মৌসুমি ভৌমিক এর নাম না জানলেও তার 'আমি শুনেছি সেদিন তুমি'- গানটি অনেকেই শুনেছেন। কয়েক বছর আগে ধানমণ্ডির একটি রেস্টুরেন্টে তাঁর দীর্ঘ চল্লিশ মিনিটের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম। আমার সাথে ছিলেন অভিনেত্রী তাজিন আহমেদ । এই সাক্ষাৎকারের কিছু প্রশ্ন নিজ হাতে লিখে দিয়েছিলেন কিংবদন্তি চলচ্চিত্র নির্মাতা প্রয়াত তারেক মাসুদ। জানতাম মৌসুমি ভৌমিক বড় মাপের শিল্পী কিন্তু গুণীজনের কাছেও এতটা সম্মানিত তিনি - সেটা হয়ত এই আয়োজনের ভারিত্ব না দেখলে বুঝতামই না।
মানুষের ব্যক্তিত্ব তার স্বপ্নের গভীরতায় আর দায়বদ্ধতায় ফোটে উঠে। আর এ-স্বপ্ন যদি ব্যক্তি সত্ত্বাকে ছাড়িয়ে সবার স্বপ্ন হয়ে উঠে তবেই তিনি শিল্পী- তাই নয় কি? সাদাসিধে পোশাকে যে মৌসুমি ভৌমিক-কে দেখেছিলাম - আজও আমি বিশ্বাস করি একজন শিল্পীর এমনই হওয়া উচিত। কলকাতার লেখক-গায়কদের মাঝে সে শিল্পবোধ কিছুূটা রয়েছে। কিন্তু আমাদের দেশে এমন লেখক-গায়ক-মিউজিসিয়ান ক'জন আছেন? এদেশের অধিকাংশ শিল্পীরাই বোধের চেয়ে ভাবেই থাকেন বেশি; এখানে পাঞ্জাবি-ঝোলা ব্যাগ না থাকলে কবি হওয়া যায় না; লম্বা চুল না রাখলে কণ্ঠ দিয়ে গান বের হয় না। জনপ্রিয়তা আর পোশাকি শিল্পের দিকে আমাদের শিল্পীদের বড় বেশি আকর্ষণ। সবসময় ভারি ভারি কথা বলতে হবে সে কথা বলছি না। এদেশের টিভির এড থেকে শুরু করে নাটক-সিনেমার সংলাপ, কবিতার ভাষা- গল্পের গভীরতা এসবকিছু এত সস্তা কথায় ছেয়ে গেছে যে মৌলিকতা তো নেইই - নুন্যতম মানও কি আদৌ আছে? টিভির এডে -' এবার তোর কি হবে রে প্রতীক', 'তোরা আমারে পানিতে ফালাস না ক্যান', হেই পাপ্স-এবার একটা সেলফি হয়ে যাক'- এমন সংলাপ সত্যিকার অর্থেই মজাদার, আমি এর বিরোধী নই। কিন্তু শ্রোতাদের অনুভুতির গভীরতা যদি এইটুকু চটকদারিতার মাঝে সীমাবদ্ধ থাকে তবে সেটা আতংকিত হওয়ার মত বিষয়। সামাজিক যোগাযোগের সবথেকে বড় মাধ্যম ফেসবুক দেখলে বর্তমান সময়ের চিত্র স্পষ্ট বুঝা যায় । একটি ছবিতে যে পরিমান লাইক-কমেন্ট পড়ে সে তুলনায় একটি ভাল লিখা কেউ পড়েই না, আর লাইক যারা দেয় এর অধিকাংশই না পড়েই দেয়। জন্মদিনের শুভেচ্ছা বার্তাটাও দেয়া হয় অন্যের বার্তা কপি-পেস্ট করে !
এ সবকিছুর দায়ভার তবু লেখক শিল্পীদেরই নিতে হবে। ভাল একটি কৌতুক তৈরির জন্যও প্রকৃত শিল্পী হওয়া দরকার । শ্রেষ্ঠ শিশু সাহিত্য শ্রেষ্ঠ কবি-সাহিত্যিকের হাতেই তৈরি হয়েছে। পাঠক-শ্রোতারা কাদামাটির মত, লেখক-শিল্পীরা যা দিবেন পাঠক-শ্রোতারা তেমনই হবে সেটাই স্বাভাবিক। আমি চাই শিল্পীরা বুঝে নেংটা হোক কিন্তু কিছু না জেনে-বুঝে যেন মঞ্চে উঠে না । পৃষ্ঠপোষকতার দরকার নেই সে কথা আমি বলছি না। লেখক শিল্পীদের কাজই হল স্বাধীনতা সৃষ্টি করা; বরং স্বাধীন পরিবেশ অনেকাংশে শিল্পী সত্ত্বাকে ধ্বংস করে দেয়।
কঠিন শব্দের ব্যবহার আর ভাবের জটিলতা তৈরি করলেই কি শিল্প হয়? আমি জটিলতর সৌন্দর্যের পক্ষপাতী কিন্তু জটিলতার পক্ষে নই। সেই জটিলতর শিল্প সৃষ্টির জন্যে চিন্তার স্পষ্টতার কোন বিকল্প নেই। ভাব তৈরি করলেই বোধের জন্ম হয় না- উল্টো বিভ্রান্তি বাড়ে। জীবন থেকে পালানোর জন্যে শিল্প নয়- জীবনের জন্যেই শিল্প,- একথা কি বুঝেন না দেশিও শিল্পী-পাঠক-শ্রোতারা? বাস্তবতা শিখার বিষয় নয়, বাস্তবতা নিজে থেকেই শিখায়। ক্ষুধা লাগলে ভাত সবাই খাবেই, কিন্তু স্বাস্থ্যসম্মত ভাবে খাওয়া হচ্ছে কিনা, খাবারের পুষ্টিমান ঠিক কিনা এসব হচ্ছে শিল্পের আওতাধীন। তাই বাস্তবে সফল হওয়ার জন্যেই শিল্পবোধ জরুরী।
আবারো বলছি স্বপ্নের স্পষ্টতার বড় অভাব আমাদের শিল্পাঙ্গনে। মহৎ স্বপ্ন স্পষ্টতার মধ্য দিয়েই মহান শিল্প হয়ে উঠে,- সত্যিকারের বোধের জন্ম দেয়। ব্যক্তিগত স্বপ্ন বা জনপ্রিয়তার জন্যে শিল্প কখনও স্বপ্ন-শিল্প নয়- এসব শুধুই দাম্ভিকতা-সংকীর্ণতা। মহান শিল্পীরা হয়ত পাগল ছিলেন কিন্তু পাগলামি করলেই শিল্পী হওয়া যায় না। শিল্পীর মুখোশে তাই পাগলে ছেয়ে গেছে সারা দেশ। ভাল বক্তা হতে গেলে যেমন ভাল শ্রোতা হওয়া আবশ্যক, ভাল শিল্প সৃষ্টির জন্যে ভাল পাঠক হওয়ারও তেমন বিকল্প নেই। আমাদের শিল্মাপীদের মাঝে তাই জ্ঞানের বড় অভাব, এ-কারণে ভাল পাঠক-শ্রোতা তৈরি হচ্ছে না ।
আমি মৌসুমি ভৌমিকের কথা সচেতন ভাবে লিখার শুরুতে এনেছি, যদিও জানি তা আমার বক্তব্যের সাথে অনেকটাই অপ্রাসঙ্গিক। কথা শুনানোর জন্যও আজকাল এমন কৌশল বেশ কার্যকর বলেই প্রমাণিত । নিজেকে জাহির করা নয় - দায়বদ্ধতার বোধ থেকেই এতসব কথা। জনবিমুখী হয়ে শিল্প সৃষ্টি আমার কাছে বিলাসিতা মনে হয়। শিল্প যদি পাঠক-শ্রোতাদের স্বপ্ন দেখাতে না পারে, বোধ-দায়বদ্ধতা তৈরি না করতে পারে তবে সার্বিক কল্যাণ হবে কি করে? শিল্পবোধই শৈল্পিক চেতনার সৃষ্টি করে, সভ্যতার বিকাশ ঘটায়। এর বিপরীতে যে ভয়াবহ পরিণাম তা প্রকৃত শিল্পী মাত্রই ভাল বুঝেন। শিল্পবোধ ছাড়া নিজের মুক্তি নেই- মুক্তি নেই মানুষের ।
...................................................... মাহবুব শাকী
১৬/১১/২০১৪ইং