মুখের ভাষা আর লিখিত ভাষার মধ্যে তফাৎ পৃথিবীর সব ভাষাতেই আছে। সব সময় বানান উচ্চারণ অনুযায়ী নাও হতে পারে, এ ব্যাপারটা মেনে নিতে হবে।
বিখ্যাত সাহিত্যিক দ্বিজেন্দ্রলালের ছেলে দীলিপ কুমার রায়ের একটা ঘটনা লেখছি। তিনি ক্যামব্রিজে অ্যাকাউনটিং পড়তে এসেছিলেন, পরে পালিয়ে রবীন্দ্রনাথের কাছে আশ্রয় নিয়েছিলেন। দীলিপ কুমার বহু ভাষাতে বুৎপত্তি লাভ করেছিলেন। সেই দীলিপ বাবু একবার এক চিঠিতে হৃদরোগকে লিখেছিলেন, ‘রিদ্রোগ’। অনেক হাসাহাসির পর তিনি বলেছিলেন, আমরাতো এভাবেই উচ্চারণ করি।
একজন বাড়িতে যে পোশাক পরে থাকেন, সজ্জন সভাতে তো ওই পোশাকে যেতে পারেন না। ভাষার ক্ষেত্রে মৌখিক আর লিখিত ভাষার ব্যাপারটিও সেরকম। যা ছাপার অক্ষরে বেরোচ্ছে, যারা পড়বে হয় সমালোচনা করবে অথবা শিখবে।
এ জন্য লেখার ভাষাটা একটা নিয়মনীতির মধ্যে হওয়া চাই, যে যেমন উচ্চারণ করছে, সেভাবে লেখলেই চলবে না। ভাষা আন্দোলনর জনক এবং বাংলা একাডেমির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা প্রিন্সিপ্যাল আবুল কাসেম উচ্চারণ অনুযায়ী 'রিদ্রোগ'-এর মত অনেক বানানই প্রচলন করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তা হালে পানি পায় নি। যেমন তিনি 'বিজ্ঞান'-কে বিগ্যান লেখতেন। এমন অনেক শব্দেরই তার নিজস্ব বানান ছিল। এ জন্য কোন কিছু করতে হলে তা সব মহলে গ্রহণযোগ্য করেই করতে হবে।
অনেকেই মনে করেন, একই শব্দের বিভিন্ন বানান থাকলে ভাষা সমৃদ্ধ হয়। আসলে একই শব্দের বানান বিভিন্ন হলে ভাষা সমৃদ্ধ হয় না। বরং নতুন নতুন শব্দ আমদানি বা তৈরি করলে ভাষা সমৃদ্ধ হয়। যেমন, বৃটিশ ইংরেজি এবং আমেরিকান ইংরেজির প্রভেদ সুস্পষ্ট। তাদের অল্প কিছু শব্দের বানানে ভিন্নতা আছে। যিনি বৃটিশ ইংরেজি ব্যবহার করেন, তিনি পারতপক্ষে আমেরিকান বানান ব্যবহার করেন না। আমাদেরও বাংলা এমন সুনির্দিষ্ট ভাগে বিভক্ত হতে পারে। হতে পারে কোলকাতার বাংলা, ঢাকার বাংলা। কিন্তু এমন হওয়া কাঙ্খিত নয় যে, প্রত্যেক লেখকের, প্রত্যেক পত্রিকার, প্রত্যেক সংস্থার পাণ্ডিত্ব জাহিরের জন্য নিজস্ব বানানের সমাহার। এতে করে নতুন প্রজন্ম বিভ্রান্ত হবে, সংশয়ে পড়বে। বাংলা ভাষাকে বাঁচাতে হলে সবাইকে এক ছাতার নিচে আসতেই হবে।
কথ্য ভাষা আর সাহিত্যের ভাষা বলে একটা কথা প্রচলিত আছে। কথ্যভাষা হলো গণমানুষের ভাষা। সংলাপে অনেক কথ্য ভাষার ব্যবহার দেখা যায়, যা গ্রহণযোগ্য। সেটাও একটা ভাষা। কথ্য ভাষা দিয়ে সাধারণ বর্ণনা দেয়া হয় না। শুদ্ধ ভাষায় আমরা কথ্য শব্দ ব্যবহার করতে পারি। এ জন্যই আঞ্চলিক ভাষার অভিধান লেখা হয়েছিল। যাতে বাংলা ভাষার শব্দ ভাণ্ডার বেড়ে যায়। তবে সব শব্দেরই একটা নির্দিষ্ট বানান থাকতে হবে।
শব্দের উচ্চারণ কিন্তু পরিবর্তনশীল এবং অঞ্চলভেদে বিভিন্ন রকম। এক অঞ্চলের উচ্চারণকে মানদণ্ড ধরে বানানের প্রমিতরূপ দান করলে সেটা যদি সার্বজনীন হয়, তার উপর ভিত্তি করে ভাষা দাঁড়িয়ে যায়। তারপর উচ্চারণ বার বার পরিবর্তন হলেও বানান কিন্তু পরিবর্তন হয় না। উচ্চারণ পরিবর্তন হওয়াটাই স্বাভাবিক। বার বার যদি উচ্চারণ অনুযায়ী বানান পরিবর্তন হয় তাহলে ভাষা ও সাহিত্য যে কালের সংযোজনী তা হারিয়ে যাবে। ইংরেজির কথা আবারো বলতে হচ্ছে। গত একশত বছরের ইংরেজির উচ্চারণ প্রায় তিনটি ধারায় বিভক্ত হয়েছে, কিন্তু বানান অপরিবর্তিত থেকেছে সবসময়। তাই আমরা বাংলা বানানের সার্বজনীন প্রমিত রূপ দিতে পারলে আর বানান পরিবর্তন নিয়ে মাথা ঘামানো লাগবে না। তখনই বাংলা ভাষা একটি চিরন্তন রূপ লাভ করবে।