আদিম মানুষের উচ্চারিত ধ্বনি থেকেই মানব ইতিহাসের মনস্তাত্ত্বিক বিকাশ শুরু হয় । মেঘের ডাক, পশুর গর্জন – এসব ধ্বনি মানুষ জন্মানোর বহু আগে থেকেই আকাশে-বাতাসে ছড়িয়েছে । এই প্রকৃতি বা প্রাণীকুল-ই আদিম মানুষের ভাষাশিক্ষার প্রাথমিক শিক্ষাগুরু । হয়ত মানুষ দেখল কোন বানর তার সঙ্গীকে একধরণের শব্দ সৃষ্টি করে কাছে আনতে পারে । হয়ত কেউ শিকার থেকে ফিরে তার সজ্ঞীদেরকে প্রাকৃতিক গোলযোগের কথা বুঝাতে গেল । এভাবেই ভাব আদান-প্রদানের নিমিত্তে ভয়-বিস্ময় প্রকাশক ধ্বনিই মানুষের মুখে সর্বপ্রথম উচ্চারিত হয়েছিল । বিপদসঙ্কুল জঙ্গলে মানুষের পক্ষে একা একা টিকে থাকা সম্ভব ছিল না; তাই তারা সংঘবদ্ধ হয়ে শিকারে যেত । শিকারের প্রয়োজনেই এরপর তারা শিখে নির্দেশনা মূলক শব্দ । গোত্র ভিত্তিক পশু শিকারের মধ্যদিয়েই তারা শিখেছিল অনুকরণমুলক শব্দ । শনশন, শোঁশোঁ, গুড়গুড়, টপটপ – প্রাকৃতিক এইসব অনুকার শব্দগুলো পৃথিবীর প্রত্যেকটি ভাষায় আজো প্রায় অপরিবর্তিত রয়ে গেছে । পারস্পারিক কাজ চালানোর জন্য অনুকার শব্দ কতটা আশীর্বাদ তা বিদেশে পোড়খাওয়া লোকেরা ভালই জানে ! ধরুন আপনি চীনা রেস্টুরেন্টে বসে কোন বাংলা খাবারের অর্ডার দিতে গিয়ে বললেন ‘প্যাঁক প্যাঁক’ । হয়ত সেটি নেই; তাই প্রত্যুতরে ‘ভেউ ভেউ’ বললে খাবেন কিনা সেটা আপনার ব্যাপার; তবে বুঝতে সমস্যা হওয়ার কথা নয় !
আদিম মানুষেরা বিভিন্ন পরিচয় বচক শব্দ আয়ত্ত করলেও নামবাচক শব্দ যেমন- ‘মানুষ’ অর্থে সামগ্রিক মানুষ বুঝাতে কেটে গেছে দীর্ঘ সময় । অস্ট্রেলিয়ান আদিবাসীদের মাঝে কুকুরের লেজ, গরুর লেজের আলাদা আলাদা নাম থাকলেও ‘লেজ’ বলতে কিছু নেই । ব্যতিক্রমও আছে; আজো অনেক আদিবাসীদের ক্ষেত্রে রঙিন বস্তু থেকে আলাদা আলাদা রঙের নামকরণ হয় নি; অর্থাৎ লাল-নীল-হলুদ বলতে কিছু নেই, সবই তাদের রঙ্গিন ! এই যুগে এসেও বিভিন্ন শব্দের ঘাটতি কম-বেশি সকল ভাষায়ই আছে । ইংরেজিতে নাকি অভিমান শব্দটি নেই ! তার মানে ইংরেজরা অভিমান করে না ! ওরা যা বলে- লিভ মি এলউন; ভাবগত অর্থে এটিকেই সত্যরূপ মনে করি; অন্তত অভিমানে কাদা ছুড়াছুড়ি নেই ! যা বলছিলাম, এই নামবাচক শব্দ আবিষ্কারের ফলেই চিন্তার বিকাশ ত্বরান্বিত হয়েছে । এরই ধারাবাহিকতায় ‘বিমূর্ত শব্দ’ আবিষ্কারে আসে বৈপ্লবিক পরিবর্তন । তবে সব গোত্রের মাঝে ভাষার বিকাশ সমহারে ছিল না; কিছু গোত্রের মাঝে ইঙ্গিতে ভাব-আদান প্রদানের রীতি এত প্রকট ছিল যে তারা ভাষাসৃষ্টির তেমন গুরুত্ব দেয় নি । আরাপোহাস গোত্রের মানুষদের মাঝে অন্ধকারে ভাব আদান-প্রদান করা ছিল প্রায় অসম্ভব ।
ভাষা আবিষ্কারের জন্যই পরিবার ভিত্তিক ‘শিক্ষা’র শুরু এবং প্রসার ঘটে । পিতা-মাতাই ছিল সন্তানের প্রথম প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষক । তবে মননের বিষয়টি ছিল না, সাহস আর দৃঢ়তা গঠনের মাঝেই তা ছিল সীমাবদ্ধ । দশ বছর বয়সের মধ্যেই সন্তান পিতার প্রায় সবধরণের শিক্ষা আয়ত্ত করে ফেলত । আজো চীনা শিশুরা দেশীয় ঐতিহ্য জানার আগে পারিবারিক ঐতিহ্য সম্পর্কে জানে । অনেকাংশে ২৮তম পূর্বপুরুষ পর্যন্ত তারা অবগত থাকে । আদিম সমাজে সন্তানকে শিক্ষা দেবার ক্ষেত্রে পিতা মূলত প্রাকৃতিক নির্বাচনকেই বেছে নিত । ‘কাফির’ গোত্রে একটি প্রথা ছিল এমন- যে শিশু বিয়ে করতে চাইত তাকে সারাদিন কঠিন কঠিন কাজ দেয়া হত । রাতে নিদ্রাহীন থাকার পর সকালে চাবুক মেরে রক্তক্ষরণ ঘটানো হত । এই প্রক্রিয়ায় পাশ করলে তাকে বিয়ের উপযুক্ত মনে করা হত । কিছু গোত্রে বিয়ের সময় পাত্রীকে সামনে রেখে পাত্রের খৎনা করার রীতি ছিল । যদি চিৎকার করত তবে বিয়ের জন্য উপযুক্ত নয় বলে ধরা হত । প্রকৃতির মাঝে অভিযোজনের ক্ষমতা বাড়ানোই ছিল ‘শিক্ষার’ প্রথম উদ্দেশ্য । অর্থাৎ আদিম শব্দ-ভাষা বা শিক্ষার উদ্দেশ্য ছিল শুধুই দৈনন্দিন প্রয়োজনের তাগিদেই ।
দীর্ঘ সময় পাড়ি দেবার পর লিখা আবিষ্কার ছিল বৈপ্লবিক ঘটনা । লিখাই আধুনিকতার সূতিকাগার হিসেবে চিহ্নিত । তবে অনেক গোত্রে তা সহজভাবে নেয়া হয় নি । মিশরে একটি লোককাহিনী প্রচলিত আছে । দেবতা যখন রাজা থেউসকে লিখা আবিষ্কারের কথা বললেন, তিনি একে সভ্যতার শত্রু আখ্যা দিয়ে প্রতিবাদে বললেন- ‘যাদের প্রতিদিন শিখতে আর মুখস্ত করতে বলা হত, তারা এখন থেকে সে অভ্যাস ছেড়ে দিবে, স্মৃতিশক্তি ব্যবহারে অযত্ন করবে’ । এখনো উত্তর আফ্রিকার কিছু গোত্র লিখতে পারে না বলে তাদের স্মৃতিশক্তি তুখোড় ! আদিম মানুষের গুহাচিত্রের সংক্ষিপ্তরূপ থেকেই লিখার উৎপত্তি । পরপর কিছু চিত্রাংশকে সাজিয়ে লিখার সূত্রপাত । গণনার প্রয়োজনেই তার উৎপত্তি । চীনের বর্ণমালা ‘কু-ওয়ান’ নামে পরিচিত যার আক্ষরিক অর্থ ‘চিত্রের মাধ্যমে বানী’ । টোটেম খোদাই করা লিখাও মূলত ‘পিক্টোগ্রাফ’ । পরবর্তীতে ক্যারোলিন দ্বীপের ‘ক্রিপ্ট’ বা ইস্টার দ্বীপের ‘হায়ারোগ্লিফিক’ লিখায় নতুন মাত্রা নিয়ে আসে । লিখাকে তখন পবিত্র বিষয় মনে করা হত ।
বহু পূর্বে আদিম মানুষেরা প্রকৃতির ছন্দময়তা দেখে ছন্দের প্রাথমিক আবিষ্কার করলেও সাহিত্যকর্মের সূচনা লিখা আবিষ্কৃত হবার মধ্য দিয়েই । সাহিত্যের যাত্রা শুরু হয় ‘পুরোহিত’দের হাত ধরে । যাদুমন্ত্র-শ্লোক-ঐশ্বরিক বাণী-ই ছিল সাহিত্যের আদি উপকরণ । যাদুমন্ত্রের ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য ছন্দের ব্যবহার বাড়তে থাকে । গ্রীক-রোমানদের প্রাচীন সব লিখাই তাই যাদুমন্ত্র । রাজাদের আবির্ভাবে মৌখিক ঐতিহ্য আর লোকসঙ্গীত রচিত হতে শুরু করে । ক্রমে পুরোহিত থেকে জন্ম নেন কবি । কবির কাজ ছিল রাজার মাহাত্ত্য প্রচার করা আর ধর্মীয় সংগীত শুনানো । রাজ্য শাসনের প্রয়োজনেই ইতিহাসবিদ হয়ে উঠেন রাজার প্রথম মুখপাত্র । সেই সাথে বক্তাদেরও উৎপত্তি হয় । তারা বিভিন্ন জায়গায় রাজার প্রতিনিধি হিসেবে বীরত্ব প্রচার করতেন, যুদ্ধের জন্য সৈন্য বাড়ানোই ছিল তাদের উদ্দেশ্য ।
জয়নুল আবেদীন ফ্রান্সের রেস্টুরেন্টে ছবি এঁকে হয়ত কাজ চালিয়েছিলেন, তবু এতে ভাবের আদান-প্রদান সত্যিকারের উৎকর্ষতা পায় না । নতুন শব্দের উৎপত্তি আর ভাষাসমূহের পারস্পারিক মিলনের কারণেই চিন্তার প্রখরতা বাড়তে থাকে । পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে বিভিন্ন ভাষা সৃষ্টি হয়েছিল আদিম মানুষের প্রয়োজনে । সবথেকে অবাক করা বিষয় হল যে জাতি শব্দের ব্যবহার করেছে বেশি সে জাতিই দ্রুত উন্নতি করেছে । মূলত ধ্বনি থেকে বর্ণ আবিষ্কারের ইতিহাসটিই মানবসভ্যতার মননে সর্বাধিক উৎকর্ষ নিয়ে এসেছে । অতঃপর সাহিত্য চর্চার ক্রম উন্নতির মাধ্যমে বর্তমান শিল্পকলার আবির্ভাব ।
মাহবুব শাকী
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়