‘প্রেম’ বিষয়ে প্রত্যেকেই অহংকারী । সবাই তার জীবনের প্রেমের আবেগকে ‘স্পেশাল’ই মনে করে । আমিও এর ব্যতিক্রম না- বরং সবার চেয়ে একটু বেশিই অহংকারী । এই অহংকারের স্বরূপ বুঝাতে একবার বলেছিলাম- “কবিত্ব আমার কাছে প্রেমের মত,প্রকৃতির মত । প্রতিটি সুন্দর শব্দের গভীরে আমার ‘একান্ত সৌন্দর্যবোধ’ রয়েছে, যা মৌলিকতায় শুদ্ধতম । সামাজিক শব্দের ভিড়ে সেসব বোধকে আমি ছোট করতে চাই না” ।
যাই হোক- প্রেম মূলত তিন প্রকার- স্বর্গীয়, পার্থিব এবং মানবীয় । প্রতিটি মানুষের মাঝে তিনটি সত্ত্বাই কম-বেশি থাকে বলে কেউ প্রেমে পড়লে আসলে সে নিজেকেই ঠিক বুঝে উঠতে পারে না । অথচ মনস্তাত্ত্বিকেরা আধুনিকতম মতবাদ “ট্রায়াঙ্গল থিওরি অব লাভ”এর মাধ্যমে প্রেম কী তা স্পষ্ট ভাবেই বলে দিয়েছেন । মানব মানবীর সম্পর্কের মাঝে – ইন্টিমেসি, পেসন আর কমিটমেনট এই তিনখানি উপাদান যদি পুরোপুরি উপস্থিত থাকে তবে তা ‘প্রেম ; আর যা কিছু সমাজে দৃষ্টিগোচর হয়- সেসব প্রেমের নামে ভাওতাবাজি । তাই প্রচলিত সময়কে বুঝে কেউই প্রথাগত প্রেমিক হতে পারে না বলেই আমার বিশ্বাস । তবু প্রেমকে নির্দিষ্ট ছকে ফেলে দেয়াও যৌক্তিক নয়- সেটাও নিজেকে জেনেই বুঝেছি । কবিতা যদিও ব্যাখ্যাতীত বিষয়, তবু “প্রেমিক ছিলাম মিথ্যে কথা” কবিতাটির ব্যাখ্যায় ‘প্রেম’কেই সবার জন্য বোধগম্য করে তোলার চেষ্টা থাকলো । ব্যতিক্রমী ‘ঐতিহাসিক উপমা’ ব্যবহারের করেছি ‘নিজের প্রেম’কে উৎকৃষ্টতম প্রমাণের ইচ্ছে থেকেই !

***
"আশা ছিল আসবে তুমি- ভালবেসেই আসবে তুমি
আটকা পড়া খালের জলও বর্ষা এলে নদে ফিরে
এতকালের আশা ছিল- একটিবারও মুখ ফেরো নি;
আত্মঘাতী স্মৃতির ঝড়ে নূহের তরী সবাই পেলো
বানের সময় বিভেদ ভুলে সব মানুষে ঘর বানালো
স্মরণকালের প্লাবন গেল- তুমিই শুধু ফের আসো নি ।
প্রেমিক ছিলাম মিথ্যে কথা- আমি কোন প্রেম করি নি ।"

কবির 'অপূর্ণ প্রত্যাশা’র কথা ব্যক্ত হয়েছে, যে প্রত্যাশা কেবলই ‘ভালবাসা’র খুঁজে। ২য় লাইনের - “আটকা পড়া খালের জলও বর্ষা এলে নদে ফিরে”; উপমাটি বিশেষ লক্ষণীয় অর্থাৎ শীতের শুষ্ক তীব্রতা বা চৈত্রের খরার সাথে যুদ্ধ করে যেভাবে কিছু জল পুনরায় স্বতঃস্ফূর্ত স্রোতের সাথে মিশে যায়, কবির প্রতীক্ষাটিও প্রেমময় জীবনে ফিরে যাওয়ার তরে তেমনি দীর্ঘকালের ছিল । এমনকি এই প্রত্যাশা মনগড়া ছিল না, বরং প্রত্যাশার যৌক্তিকতা বুঝাতে কবি ‘নূহের তরী’ আর ‘স্মৃতির ঝড়’ উপমা দুটি ব্যবহার করেছেন এই জন্য যে, এমন দুঃসময়ে ‘আটকা পড়া জল’ শুধু মিশে যাবে তা নয়, বরং জীবনের স্রোতে ভাল থাকার জন্য ‘একত্র’ হওয়াও ছিল আবশ্যক । যেমন গ্রামের ঘরে ঘরে ঝগড়া-বিবাদ লেগে থাকলেও বড় কোন বিপর্যয়ে সকলেই বৃহত্তর স্বার্থে একত্র হয়, কবির সাথে তার প্রিয়ার একত্র হওয়ার ক্ষেত্রে ‘দুঃসময়’টিও এত বৃহৎ ছিল যে তা প্রায় ১লাখ বছর আগের বরফ যুগের সাথেই কেবল তুলনীয় ।

***
"ভালোবাসা না-জাগালে ভালোবাসা যায় না বলে-
বারংবারই তোমার পথে দাঁড়িয়েছিলাম গোলাপ হাতে
প্রেমিক হলে পাপড়ি ছিঁড়ে পথের উপর বাসর হত
দ্বিধায়-ঘৃণায়-প্রত্যাখ্যানে কণ্টকিত যুদ্ধ হত
আমার ভয়ে তখন তুমি সময় প্রেমের অতল পুঁজে-
জীবনটাকে কঠিন ভেবে কীটের মতই মুখ লুকাতে;
একে একে দুই না ভেবে তোমার কথায় তিন মেনেছি
ভালবাসার অন্য নামে অমর প্রেমের বিষ খেয়েছি ।
প্রেমিক ছিলাম মিথ্যে কথা- আমি কোন প্রেম করি নি ।"

প্রচলিত উৎকৃষ্ট প্রেম- ‘ভালবাসা বিনিময়ে শুধুই ভালবাসা চায়’, কবি সেই আবেগকেও ছাপিয়ে গেছেন । 'ভালোবাসা না-জাগালে ভালোবাসা যায় না বলে’ এই পংতিটির মাঝে কবি মূলত ‘চাওয়ার’ চেয়ে ‘দেয়ার’ ইচ্ছেকেই প্রাধান্য দিয়েছেন, ‘চাওয়ার’ বিষয়টি নেহাত ‘দিতে পারার’ জন্যই প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি । সেক্ষেত্রে ‘গোলাপ’ উপমাটি স্নিগ্ধ-স্বচ্ছ-সুন্দরের প্রতীক বলেই কবি এসব অনুশীলনের মাঝ দিয়ে ভালবাসতে পারার যোগ্যতা অর্জনের চেষ্টা করেছেন । এই চেষ্টাটি তাঁর কাছে এতই ‘শুদ্ধতম’ যে, প্রাপ্তির ক্ষেত্রে অন্য পন্থাকে তিনি জেনেশুনেই অগ্রাহ্য করেছেন । পুরুষতান্ত্রিক সমাজের প্রতিনিধি হওয়া সত্ত্বেও তিনি ‘গোলাপ’ তথা সৌন্দর্যকে নষ্ট করে বিয়ে-পরিণতির প্রথাগত চেষ্টা করেন নি । অন্যভাবে কবির ‘অমর প্রেম’ও প্রচলিত ‘অমর প্রেমের’ মত ভাবাবেগের নয় ।

***
"প্রেমিক মানে ধরতে পারে ছাড়তে পারে
কথায় কথায় মরতে পারে
শ্মশাতঘাটে পুড়তে গিয়ে- নারীর প্রেমে নড়তে পারে
প্রেমিক মানে ভেঙে ভেঙে সংসারেতে গড়তে পারে
জগতসুখে পথের উপর স্বার্থপ্রেমে লড়তে পারে,
আমি কেবল ভালোবেসে তোমার কাছে হারতে পারি,
ফরহাদের-ই শিরি তুমি- তোমার তরে জিউস খুঁজি
ভালোবেসে রাবণ সেজে রামের নামই পুড়িয়ে ফেলি
সবারমত স্বার্থসুখে তোমার দিকে চোখ তুলি নি ।
প্রেমিক ছিলাম মিথ্যে কথা- আমি কোন প্রেম করি নি ।"

প্রচলিত প্রেমের মাঝে মান-অভিমান, চাওয়া-পাওয়াই মুখ্য; কবির দৃষ্টিতে এসবের মূলে রয়েছে ‘স্বার্থ প্রেম’ তথা ব্যক্তিস্বার্থই । তাই ‘ভালবাসে হারতে পারি’ কথাটির মাঝে ‘স্বার্থত্যাগ’ বিষয়টিই প্রাধান্য পেয়েছে । এই স্বার্থ ত্যাগের স্বরূপ কেমন তা বুঝাতে শেষের লাইনগুলো বিশেষ উল্লেখযোগ্য । কবি ‘ফরহাদ-শিরি’ উপমাটি দিয়ে নিজেকে আর তাঁর প্রিয়াকে বুঝিয়েই ক্ষান্ত হন নি, শিরি-র সাথে ফরহাদ নামটি যুতসই হওয়া সত্ত্বেও তিনি অধিকতর ক্ষমতাশালী ‘জিউস’কে খুঁজার চেষ্টা করেছেন তাঁর প্রিয়ার জন্য ।

***
"অন্য গ্রহের ভালোবাসা প্রেমের নামে আঁকড়ে ধরে
সূর্যমুখী তোমার দিকে তাকিয়েছিলাম মেঘের চোখে,
প্রেমিক হলে প্রেমের ছলে হিসেব কষে সুদ বসাতাম
প্রেম শেখাতাম, লোক হাসাতাম- লোকান্তরের চেষ্টা চালে;
হিরোশিমার বোম ফেলেছ স্বপ্নবুকের তুর পাহাড়ে
মুসার মত মৌল লাঠি ভুল ঠেকানোয় কাজ করে নি
ফেরাউনের খাস মহলে সুখেই থেকো আফ্রোদিতি !
প্রেমিক ছিলাম মিথ্যে কথা- আমি কোন প্রেম করি নি ।

কবি তাঁর প্রিয়ার দৃষ্টিভঙ্গিকে ‘সূর্যমুখী’ বলেছেন এই জন্য যে, সমাজের সবার মত তাঁর প্রিয়ার ভালোবাসার উপলদ্ধিও পূর্ণ হওয়া সম্ভব কেবলমাত্র ক্ষমতা–প্রতিষ্ঠার সুখস্বপ্ন পূরণ হওয়ার মধ্য দিয়েই । অথচ কবি এই শর্তযুক্ত ভালোবাসাকে ভুল বলে জানেন, তিনি তাঁর দৃষ্টিভঙ্গিকে সংজ্ঞায়িত করা কারো পক্ষে সম্ভব নয় বলেই ‘অন্য গ্রহ’ উপমাটি ব্যবহার করেছেন । তবে সেই দৃষ্টিভঙ্গি কেমন সেটি বুঝাতে ‘মেঘের চোখে’ উপমাটির উপস্থাপন করেছেন দুইভাবে – এক, তিনি প্রথাগত ‘সূর্যমুখী’ তথা ‘প্রাপ্তি কেন্দ্রিক’ সমাজের বিপরীতে; দুই- তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি ‘মেঘ’ তথা দুঃখ-কষ্টের মতই তীব্র উপলদ্ধির বা বোধসম্পন্ন । এই বোধটিকে বুঝাতে মুসা নবীর আলোকপ্রাপ্তিস্থল ‘তুর পাহাড়’ আর তাঁর মোজেজা ‘লাঠি’ কে উপমা হিসেবে কবি ব্যবহার করেছেন । কারণ তাঁর বোধটি ‘মৌলিক’ এবং তাঁর ভালবাসার চেষ্টাগুলো ছিল ‘শুদ্ধতম’ । কিন্তু তিনি তাঁর প্রিয়াকে বুঝাতে ব্যর্থ হলেও তাঁকে গ্রিক উপাখ্যানের প্রেমের দেবী ‘আফ্রোদিতি’র সাথেই তুলনা করেছেন, যা তাঁর চূড়ান্ত ভালবাসারই প্রকাশ । কবি যতই ‘জিউস’কে তাঁর প্রিয়ার জন্য প্রত্যাশা করেন না কেন, কিন্তু তিনি এটুকু জানেন যে, বর্তমানের শ্রেষ্ঠ প্রেমিকও মূলত ‘ফেরাউন’ ব্যতীত আর কিছু নয় ।

***
"এখন তুমি ফ্যানি ব্রাউন- নিরন্ত এক মোনালিসা
তোমার তরে ভিঞ্চি হয়েই কবির মত শিল্পে বাঁচা
জানি আমার স্বপ্নগুলো অন্য কারো মতন নয়
এমন প্রেমের ব্যাখ্যা দিতে রবীন্দ্রনাথ ব্যর্থ হয়,
অন্ধ প্রেমের দ্বন্দ্ব তবু মাথার ভিতর একটু নেই
সক্রেটিসের বোধের প্রেমে সূত্র লিখে নিউটনেই;
যতই আমি যিশুর মত অবিশ্বাসের ক্রুশেই গাঁথি-
খুব নীরবেই হলাম তবু ভুল সময়ের গানের পাখি ।
প্রেমিক ছিলাম মিথ্যে কথা- আমি কোন প্রেম করি নি
প্রেমিক ছিলাম মিথ্যে কথা- আমি কোন প্রেম করি নি ।"

কবির শৈল্পিক শূন্যতা পংতিগুলোর মাঝে স্পষ্টতই ধরা পড়ে । তাঁর এই শূন্যতা বা ‘প্রেমবোধ’ সময়কে অতিক্রম করে আরও বিশেষ কিছু । এর জন্য কবি রোমান্টিসিজম যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিল্পী রবীন্দ্রনাথকেও তাঁর আবেগ বুঝায় ব্যর্থ হওয়ার কথা উপমা হিসেবে উল্লেখ করেছেন । কিন্তু সেই আবেগ ভাবাবেগ বলে তিনি মানতে নারাজ । কবি তাঁর ‘প্রেমানুভুতি’ বুঝাতে তাই একই সাথে সক্রেটিসীয় ‘বোধ’ আর নিউতনীয় সূত্র তথা ‘বিজ্ঞান্মনস্কতা’র বিষয়টিও উল্লেখ করেছেন । শেষ দুই লাইনে বুঝা যায় যে, প্রিয়ার অবুঝ মনোভাব যতই তাঁকে চূড়ান্ত আহত করুক না কেন, তবু তিনি তাঁর মৌলতম অনুভূতিকে তবু ধরে রেখেছেন জীবনের শৈল্পিক সৌন্দর্য আস্বাদনেই ।

মাহবুব শাকী
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়