আসরের কবিদের জন্য - আশাকরি উপকার হবে:
তার আগে জানা প্রয়োজন সৈয়দ আলী আহসান কবিতা সম্পর্কে কী বিশ্বাস পোষণ করতেন অন্তরে, কবিতা বলতে তিনি বুঝতেনই বা কী। তাঁর উচ্চারণ কাব্যগ্রন্থের ১৮ নম্বর কবিতাটি এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায়। একটি নিরেট গদ্যকবিতা এটি, টানা গদ্যে লেখা :
‘‘যে পৃথিবীতে জীবনের স্বাভাবিক ছন্দ ভেঙে গেছে এবং যেখানে মানুষের পদক্ষেপ অর্থহীনতায় যেন উৎসর্গীকৃত সেখানে শৃঙখলিত সুরের সম্মোহন কি করে আসে? সেখানে কবিতা বিচিত্র ভঙ্গুর শব্দচূর্ণের উদ্যমহীন সমস্বর।
আমি যদি কখনও মহাকাব্য লিখি, সে মহাকাব্যে ঘটনার শাসনে নিয়ন্ত্রিত কোনও কাহিনী থাকবে না; সেখানে ইতিহাসের খন্ডাংশ, অতর্কিত চিন্তার সংশয়, স্মৃতির অনুরণন, ধর্ম-নির্দেশের বিশ্লেষণে আত্মার আর্তনাদ একসঙ্গে কথা বলে উঠবে।
আবেগ যদি চিন্তার দ্বারা সমর্থিত না হয় এবং বুদ্ধির দ্বারা পরিশোধিত না হয়, তবে সে-আবেগ কুহেলিকাই সৃষ্টি করতে পারে, জীবনের সম্ভাবনা জাগায় না। তাই শুধুমাত্র আবেগের উপর নির্ভরশীল যেসব কবিতা তাতে কোনো বিস্ময় নেই।’’
সৈয়দ আলী আহসান তাঁর এই কবিতা দ্বারা পাঠকদেরকে বুঝিয়ে দিয়েছেন যে, তাঁর কবিতা নির্ভেজাল আবেগের আধার নয়। তাঁর কবিতায় পাঠক খুঁজে পাবেন আবেগ, কল্পনা ও বুদ্ধি-এই তিনের মেলবন্ধন। নিরেট আবেগনির্ভর নয় বিধায় তাঁর কবিতা অসম্ভব রকমের শান্ত ও সুন্দর। তাঁর কবিতায় ঢেউ আছে, সে ঢেউয়ে তীর ভাঙে না; শব্দ আছে, সে-শব্দ নিছক চিৎকার নয়, গীতল ও মধুর; এবং আলোও আছে, সে আলো হেজাকের মতো প্রখর নয়, জোনাকির মতো কোমল ও কমনীয়।
আমার পূর্ব-বাংলা বাংলা ভাষায় সম্পূর্ণ একটি নতুন ধরনের কবিতা। এর নতুনত্ব দুই দিক দিয়ে: এক. মেজাজে, দুই. দেহ-সৌষ্ঠবে। কী-এক আশ্চর্য সম্মোহনী শক্তি রয়েছে এর সর্বাঙ্গে। যখন কবিতাটি শুরু হয় এইভাবে :
আমার পূর্ব-বাংলা কি আশ্চর্য
শীতল নদী
অনেক শান্ত আবার সহসা
স্ফীত প্রাচুর্যে আনন্দিত
একবার কোলাহল, অনেকবার
শান্ত শৈথিল্য
আবার অনেকবার স্তিমিত কন্ঠস্বরের
অনবরত বন্যা
কতবার বক আর গাঙশালিক
একটি কি দুটি মাছরাঙা
অবিরল কয়েকটি কাক
বাতাসে বাতাসে প্রগল্ভ কাশবন
ঢেউ-ঢেউ নদী প্রচুর কথার
কিছু গাছ আর নারকেল শন পাতার
ছাউনির ঘর নিয়ে
এক টুকরো মাটির দ্বীপ
তখন শ্রোতা হতভম্ব হয়ে থেমে যান, হরিণের মতো কান খাড়া করে দিয়ে পরম কৌতূহলে শুনতে থাকেন একগুচ্ছ শব্দের আওয়াজ আর মর্মার্থ উদ্ধারে সচেষ্ট হন, ততই তিনি নুড়ির মতো এক নিবিড় ভালবাসায় তলিয়ে যেতে থাকেন তার দেশের অথই সৌন্দর্যে। আঁকাবাকা রেখার মতো সাজানো কবিতার চরণগুলো দেখে, প্রথম দোলাতেই মনে হয়, কবিতাটি বোধহয় নিখুঁত ছন্দ দিয়ে গাথা; অথচ একটু খেয়াল করলেই পরিষ্কার হয়ে যায় যে, কবি প্রচলিত কোনো ছন্দের- স্বরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত, কি অক্ষরবৃত্ত-, আশ্রয় নেননি এখানে। তারপরও কোনো দুর্মুখের একথা বলার স্পর্ধা নেই যে, কোনো ছন্দ নেই এ কবিতায়।
আমার পূর্ব-বাংলায়ও একটি ছন্দ আছে, রবীন্দ্রনাথ যাকে ছন্দ গ্রন্থে বলেছেন কানের ছন্দ; আমি বলি, তারার ছন্দ। তারার ছন্দ এ কারণে যে, আকাশের তারাগুলো লাইন কেটে কেটে নির্দিষ্ট গ্যাপ দিয়ে দিয়ে সাজানো নয়, সাজানো এলোমেলোভাবে, তবু তারাভরা আকাশের সঙ্গে কারো কি তুলনা হয় কখনও? অথবা একে বলা যায় গাছের ছন্দ। অরণ্যের গাছগুলো প্রকৃতির নিজস্ব নিয়মে এলোপাথাড়ি সাজানো অথচ কি-সুন্দর! বাংলা-কবিতায় আমার পূর্ব-বাংলার অনুপ্রবেশ এইভাবে নতুন মেজাজে, যে-মেজাজ রবীন্দ্রনাথের থেকে আলাদা, নির্জনতার কবি জীবনানন্দ দাশ থেকেও ভিন্ন; এবং অন্য যে বিষয়টি বিশেষভাবে লক্ষণীয়, তা হলো, এর প্রচলিত ছন্দ ভেঙে দেয়ার ছন্দ।