সাধারণত বিশ্বজগৎ, পৃথিবী, প্রকৃতি, মানব সভ্যতা ইত্যাদির উৎপত্তি ও স্বভাব ব্যাখ্যা করতে প্রাচীনকালে ও মধ্যযুগে লোককাহিনীর জন্ম হয়েছিল, যা পুরাণ বা পৌরাণিক কাহিনী হিসাবে পরিচিত। পৌরাণিক কাহিনীগুলো আবর্তিত হয় দেবদেবীদের ঘিরে, যারা বিশ্বজগতের বিভিন্ন প্রপঞ্চের (illusion) উপর নিয়ন্ত্রণ রাখেন। যেমন, কেউ সূর্যের দেবতা, কেউ সমুদ্রের দেবতা ইত্যাদি। পৃথিবীর উৎপত্তি বা অস্তিত্বের প্রশ্নে মানব সভ্যতা সব সময় পৌরাণিক কাহিনী বেছে নিয়েছে। এ সকল পৌরাণিক কাহিনী অনেক ক্ষেত্রে রূপকথা হিসাবে ব্যাপকভাবে পরিচিতি লাভ করেছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই রূপকথায় কোন নির্দিষ্ট সময়কাল থাকে না এবং কোন লিখিত তথ্যও নেই যেমন ইতিহাস থেকে পাওয়া যায়। কিছু কিছু রূপকথায় বিভিন্ন চিহ্নের উল্লেখ থাকে যার দ্বারা বিভিন্ন অর্থ দাঁড় করানো যায়। অনেক ক্ষেত্রে পৌরাণিক কাহিনী একটি পবিত্র আখ্যান, যা ধর্মীয় বা আধ্যাত্মিকভাবে তাৎপর্যপূর্ণ।

মূলত, গ্রিক শব্দ mythos (মিথোস) থেকে ইংরেজি Myth (মিথ) শব্দটি এসেছে; মিথোস অর্থ হলো গল্প বা কেচ্ছা। অভিধান অনুসারে মিথ অর্থ - পুরাণ, পুরাকাহিনী, অতিকথা, উপকথা, উপাখ্যান, কিংবদন্তি; প্রধানত কোনও গূঢ় রহস্যের ব্যাখ্যাপূর্ণ পৌরাণিক কাহিনী বা গূঢ় অর্থপূর্ণ কাহিনী। অর্থাৎ মিথ ‘পৌরাণিক’ না-ও হতে পারে। এছাড়াও, প্রাচীন কাল থেকে পুরুষানুক্রমিক প্রবহমান কাহিনী, বিশেষত কোনও জাতির আদি ইতিহাস সম্পৃক্ত বিশ্বাস ও ধারণা এবং নৈসর্গিক ঘটনাবলির ব্যাখ্যাকে মিথ হিসাবে অভিধানে উল্লেখ রয়েছে। ইংরেজিতে মিথের প্রতিশব্দ অনেক, যেমনঃ লোককথা, গল্প, ঐতিহ্য, কল্পকাহিনী, উপকথা, গাথা, রূপক, প্রতীক, রূপকথা, লোককাহিনী প্রভৃতি। আধুনিক কালে মিথ শব্দটি - বিভ্রম, কাহিনী, অলীক, উদ্ভট, কল্পনা, উদ্ভাবনা, মায়া, কুসংস্কার, বানোয়াট, মিথ্যা, আষাঢ়ে গল্প, আজগুবি প্রভৃতি অর্থে ব্যবহৃত হয়। যেমন ধরুন “বাংলাদেশের ফুটবল টিম বিশ্বকাপে খেলবে, এটা মিথের মতো শোনায়”; কিংবা “মেয়েরা পেটে কথা রাখতে পারেনা, কেবল পতিনিন্দায় অভ্যস্ত, এটা একটা মিথ”। দার্শনিকেরা মিথকে রূপক বা প্রতীকাশ্রিত কাহিনী হিসাবে মনে করেন।

কবি সাহিত্যিকেরা তাদের অভিজ্ঞতাকে লেখায় ফুটিয়ে তোলার জন্য মিথকে একধরনের উন্নত অভিব্যক্তিপূর্ণ কৌশল হিসাবে ব্যবহার করে থাকেন। এটি নিছক প্রাক-ঐতিহাসিক ও প্রারম্ভিককালে বিকশিত সেকেলে সাহিত্য রীতি নয়। বরং, এটি প্রত্যেক যুগে মানবজীবনে ও সর্বাধিক উন্নত সংস্কৃতিতে মূল মৌলিক উপাদান হিসাবে কাজ করে থাকে এবং একইসাথে শিল্পী ও কবিগণের জন্য এটি নির্ভরযোগ্য অনুপ্রেরণার উৎস। মিথ তাই প্রতিটি ধারণা, তত্ত্ব এবং চিন্তার ক্ষেত্রসমূহে মৌলিক জীবন্ত উপকরণ হিসাবে যুগে যুগে টিকে আছে। একই সাথে এটি সবচেয়ে প্রাচীন এবং স্বতঃস্ফূর্ত উপকরণ রূপে মানব চিন্তার শৈশবকে প্রতিনিধিত্ব করে, কারণ এটি বীরগণের রোমাঞ্চকর ঘটনা এবং দেবদেবীর সাথে তাদের মিথস্ক্রিয়াকে উপজীব্য করে মৌলিকভাবে রূপক চিন্তাধারাকে বিকশিত করে। মিথ কোন অভিজ্ঞতা নয়, এটি ইতিহাসের বাইরে নিজস্ব একটি কল্পিত জগতে সংঘটিত হয়।

দেবব্রত রেজ বলেন, “... মিথ বা উপাখ্যান নির্মাণ, মিথের প্রসারণ - এ সবই এক ধরনের বিশিষ্ট চিন্তার রূপ। মানবিক চিন্তার একটি স্বতন্ত্র অনন্য স্বাধীন রূপ। এই মিথ বা পুরা উপাখ্যান নির্মাণ মানুষের চৈতন্যের উদ্ভবের সঙ্গে-সঙ্গে আরম্ভ হয়েছে। আর এই নির্মাণ চলবে যত দিন মানবচৈতন্যের অস্তিত্ব থাকবে। প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে, ঐতিহাসিক কালে আবার সুদূর ভবিষ্যতেও এই মিথ নির্মাণ সমানভাবেই চলবে। এবং এখনও চলছে।” মিথ নির্মাণের উপযুক্ত বলে কোনও বিশেষ যুগকে চিহ্নিত করা যুক্তিযুক্ত নয়। সব যুগই Age of Mythology. “মিথ কালেকালে কালাতীত রূপে নিজেকে বারংবার সৃজন করে।” [“প্রসঙ্গ সাহিত্য ও মিথ” (কলকাতা, ২০১০) গ্রন্থের “উপাখ্যান (‘মিথ’), তার স্বরূপ ও আমরা - একটি দার্শনিক আলোচনা’ শীর্ষক প্রবন্ধ।] Albert A. Anderson এর মতে mythos শব্দটি হোমারের বিভিন্ন কাজে দেখা গেছে। এমন কি হোমার যুগের কবিরাও এই শব্দটি ব্যবহার করেছেন তাদের সাহিত্য কর্মে।

সুতরাং আমরা বলতে পারি যে পরিপূর্ণ উপকরণ হিসাবে মিথ প্রাচীন মানুষ ও সভ্যতার অস্তিত্ব প্রকাশ করে এবং বিশ্বজগতের প্রকৃতি সম্পর্কিত তত্ত্ব বিশ্লেষণ করে। এটি বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সত্যতা সম্পূর্নভাবে প্রকাশের লক্ষ্যে সময়, স্থান এবং বিভিন্ন বিষয়কে একত্রিত করে দেয়। তাই মিথকে একটি কিংবদন্তি বা রূপকথা বা গল্প অথবা রূপকথা/গল্প/কিংবদন্তির সংগৃহীত উপকরণ হিসাবে সংজ্ঞায়িত করা যায় যা অন্তরীণ প্রতীকরূপে মানব অস্তিত্বের ট্রাজেডি ও নশ্বর জীবনের সবচেয়ে গূঢ় দিককে নির্দেশ করে। সংস্কৃতিক জটিলতার কারণে কবিরা জীবনের সমস্যাবলির বিষয়ে সমকালীন দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশের জন্য মিথ থেকে উপযুক্ত নতুন অর্থ সৃষ্টি করেন বা গ্রহণ করেন এবং গভীর জ্ঞান, জাতীয় বিশ্বাস, ঐতিহ্য ও আধ্যাত্মিক উত্তরাধিকারের সাথে সংযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যে আধুনিক কাব্যিক গঠন বা কাঠামো নির্মাণে বিশেষ পদ্ধতির আশ্রয় গ্রহণ করে থাকেন। সংক্ষেপে বলা যায়, তারা কাল ও স্থানের সংযোজনে একটি বিকশিত ও খণ্ডিত দৃষ্টিভঙ্গি নির্মাণ করেন। ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে মিথ ছিল প্রাচীন মানুষের জন্য বিপর্যয় কাটিয়ে উঠার একটি উপায়। রাজনৈতিকভাবে মিথ হলো অধিক উজ্জ্বলতা, সুন্দর বিকল্প কিংবা আলোকিত পথ সৃষ্টির প্রচেষ্টা যার মাধ্যমে মানসিক ও পারিপার্শ্বিক ভারসাম্যমূলক রাষ্ট্র গঠন করা যায় এবং স্বপ্ন, প্রত্যাশা ও পুনরাহ্বানের ভিত্তি প্রদান করা যায়।

সিসিফাসের কিংবদন্তির কথাই ধরুন। কবি সাহিত্যিকেরা লক্ষ্য অর্জনে সিসিফাসের প্রচেষ্টাকে একজন মানুষের চিরন্তন কষ্ট ও সংগ্রামের প্রতীক হিসাবে ব্যবহার করে থাকেন। দেবতারা সিসিফাসকে চিরকাল একটি পাথরকে পাহাড়ের চূড়ায় উঠানোর শাস্তি দেয়, যেখান থেকে পাথরটা নিজের ভারেই আবার পড়ে যায়। সিসিফাস সেটা জানতেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি তার প্রচেষ্টা চালিয়ে যান। এ মিথটি নিরর্থক প্রচেষ্টার একটি প্রতীক।

বদর সাকির আল-সায়্যাব (১৯২৬-১৯৬৪), ইরাকের স্বনামধন্য কবি, ‍যিনি কবিতায় অসংখ্য কিংবদন্তী ব্যবহারের জন্য ব্যাপকভাবে পরিচিত ছিলেন। তিনি সিসিফাস থেকে একটি চিত্র গ্রহণ করে (এজন্য তিনি কিছু অর্থ পরিবর্তন করেছিলেন) বিভিন্ন মেজাজ ও অর্থ প্রকাশের মাধ্যমে পাঠককে সমৃদ্ধ করেছিলেন। আল-সায়্যাবের কবিতা “স্বাগতম দানবগণ” যেমন বলা হয়েছে –

পিতা, পিতা
ওহে সুমিষ্ট গীত-সিঁড়ি, কি প্রত্যাশা তোমার গভীরতায়?
সিসিফাস যেটা উপরে তোলে কিন্তু সেটা নীচে পড়ে যায়, তুমি যেমন ভেঙে পড়ো
ওহে রক্ত ও সময়ের সিঁড়ি, পানি থেকে আকাশ পর্যন্ত
আমার পিতা ও পিতামহের কবর হতে আমার কাছে দানবগণের আরোহণ
তার হাত আমাকে মৃদু ছুঁয়ে দেয় ও কপোলে সোহাগ-স্পর্শ করে
অতঃপর আমার শেষে আমার শুরু দেখি

[Father, father
Oh ladder of melodies, what desire lies in your depth?
Sisyphus lifts it but it falls to the bottom as you break down
Oh ladder of blood and time, from the water to the sky
Monsters ascend toward me from the soil of my father and grandfather
His hands touch mine and caress my cheek
Then I see my beginning in my end]

এখানে আল-সায়্যাব সিসিফাস মিথটির শোকাবহ পরিবেশকে দূরে সরিয়ে মা-এর স্তন্যপানরত অবস্থায় সন্তানের জন্ম উৎসব উদযাপনের প্রতীকে রূপান্তর করেছেন। এক্ষেত্রে মিথটি হতে তিনি মানুষের দুর্ভোগের মৌলিক অর্থ গ্রহণ করেছেন এবং এটিকে পার্থিব চক্রের ধারণার প্রতিমূর্তি হিসাবে নির্মাণ করেছেন; সিসিফাসের সংগ্রামের মত সবকিছুই অবশেষে পূর্ণচক্রে রূপান্তরিত হয়, যেন সিসিফাসের উপরে তোলা পাথরের মত সর্বদা একই বিন্দু হতে শুরু হয়। উৎসবমূখর পরিবেশের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন আল-সায়্যাব হতাশামুক্ত ও শূন্যতাহীন বোধ নিয়ে জন্ম নেন, এখানেই তাঁর শুরু। “পিতৃপুরুষেরা তাদের বংশের মধ্য দিয়ে বেচে থাকে”, আল-সায়্যাবের উক্ত কবিতাটি এই সত্যকে উপলব্ধিতে আনে।    

এবার বাংলা ভাষায় কবিতার ক্ষেত্রে একটি উদাহরণ দেয়া যাক। বাংলা ভাষার অন্যতম আধুনিক কবি শামসুর রাহমানের ‘বন্দী শিবির থেকে’ কবিতায় মিথ প্রয়োগের ধরন স্পষ্ট, যেমনঃ

“তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা,
তোমাকে পাওয়ার জন্যে
আর কতবার ভাসতে হবে রক্তগঙ্গায়?
আর কতবার দেখতে হবে খাণ্ডবদাহন?”

‘খাণ্ডবদাহন’—এই হিন্দু মিথের ব্যবহার মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন জাতীয়তাবাদী চেতনার অন্তর্গত সৌরভ-সুগন্ধির স্মারক হয়ে উঠেছে।

এছাড়াও, মাইকেল মধুসূদন দত্ত থেকে শুরু করে হাল জমানার কবি-সাহিত্যিকগণ তাদের  কবিতায় উল্লেখযোগ্যভাবে মিথের সার্থক ব্যবহার করে চলেছেন।

পরিশেষে বলতে হয় একালের মানুষ শুধু সমকালীন পরিচিতি বহন করে না - মানব সভ্যতার বিভিন্ন শ্রুতি ও স্মৃতি বহন করে। মিথ সেই পরিচিতিরই অংশ। তাই আধুনিক কবিতা ও সাহিত্যে মিথের প্রয়োগ বা ব্যবহার ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। কবি ও সাহিত্যিকগণ মিথকে নিপুণ পারদর্শিতায় কখনো রূপক বা প্রতিরূপক আকারে, কখনো-বা গূঢ় প্রতীকরূপে ব্যবহার করার মাধ্যমে কবিতা ও সাহিত্যে রহস্যমধুর আলো জ্বেলেছেন। আধুনিক বাংলা কবিতা ও সাহিত্যও এর ব্যতিক্রম নয়।

তথ্যসূত্রঃ
  ১) বাংলাপিডিয়া
  ২) প্রবন্ধ - মিথ ও কবিতা - সাজ্জাদ কাদির
  ৩) কবিতায় মিথ ও অন্যান্য প্রসঙ্গ - মাহবুব সাদিক
  ৪) The use of Ancient Myths in Modern Poetry – The Myths of
      Sisyphus as a case study by DR. Nader Masarwah