গানে নোবেল পুরস্কার, একটু অবাক হলেন? হ্যাঁ, ২০১৬ সালে সাহিত্যে ১১৩তম নোবেল বিজয়ী একজন গীতিকার বব ডিলানের (Robert Allen Zimmerman, born May 24, 1941) কথা বলছি। একশ বছরেরও আগে কবিগুরু গীতাঞ্জলির ইংরেজি ভাবানুবাদ song offerings-এর জন্য একই স্বীকৃতি পেয়েছিলেন। তবে song offerings-যে আসলে বাংলা গান - বিষয়টি নোবেল কমিটির জানা ছিল না, ইংরেজি সাহিত্যধারার অংশ হিসাবে বইটিকে পুরস্কৃত করা হয়েছিল।

আমেরিকান নিজস্ব ধাঁচের ফোক ও রক গানের শিল্পী বব ডিলান, মূলত তাঁর সঙ্গে আমাদের পরিচয় গত শতকের ষাটের দশকে - তাঁর গাওয়া যুদ্ধবিরোধী গানের হাত ধরে। সে সময়ে ভিয়েতনামে মার্কিন আগ্রাসনের প্রতিবাদ হিসেবে এবং নাগরিক অধিকার আন্দোলনের সপক্ষে সেসব গান শুধু আমেরিকায় নয়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশেও ব্যাপক ভাবে চর্চা করা হয়েছে। ১৯৬৩ সালে ওয়াশিংটনে মানবাধিকার ও মুক্তির দাবিতে লাখো মানুষের মিছিলে মার্টিন লুথার কিংয়ের পাশে দাঁড়িয়ে গান ধরেছিলেন ডিলান। কয়েক বছর আগে, আমেরিকার বিটনিক কবি অ্যালেন গিন্সবার্গ ডিলানকে নোবেল দেওয়ার দাবি তুলে রীতিমতো শোরগোল ফেলে দিয়েছিলেন।

যে কজন আমেরিকান শিল্পী হুইটম্যানের বহুমাত্রিকতাকে (Do I contradict myself? Very well, then, I contradict myself; I am large - I contain multitudes– Walt Whitman) আত্মস্থ করেছেন তাদের মধ্যে বব ডিলান অগ্রগামী। ১৯৯৭ সালে লেখক ও সঙ্গীত সমালোচক টম পিয়াজা এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে বব ডিলান সম্পর্কে এ কথা বলার কুড়ি বছর পর তিনি যখন সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেলেন, সুইডিশ একাডেমি তাঁর সম্পর্কে বললো, তিনি আমেরিকান সঙ্গীত ঐতিহ্যে নতুন এক কাব্যিক দ্যোতনা এনে দিয়েছেন। উল্লেখ্য যে, ১৯৭১ সালে নিউ ইয়র্কে আয়োজিত ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশে' জর্জ হ্যারিসন, রবিশঙ্করের সাথে বব ডিলানও ছিলেন৷

আমরা জানি ভাবের ভাষার দুটি মাধ্যম - কথা ও সুর। কবিতায় কথাকে প্রাধান্য দেয়া হয়, আর সঙ্গীতে সুরকে প্রাধান্য দেয়া হয়। সুরের ক্ষেত্রে ইন্দ্রিয় গ্রাহ্যতা থাকায় কোন কালেই ভাবের প্রতি যথাযথ মনোযোগ দেয়া হয়নি। কিন্তু কবিতার ক্ষেত্রে ভাবকে আশ্রয় করা মূখ্য বিষয়। গান বলুন কিংবা কবিতা বলুন, বব ডিলান কর্তৃক প্রদত্ত উপহারগুলো ঠিক প্রথাগত কবিতা নয়, সেখানে কবিতার প্রচলিত কোনো ফর্মও মেনে চলা হয়নি। এমনকি সেগুলির নিয়মমাফিক কোনো অর্থ উদ্ধারও খুব সহজ নয়। তবে, শুধু কবিতা হিসেবে ডিলানের গানের অর্থ উদ্ধার কঠিন, কিন্তু অসম্ভব নয়।

গান বা কবিতায় বব ডিলানের কণ্ঠস্বর ভীষণ তির্যক, ক্রুদ্ধ ও প্রতিবাদী; তাঁর ব্যবহৃত ভাষা ও কাব্য-কাঠামো বেশ সরল। কিন্তু শিকলে বদ্ধ স্বতঃস্ফূর্ত চিত্রকল্পের অপরূপ ঝলকানি। দ্ব্যার্থবোধকতায় অনন্য, সামনে থেকে দেখলে অর্থ একরকম, পাশ ফিরে তাকালে সম্পূর্ণ ভিন্ন। একে বুঝতে হলে অবারিত হতে হবে কল্পনার জানালা। অর্থ বা ভাবের ব্যঞ্জনা এবং অত্যন্ত শক্তিশালী আবেদনের দ্যোতনায় বব ডিলনের গানগুলো সমৃদ্ধ কবিতা হয়ে ওঠে, পৌঁছে যায় অনন্য উচ্চতায়। তাঁর গান বিশেষ করে ‘Blowin In The Wind’ এবং ‘The Times They Are A-Changin’-কে তারুণ্যের এন্থেম (জাতীয় সংগীত) বলা হয়, সামগ্রিক আবেদনযোগ্যতার এক অনন্য নজির।  

অত্যন্ত জনপ্রিয় কবিতা/গান ‘Blowin In The Wind’:

কতটা পথ হাঁটলে মানুষ
তবে তাকে মানুষ বলে?
হ্যাঁ, কতটা সাগর পেরোনোর পর
শ্বেত-পালকের বালুতে শ্রান্তি মেলে?
হ্যাঁ, কতবার ছুটলে কামানের গোলা
চিরতরে নিষিদ্ধ অবশেষে?
হে বন্ধু আমার, উত্তর বাতাসে ভাসে
জবাব ভাসছে বাতাসে
[How many roads must a man walk down
Before you call him a man?
Yes, ’n’ how many seas must a white dove sail
Before she sleeps in the sand?
Yes, ’n’ how many times must the cannonballs fly
Before they’re forever banned?
The answer, my friend, is blowin’ in the wind
The answer is blowin’ in the wind]

কিংবা তার ‘The Times They Are A-Changin’:

এটা অঙ্কিত এক রেখা
এটা অভিশাপের এক ধারা
এখন সেটা ধীর
পরে দ্রুততর হয়ে সারা
এখন যা আছে বর্তমান
তা অতীত হয়ে যাবে
আজ্ঞা যা কিছু আছে, দ্রুত তা হবে ম্লান
এবং এখনই প্রথম যা, হয়ে যাবে শেষ তখন
এখন সময়, বদলে যাচ্ছে যেমন
[The line it is drawn
The curse it is cast
The slow one now
Will later be fast
As the present now
Will later be past
The order is rapidly fadin’
And the first one now will later be last
For the times they are a-changin’]

উপরের গানদুটি নাগরিক অধিকার, মানবিকতা, যুদ্ধবিরোধী মনোভাব ও শান্তি অন্বেষণের প্রেক্ষাপটে লেখা ও গাওয়া হয়। বিশেষ করে ‘Blowin In The Wind’ গানে “The answer, my friend, is blowin’ in the wind/The answer is blowin’ in the wind” এমন প্রশ্নের মাধ্যমে শান্তি, স্বাধীনতা ও যুদ্ধবিরোধী প্রতিবাদী ভাবটাকে জাগিয়ে তোলা হয়েছে, যা খুবই রহস্যময় ও দ্ব্যর্থবোধক। দৃষ্টিভঙ্গি ও মানুষিকতার উপর এ গানের ব্যঞ্জনা উপলব্ধি নির্ভর করে।  

১৯৬২-তে কিউবায় সোভিয়েত আণবিক অস্ত্র মোতায়েন প্রশ্নে আমেরিকার সঙ্গে ভয়াবহ যুদ্ধের আশঙ্কার পটভূমিকায় বব ডিলান তীব্রভাবে প্রকাশিত হন তাঁর ‘A Hard Rain’s A-Gonna Fall’ গানটির মাধ্যমেঃ

ওহ, কোথায় ছিলে তুমি, আমার নীল নয়নের ছেলে?
ওহ, কোথায় ছিলে যুবা, আমার প্রাণ অরুণে মেলে?
বারোটি ঝাপসা পাহাড়-গাত্রে আমি হোঁচট খেয়েছি
হেঁটেছি আর ছয়টি পথের বাঁকে আমি হামাগুড়ি দিয়েছি
সাতটি কাতর অরণ্যে আমার পা দু’টি ফেলেছি
বারো মৃত মহাসাগরের কাছে আমি পৌঁছে গিয়েছি
আমি এক গোরস্থানের মুখ দিয়ে দশ হাজার মাইল গিয়েছি
আর এটা বড় কঠিন, এবং অনেক কঠিন, এবং ভারী কঠিন
আর এক ঝমঝমে বৃষ্টির অসহ্য পতন
[Oh, where have you been, my blue-eyed son?
Oh, where have you been, my darling young one?
I’ve stumbled on the side of twelve misty mountains
I’ve walked and I’ve crawled on six crooked highways
I’ve stepped in the middle of seven sad forests
I’ve been out in front of a dozen dead oceans
I’ve been ten thousand miles in the mouth of a graveyard
And it’s a hard, and it’s a hard, it’s a hard, and it’s a hard
And it’s a hard rain’s a-gonna fall]

কী অসাধারণ চিত্রকল্প তাঁর গানগুলিতে। শুধু কবিতা হিসেবে পাঠ করলে এই ‘বৃষ্টির অসহ্য পতন’ আদৌ বোধগম্য হবে না। অথচ কিউবান সংকটের প্রেক্ষাপটে ‘A Hard Rain’s A-Gonna Fall’ গানটি শুনলে তাঁর প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর উজ্জ্বল ভাবে ধরা দেয়। কবিগুরুর ‘গীতাঞ্জলির’ অনেক গানও শুধু কবিতা হিসেবে পুরোপুরি বোঝা যায় না, বোধের অগম্যতা মেটাতে আসতে হয় গায়কের কণ্ঠে।

ডিলান নিজে এই গান বা কবিতা লেখার বিষয়ে এভাবে বলেছেন - ‘কিউবান সংকটের সময় আমি থাকতাম নিউইয়র্কের ব্লিকার স্ট্রিটে। রাতে আমরা সবাই বাকহীন হয়ে ভাবতাম, তাহলে কি সবই শেষ? নিশ্চিত ধ্বংসের মুখে দাঁড়িয়ে আমরা কী করতে পারি? এটি ছিল সেই ভীতি ও উদ্বেগের বিবরণ, সর্বগ্রাসী সেই অর্থহীনতাকে বোঝার এক চেষ্টা।’

আবার কবির ‘Girl From The North Country’-গানে দুর্দান্ত চিত্রকল্পে বিরুদ্ধ প্রতিবেশ, বেদনা ও রোমান্টিক মানস অত্যন্ত চমৎকার ভাবে ফুটে উঠেছে:

আচ্ছা, যদি তুমি বেড়াতে যাও উত্তর দেশের মেলায়
যেথায় সীমান্তে ভারী আঘাত হানে হাওয়ায়
সেথায় থাকছো কেউ, মনে রেখো আমায়
একদা সে পড়েছিল আমার সত্যি ভালোবাসায়

আচ্ছা, যদি তুমি যাও, তখন তীব্র ঝড়ে তুষার আনাগোনা
তখন হিমায়িত নদী এবং গ্রীষ্ম হয়েছে শেষ
দয়া করে দেখে নিও, তার পরনে আছে উষ্ণ কোট কিনা
আর্তনাদের বাতাস হতে রেখো তাকে বেশ
[Well, if you’re travelin’ in the north country fair
Where the winds hit heavy on the borderline
Remember me to one who lives there
She once was a true love of mine

Well, if you go when the snowflakes storm
When the rivers freeze and summer ends
Please see if she’s wearing a coat so warm
To keep her from the howlin’ winds]

হার্ভার্ডের ‘কবিতা অধ্যাপক’ ও নামজাদা সাহিত্য-সমালোচক ক্রিস্টোফার রিকস ২০০৪ সালে প্রকাশিত তাঁর ‘Dylan’s Vision of Sin’ গ্রন্থে ডিলানের গানকে কবিতা হিসেবেই বিবেচনা করেছেন। তাঁর কথায়, এই কবিতা ইংরেজি সাহিত্যের প্রচলিত ধারা থেকে সম্পূর্ণ আলাদা কিছু নয়; বরং এই ভাষার শ্রেষ্ঠ কাব্যকীর্তির সঙ্গে তা সম্পৃক্ত।

তারপরও ডিলান শুধু একজন গায়ক ও গীতিকার নন, তিনি একজন কবিও - এই তর্ক শেষ হয়ে যায়নি। ফোক ঐতিহ্যে অনেক গায়কই গান লিখেছেন, তাঁদের কাউকে কখনো কবি হিসেবে আলাদা সম্মান দেয়া হয়নি। তবে ডিলান কেন? আমেরিকার প্রাক্তন পোয়েট লরিয়েট বিলি কলিন্স বলেছেন, সুর ছাড়া শুধু কথায় কোনো গীতিকবিতা অর্থপূর্ণ হয় না। কিন্তু এই নিয়মের এক ব্যতিক্রম ডিলান, হারমনিকা ও গিটার ছাড়াও তাঁর গান কবিতার মর্যাদা পায়। ২০১৬ সালের সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার অর্জনের ভেতর দিয়ে কবি হিসেবে ডিলানের এই স্বীকৃতি আরও পোক্ত হলো।

বিস্ময়কর রকম সরল কাব্য কাঠামো ও অনুপম চিত্রকল্পে ঠাসা গান বা কবিতা বব ডিলানের ‘রকস্টার’ হয়ে ওঠার নিম্নকণ্ঠ বিবরণ। এখানে খুব কম ক্ষেত্রেই নিজেকে পুরোপুরি উন্মোচন করেন তিনি, অথবা তাঁর কবিতা ও গানের অন্তর্গত বৈপরীত্য বুঝতে সাহায্য করেন আমাদের। আবার আকস্মিকভাবে এমন একটি কথাও সবাইকে জানান যে -আছে অথচ নেই, এমন অভিজ্ঞতাকে নিকটতর করার তীব্র অথচ নিভৃত তাগিদ থেকেই তিনি গান লেখা শুরু করেছিলেন। কী সেই অভিজ্ঞতা, যা আছে অথচ নেই, সেটি জানার জন্য বব ডিলানের গানের কাব্যশক্তিকেই খুঁজে বের করতে হবে।

তথ্যসূত্রঃ
(১) www.bobdylan.com
(২) Wikipedia
(৩) প্রথম আলো (জাতীয় দৈনিক)