র ভাবকল্পনা সনেটে রূপায়িত হয়। ধ্রুপদী নিয়মকে মেনে চলতে হয় বলে সনেট স্বাধীন গীতি কবিতা হতে স্বতন্ত্র।

মূলত, ইতালিয়ান কবি গিয়াকোমো দা লেন্টিনি (Giacomo da Lentini) ত্রয়োদশ শতাব্দীতে (১২৩৫-১২৯৪) সিসিলিয়ান উপভাষায় প্রথম সনেট কবিতা রচনা করেছিলেন। তিনি প্রায় ২৫০টি সনেট রচনা করেন। সে সময়ে দান্তে আলিগিয়েরি (Dante Alighieri, ১২৬৫-১৩২১) এবং গুইডো কাভালকান্তি (Guido Cavalcanti, ১২৫০-১৩০০) সহ অন্যান্য ইতালিয়ান কবি কতিপয় সনেট রচনা করেছিলেন। ১২৮৪-তে কবি পাওলো লানফ্রান্সিয়া ডি পিস্তোয়া (Paolo Lanfranchi da Pistoia, ১২৮২-১২৯৫, অক্সিটান ও ইতালিয় ভাষার একজন উল্লেখযোগ্য ইতালিয় কবি) তৃতীয় আরাগনকে একটা যুদ্ধের খবর জানায় সনেটের মাধ্যমে, যা ফ্লোরেন্সে সংরক্ষিত রয়েছে। তবে, নবজাগরণের যুগসন্ধিতে চতুর্দশ শতাব্দীর ইতালিয় গীতিকার কবি ফ্রান্সিস্কো পেত্রার্ক (Francesco Petrarch) হলেন সনেটের প্রকৃত প্রবর্তক বা জন্মদাতা। তার নামানুসারে ইতালিয় সনেটকে পেত্রার্কীয় (Petrarchan) সনেট হিসাবে অভিহিত করা হয়। যদিও পেত্রার্ক ইতালীয় সনেট আবিষ্কার করেনি, তাকে ফর্মের পারফেক্টর হিসাবে বিবেচনা করা হয়।

ইংরেজিতে সনেট কবিতা প্রথম পরিচিতি পেয়েছিল খ্রীষ্টীয় ১৬শ (ষোড়শ) শতাব্দীতে স্যার টমাস ওয়াট (Sir Thomas Wyatt)-এর মাধ্যমে। কিন্তু এর প্রচলন প্রবল হয়ে ওঠে স্যার ফিলিপ সিডনি (Sir Philip Sidney)-এর Astrophel and Stella (১৫৯১) প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে। তার পরের দুই শতক উইলিয়াম শেক্সপিয়ার (William Shakespeare), এডমন্ড স্পেন্সার (Edmund Spenser), মাইকেল ড্রায়টন (Michael Drayton) ইত্যাদি ব্যক্তিত্ত্বরা সনেট কবিতাকে নতুন নতুন ধাপে এগিয়ে নিয়ে যান। এরূপ কবিতার মূল বিষয়বস্তু ছিল নারীর প্রতি ভালবাসা।

ইংলিশ সনেটের সাথে শেক্সপিয়ারের সম্পর্ক ইতালীয় সনেটের সাথে পেত্রার্কের সম্পর্কের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ। অনেকটা পেত্রার্কের মতো শেক্সপিয়ার তাঁর নাম বহনকারী কাব্যিক রূপের সূত্রপাত করেননি। যাইহোক, তাঁর ফর্মের স্পষ্ট দক্ষতা সাহিত্যিক ঐতিহাসিকদের পুরো সনেটের ধরণকে নামকরণ করার জন্য প্ররোচিত করেছিল।

মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্তকে বাংলা ভাষায় সনেটের জন্মদাতা বলা হয়।

এখানে নিম্নের প্রধান পাঁচ ধরণের সনেট বিষয়ে আলোচনার প্রয়াস পাবোঃ

        পেত্রের্কীয় সনেট
        শেক্সপিয়ারিয়ান সনেট
        স্পেন্সারিয়ান সনেট
        মিল্টনিক সনেট
        ফ্রেঞ্চ সনেট

তবে তার আগে বোঝার সুবিধার্থে সনেট সম্পর্কিত কতিপয় পরিভাষা আলোচনা করা খুবই গুরুত্বপূর্ণঃ

১) অষ্টক (Octave): সনেটের ৮ বাক্য/পঙ্‌ক্তি/পদ/চরণ(line) নিয়ে অষ্টক গঠিত।

২) ষটক (Sestet): সনেটের ৬ বাক্য/পঙ্‌ক্তি/পদ/চরণ(line) নিয়ে ষটক গঠিত।

৩) চতুষ্ক (Quatrain): সনেটের ৪ বাক্য/পঙ্‌ক্তি/পদ/চরণ(line) নিয়ে চতুষ্ক গঠিত।

৪) ত্রিপদীকা (Tercet): সনেটের ৩ বাক্য/পঙ্‌ক্তি/পদ/চরণ(line) নিয়ে ত্রিপদীকা গঠিত।

৫) সমিল দ্বিপদীকা (Rhymed couplet)/সমাপ্তি উপভাগ (Coda): এটি সনেট জাতীয় কবিতার স্তবক বিন্যাসের একটি পদ্ধতি যাতে দুটি বাক্য/পঙ্‌ক্তি/পদ/চরণ(line) একটি স্তবক/পঙ্‌ক্তিগুচ্ছ (stanza)-এ বিন্যস্ত থাকে এবং যাদের প্রতি বাক্য/পঙ্‌ক্তি/পদ/চরণ(line)-এর শেষে মিল বর্তমান।

৬) ভোল্টা (Volta): পেত্রার্কীয় সনেটে অষ্টক থেকে ষটকে যাওয়ার সময় কবিতার মেজাজ বদল লক্ষ্য করা যায়। একে ভোল্টা বলে। শেক্সপিয়ারিয়ান ও স্পেন্সারিয়ান সনেটে শেষ সমিল দ্বিপদীকাতে ভোল্টা লক্ষ্য করা যায়। এক কথায় ভোল্টা হল কবিতার মেজাজ বদল।

৭) অন্ত্যমিল (Rhyme Scheme): একটি কবিতার প্রতিটি বাক্য/পঙ্‌ক্তি/পদ/চরণ(line)-এর শেষে মিলের ক্রম বা ধ্বনির বিন্যাসই হলো কবিতার অন্ত্যমিল। এ ক্ষেত্রে সাধারণত বর্ণ ব্যবহারের মাধ্যমে বাক্য/পঙ্‌ক্তি/পদ/চরণ(line)-এর অন্ত্যমিল (rhyme scheme) প্রদর্শন করা হয়। উদাহরণ স্বরূপঃ

          গোলাপ ফুল লাল(A)
          বেগুনের রঙ বেগুনী(B)
          বলো তোমার রঙ কী(C)
          আমি সে কথাটি শুনি(B)


পেত্রের্কীয় সনেটঃ
চতুর্দশ শতাব্দীর ইতালির গীতিকার কবি ফ্রান্সিস্কো পেত্রার্ক (Francesco Petrarch)-এর নামানুসারে প্রেত্রের্কীয় সনেটের নামকরণ করা হয়। ইতালীয় রেনেসাঁর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা পণ্ডিত হিসাবে বিবেচিত পেত্রার্ক বিদ্যমান সনেট ফর্মের পারফেক্টর হিসাবে তাঁর উপাধি অর্জন করেছিলেন। পেত্রের্কীয় সনেটের নিম্নলিখিত মূল উপাদানগুলির দ্বারা চিহ্নিত করা হয়েছেঃ

ক) এটি চৌদ্দ বাক্য/পঙ্‌ক্তি/পদ/চরণ(line)-এর কবিতা।

খ) প্রথম ৮টি বাক্য/পঙ্‌ক্তি/পদ/চরণ(line) নিয়ে উপভাগে (subsection) বিভক্ত, একে অষ্টক (octave) বলা হয় এবং এর পরের ৬টি বাক্য/পঙ্‌ক্তি/পদ/চরণ(line) নিয়ে আরেকটি উপভাগে (subsection) বিভক্ত হয়, একে ষটক (sestet) বলা হয়।

গ) অষ্টক (octave) দুটি চতুষ্ক (quatrain) এবং ষটক (sestet) দুটি ত্রিপদীকা (tercet) নিয়ে গঠিত। অষ্টক উপভাগে প্রশ্ন কিংবা বিবরণের মাধ্যমে কবিতার মূল ভাববস্তুর আভাস দেওয়া হয় আর ষটক উপভাগে সে প্রশ্নের বা অবতারণার উত্তর বা সমাপ্তি সূচিত হয়। এই সনেটে কখনও অষ্টক ও ষটক পৃথকভাবে অবস্থান করে আবার কখনও এক অবিভক্ত কবিতারূপে সনেটের সমগ্র গঠনটি পরিস্ফূট হয়।

ঘ) অষ্টক (octave)-টিতে ABBA ও ABBA অন্ত্যমিল পদ্ধতি (rhyme scheme) অনুসরণ করা হয়। এর অর্থ প্রথম, চতুর্থ, পঞ্চম ও অষ্টম বাক্য/পঙ্‌ক্তি/পদ/চরণ(line)-এর ক্ষেত্রে একে অপরের সাথে অন্ত্যমিল থাকে এবং দ্বিতীয়, তৃতীয়, ষষ্ঠ এবং সপ্তম বাক্য/পঙ্‌ক্তি/পদ/চরণ(line-এর ক্ষেত্রে একইভাবে একে অপরের সাথে অন্ত্যমিল থাকে।

ঙ) তবে, পেত্রের্কীয় সনেটে “Crybin” variant-এ আলাদা অন্ত্যমিল পদ্ধতি (rhyme scheme) অনুসরণ করে। এক্ষেত্রে শুরুর অষ্টকটির (octave) জন্য ABBA ও CDDC অন্ত্যমিল ব্যবহার করা হয়।

চ) ষটকের (sestet) ক্ষেত্রে দুটির মধ্যে যে কোন একটি অন্ত্যমিল পদ্ধতি (rhyme scheme) অনুসরণ করা হয়। ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত অন্ত্যমিল পদ্ধতি (rhyme scheme) হলো CDE ও CDE, যেখানে নবম ও দ্বাদশ; দশম ও ত্রয়োদশ এবং একাদশ ও চতুর্দশ বাক্য/পঙ্‌ক্তি/পদ/চরণ(line)-এর ক্ষেত্রে একে অপরের সাথে অন্ত্যমিল থাকে।

ছ) ষটকের (sestet) ক্ষেত্রে অন্য আরেকটি অন্ত্যমিল পদ্ধতি (rhyme scheme) হলো CDC ও CDC, যেখানে নবম, একাদশ, দ্বাদশ ও চতুর্দশ বাক্য/পঙ্‌ক্তি/পদ/চরণ(line)-এর ক্ষেত্রে একে অপরের সাথে অন্ত্যমিল থাকে; এবং দশম ও ত্রয়োদশ বাক্য/পঙ্ক্তি/পদ/চরণ(line)-এর ক্ষেত্রে একে অপরের সাথে অন্ত্যমিল থাকে। একে ইতালির একটি দ্বীপ অঞ্চলের নামে "সিসিলিয়ান ষটকও (Sicilian Sestet)" বলা হয়।

দান্তের ইতালিয়ান সনেটগুলি কখনও কখনও ঐতিহ্যবাহী পেত্রের্কীয় অন্ত্যমিল পদ্ধতির (rhyme scheme) বাইরে অবস্থান নেয়। দান্তে "তেরজা রিমা (terza rima)" কৌশলটি গ্রহণ করেছিলেন, যা তিন বাক্য/পঙ্‌ক্তি/পদ/ চরণ(line)-এর মধ্যে আন্তবেষ্টনী গড়ে তোলে। Terza Rima-তে ABA BCB CDC DED অন্ত্যমিল প্রক্রিয়া (rhyme scheme) অনুসরণ করা হয়।

পেত্রের্কীয় সনেটগুলি ইংল্যান্ডে প্রচুর জনপ্রিয় ছিল। পেত্রের্কীয় ফর্মের জন্য পরিচিত অন্যান্য ইংরেজি ভাষার কবিদের মধ্যে ব্রাউনিং (Browning), উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থ (William Wordsworth) এবং স্যার টমাস ওয়াইট (Sir Thomas Wyatt) অন্তর্ভুক্ত রয়েছেন।

আসুন এবার পেত্রের্কীয় সনেটের একটি ইংরেজি অনুবাদ (Thomas Wentworth Higginson কর্তৃক অনুদিত) দেখা যাকঃ

          “She ruled in beauty o’er this heart of mine, (A)
           noble lady in a humble home, (B)
           And now her time for heavenly bliss has come, (B)
          ‘Tis I am mortal proved, and she divine. (A)
          The soul that all its blessings must resign, (A)
          And love whose light no more on earth finds room, (B)
          Might rend the rocks with pity for their doom, (B)
          Yet none their sorrows can in words enshrine; (A)

          They weep within my heart; and ears are deaf (C)
          Save mine alone, and I am crushed with care, (D)
          And naught remains to me save mournful breath. (E)
          Assuredly but dust and shade we are, (C)
          Assuredly desire is blind and brief, (D)
          Assuredly its hope but ends in death.” (E)


এবার বাংলা ভাষায় একটি প্রেত্রের্কীয় সনেট দেখা যাকঃ

          কালোকেশী কুঁকড়ানো চুল, হাওয়া লেগে উড়ছে (A)
          মধুর মেদুর আলোড়নে, দিয়ে যায় পরশন (B)
          এলোমেলো দোলে হাওয়ায়, অনুরাগে আবেশন (B)
          মনোরম কুঁকড়ানো গিঁটে, কালো নীরদ ঘুরছে (A)
          চোখে তার আকাশের তারা, বিষের কাঁটা ছুড়ছে (A)
          প্রেমে অবহেলা ব্যবধান, মিছে তার আলাপন (B)
          পথহারা পথে লাগে ঘোর, হয়রান খুঁজে ধন (B)
          ছাই-চাপা আগুনের তাপে, জ্বলনে মন পুড়ছে। (A)

          নিজেকে চিনেছি এতোদিনে, তাই খুঁজে পাই তারে (C)
          আপন ভুবনে বেদনায়, সুর গাঁথি অবশেষে (D)
          সে আজ বহু দূর নিবাসে, ডালি ভরে দেবো যারে (C)
          হৃদয়ে জানালা খুলে রাখি, জ্বেলে আলোক আঁধারে (C)
          মৃত বাগানের গাছে ফুল, যদি ফোটে ভালোবেসে! (D)
          আমার আশার তরিখানি, তবে ভিড়বে সে পারে! (C)
      
          [পর্বঃ ১০+৮ (মাত্রা); নিজেকে চিনেছি এতোদিনে/মোঃ ফিরোজ হোসেন]

                                                                                                ক্রমশ