ভাষার বিকৃতির মহোৎসব চলছে এখন। অনেকেই মনে করছে এটা এক পরিকল্পিত কাজ। এতে এক সময় বাংলা ভাষার মৌলিকত্বই হারিয়ে যাবে। এমনকি বাংলা ভাষাও হারিয়ে যেতে পারে। যেভাবে ইংরেজি শিখছে নতুন প্রজন্ম। এতে এমনিতেই বাংলায় তারা থাকবে দুর্বল, তারপরে এভাবে বিকৃত বাংলার ব্যবহারের কারণে বাংলার বিপুল সাহিত্য ভাণ্ডার তারা আর বুঝবে না। রবীন্দ্র-নজরুল সাহিত্যকে মনে করবে ভিন্ন ভাষার সাহিত্য।
বাংলা ভাষার আজ চরম সংকট চলছে। তথ্য-যোগাযোগ প্রযুক্তি ও মোবাইলের ব্যাপক সম্প্রসারণের কারণে নতুন এক সাংস্কৃতির আবির্ভাব ঘটতে যাচ্ছে। এখন ভাষা হিসেবে ইংরেজির জয়জয়কার। নতুন প্রজন্মের কাছে বাংলার চেয়ে ইংরেজি খুব সহজ ও কার্যকরি হওয়ায় তারা ইংরেজি নির্ভর হয়ে পড়ছে। তা ছাড়া তারা বাংলার নামে যে ভাষা ব্যবহার করছে তা-ও এক অদ্ভুত জগাখিচুরি ভাষা। প্রবীণদের অনেকটা অগোচরেই এ ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে চলেছে। অনেকেই এটা বুঝতে পারছেন না- এ পরিবর্তনটা কত গভীর এবং কোথায় গিয়ে ঠেকবে শেষ পর্যন্ত। ভাষায় ভাঙ্গা-গড়া-পুনর্গঠন চলে সব সময় এবং একটা জীবিত ও গতিশীল ভাষার জন্য এটা আবশ্যক। কিন্তু বাংলা ভাষায় এখন যে পরিবর্তন চলছে তা সম্পূর্ণ উল্টো পথে। অসম্ভব দ্রুত গতিতে অদ্ভুত এক পরিবর্তন হচ্ছে। নতুন এক জগাখিচুরির ভাষা তৈরি হচ্ছে। বাংলা ভাষার অস্তিত্ব নিয়ে দেখা দিয়েছে সংকট। মোবাইল সংস্কৃতির কারণে অত্যন্ত সংগোপনে অসম্ভব দ্রুত গতিতে এ পরিবর্তন হচ্ছে। ভাষা পণ্ডিতদের অনেকটা অগোচরেই এই বিকৃত বিপ্লব বাংলা ভাষায় ঘটে যাচ্ছে। আমার মনে হচ্ছে আমরা কেউ-ই কিছু করতে পারছি না। এখানেই আমার হতাশা.... অনেক দু:খ।
শব্দের বিকৃতি ঘটে বা ভিন্নার্থে রূপ নেয় মূলত শব্দকে ব্যঙ্গার্থে ব্যবহারের মাধ্যমে। নতুন নতুন প্যাকেজ নাটক-সিনেমা ও আরজেদের কাণ্ডকারখানার কারণে বিকৃত শব্দগুলো তরুণ সমাজে জনপ্রিয়তা পাচ্ছে এবং বহুল ব্যবহারের কারণে ব্যাপক ছড়িয়ে পড়ছে। এ ব্যাপারটা রোধ করতে আমাদের সচেতন মহলকে এগিয়ে আসতে হবে, রোধকল্পে উপায় বা পন্থা বের করতে হবে।
মানুষের মুখের ভাষাকে কখনো আটকিয়ে রাখা যাবে না এবং বিভিন্ন জায়গায় বাঁধ দিলে যেভাবে নদী মরে যায়, সেভাবে ভাষাও একদিন মরে যাবে। যেমনি মারা গেছে সংস্কৃত ভাষা। তাই আঞ্চলিক ভাষাকে গুরুত্ব দিতে হবে এবং শুদ্ধ ভাষায় সেখান থেকে শব্দ নিয়ে ভাষাকে সমৃদ্ধ করতে হবে।
আমরা যেন আঞ্চলিক আর শুদ্ধ ভাষাকে মিলিয়ে একাকার করে না ফেলি এবং যত্রতত্র বিদেশি বিশেষ করে ইংরেজি শব্দ ব্যবহার না করি। এসব ব্যবহারেও কিছুটা মাত্রা থাকা দরকার। ক্রিয়াপদ, অব্যয়, বিশেষণ, সর্বনামে যদি বিদেশি শব্দ ব্যবহার করি তাহলে তো সেটা আর বাংলা থাকে না। হ্যাঁ ব্যবহার করা যায় নামপদ বা পরিভাষা। বাংলা প্রতিশব্দ থাকার পরও যদি নামপদ ভিন্ন দেশি শব্দ ব্যবহার করা হয়, তা কিছুটা মানা যায়। কিন্তু এখন এমন অপপ্রয়োগ হচ্ছে ক্রিয়া থেকে শুরু করে প্রায় সব শব্দই ইংরেজি, মাঝে মাঝে কিছু বাংলার মিশেল যেন ফিরনির মধ্যে কিছমিছ, যাতে বাংলা বলা হচ্ছে এটা ধরা যায়। একটি উদাহরণ দেই—
‘হ্যালো ফ্রেন্ডস, কেমন আছ তোমরা? হোপ দিস উইকে তোমরা ম্যানি ম্যানি ফান করেছ, উইথ লটস অফ মিউজিক। অ্যনিওয়ে, এখন তোমাদের সাথে আছি কুল ফ্রেন্ড জারা অ্যান্ড আছে জোশ সব মিউজিক ট্রাক অ্যান্ড লটস আড্ডা, সো ফ্রেন্ডস ঝটপট জয়েন করে ফেলো আমাদের আড্ডায় এন্ড ফেবারিট গান শুনতে মোবাইলের ম্যাসেজ অপশনে গিয়ে লিখো ।’
এটা একটা বেসরকারি রেডিও-এর এক আরজে (রেডিও জকি)-এর ঘোষণা। এ ধরনের কথাবার্তা না কি আধুনিকতা, এতে না কি স্মার্টনেস (এই যে আমি স্মার্টনেস ব্যবহার করছি, এটার আসলে সুন্দর বাংলা নেই, এ ধরনের ব্যবহার আমার মতে দুষণীয় নয়) প্রকাশ পায়। ভাষার বিকৃতির জন্য এ ধরনের মানসিকতাই যথেষ্ট, যা আশংকা ও আতঙ্কের ব্যাপার।
যে বিদেশি শব্দ বাংলায় সাবলীল এবং সুন্দর শুনায় সেটা রাখার পক্ষপাতি আমি। এমনকি নামপদে বিদেশি শব্দ ব্যবহারকে আমি অতটা খারাপ মনে করি না। একটা শব্দের অনেকগুলো প্রতিশব্দ থাকতে পারে, এতে ভাষা সমৃদ্ধ হয়। এজন্য শব্দ তৈরি এবং গ্রহণ দুটোই চলতে পারে। বেশি প্রতিশব্দ থাকলে সাহিত্য রচনা সুন্দর, গভীর এবং তাৎপর্যপূর্ণ হয়। এক্ষেত্রে আমরা যত উদার হবো আমাদের ভাষার ততই শ্রী বৃদ্ধি ঘটবে। তবে এসব ক্ষেত্রে নিয়ম-নীতি থাকতে হবে, শৃঙ্খলার মধ্যে হতে হবে।
সৈয়দ আলী আহসানের লেখায় জেনেছিলাম, ঢাকাইয়া ভাষা এবং ঢাকাইয়া গোষ্ঠি হলো পৃথিবীর সবচেয়ে রসিক ভাষা ও জাতি। ঢাকাইয়াদের সাধারণ কথার মধ্যেই দারুণ রস বোধ। এমনকি তাদের নীতিকথার মধ্যেও রসিকতার ছড়াছড়ি। আজ এ আঞ্চলিক ভাষা বিলুপ্তির পথে।
আমি আঞ্চলিক ভাষা বা উপভাষার বিপক্ষে নই। এ ভাষাগুলোও আমাদের ঐতিহ্য। এদেরকে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করতে হবে। তবে এক অঞ্চলের লোকের সাথে আরেক অঞ্চলের যোগযোগের জন্য প্রমিত ভাষার প্রয়োজন হয়। এই প্রমিত ভাষাটাই শুদ্ধ ভাষা। এ ভাষাটা হয় সবার জন্য বোধগম্য। এ ভাষার অবশ্যই একটা মানদন্ড থাকতে হবে। আমরা মূলত এ বিষয়েই কথা বলছি। এ ভাষা বিকৃত করা যাবে না। আঞ্চলিক ভাষা, বিকৃত উচ্চারণ ও যত্র-তত্র বিদেশি শব্দ ঢুকিয়ে এ ভাষাকে জগাখিচুরি ভাষয়ে রূপান্তর করা যাবে না। বর্তমানে এ জিনিসটা হচ্ছে ব্যাপকহারে, যা আমাদেরকে ভীষণ চিন্তিত করছে, পীড়া দিচ্ছে প্রতিনিয়ত।