সোজা বাংলায় নিজের সৃষ্টির উপর স্রষ্টার অধিকার হলো কপিরাইট। ধরে নেওয়া যাক আপনি একজন স্রষ্টা, আপনি সঙ্গীতের সুরমূর্ছনা তৈরি করতে পারেন, আপনি ভাবকে গুছিয়ে কবিতা লিখতে পারেন অথবা আপনি রংতুলি নিয়ে প্রাণের উচ্ছাসকে ক্যানভাসে ধরে রাখতে পারেন। কপিরাইট হলো সেই অধিকার, যার বলে বলীয়ান হয়ে আপনার সংগীত, আপনার লেখা, আপনার আঁকা ছবি অন্য কেউ ব্যবহার করতে পারে। মোদ্দা কথা হলো গিয়ে আপনার সৃষ্টি লোকে চুরি করার বদলে চেয়ে নিতে পারে কিছু সময়ের জন্যে।
উপমহাদেশে এই কপিরাইটের সংজ্ঞা কিছুটা হলেও আলাদা। যে কোনো লেখা/সংগীত/ছবি এখানে হামেশাই চুরি হচ্ছে। আমরা কপিরাইট বলতে আমার সৃষ্টি যেন কেউ চুরি না করে সেটাই বুঝি। এখানে কপিরাইট আইনের রক্ষক তালপাতার সেপাই।
নিজের লেখা, নিজের বই, নিজের ছবি বা নিজের সৃষ্টির উপরে নিজের অধিকার রাখার জন্যে এখন লোকে ওই বৃত্তঘেরা ছোট্ট "সি" অক্ষর দিয়ে দেয় আর ভাবে আমার কপিরাইট বসে গেল আমার ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টির উপর।
হা অবোধ মনুষ্য।
আমার সৃষ্টি কে আমার বলে দুনিয়ার কাছে আমারই বলে অধিকার চাওয়ার জন্যে বৃত্তঘেরা ছোট্ট "সি" অক্ষর ছাড়াও আরো কয়েক ধাপ রাস্তা এগোতে হবে।
কিভাবে এগোবেন?
১) যিনি স্রষ্টা, তিনি নিজের স্বাক্ষর দেগে রাখুন নিজের সৃষ্টির উপরে। ক্যানভাসে আপনার সই, কবিতায় বা গল্পে আপনার নাম, সঙ্গীতের আগে বা পরে নিজের নাম, রেকর্ডিং করার সময়ের প্রমাণ।
২) প্রমান রাখুন যে আপনার সৃষ্টি আপনারই। গল্প-কবিতা লিখে যখন কোথাও পাঠাচ্ছেন, তখন সেই পাঠানোর সময়ের কোনো প্রমাণ, চিঠিপত্রের ফটোকপি। আপনার ছবি যখন প্রথম বারের জন্যে পাবলিক প্রদর্শন করানো হচ্ছে, তখন খেয়াল রাখুন যেন জনগণের কাছে আপনার শিল্প আপনার বলেই পরিচিত হলো। একই ব্যাপার সংগীত জগতের ক্ষেত্রেও।
৩) যদ্দুর সম্ভব নিজের কাজ কোথাও রেজিস্টার করিয়ে রাখুন। গল্প কবিতা হলে আইএসবিএন বানিয়ে রাখুন, চিত্রকলা গ্যালারিতে রেজিস্টার করিয়ে রাখুন সঙ্গীতও প্রথম প্রকাশের সময় নিজের বলেই প্রকাশ করুন অথবা যে রেকর্ডিং কোম্পানি থেকে বেরোচ্ছে, তার একটা প্রমাণ জোগাড় করে রাখুন।
এতো গেল একটা সিস্টেমের কথা। এবার আসি সমস্যার ব্যাপারে।
প্লেজারীসম।
অভিধান ঘাঁটলেই জানা যাবে, প্লেজারীসম শব্দটার সবথেকে সোজা বাংলা হচ্ছে চৌর্যবৃত্তি।
অন্য কারোর কাজ, সৃষ্টি, ভাবনা নিয়ে স্রষ্টার বিনা অনুমতিতে নিজের নামে বা কোনোভাবে বাজারে চালানোকেই চৌর্যবৃত্তি বলে।
একটা মোরাল কম্পাস বা স্বাভাবিক মানসিক ভারসাম্য থাকলেই বোঝা যায় আমি চুরি করছি কিনা। প্লেজারীসম বা চুরিবিদ্যা কিন্তু খুবই গভীর অপরাধ। যাঁরা করেন, ধরা না পড়া অব্দি তাদের উপর বেশ শ্রদ্ধা থাকে আমার।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রিধারী হওয়ার আগে শুনেছি ডিগ্রির থিসিস বেশ ভালো করেই আঁতি-পাতি খুঁজে দেখা হয়।
সাহিত্যে কিন্তু সেটা হয় না। অথবা বলা যেতে পারে করা হয়ে ওঠে না।
এই প্রসঙ্গে একটা কথা উঠতেই পারে, অনুবাদ সাহিত্য।
অনেকে বলেন, বিদেশি সাহিত্যের অনুবাদ নিজের নামে ছেপে দিলে ধরা পড়ছে কোথায় আর ধরবার লোকই বা কোথায়।
সত্যবচন।
আমার নিজস্ব মতামত অনুযায়ী বিদেশি সাহিত্যের অনুবাদ জিনিসটা আদতে ভাল।
দুটো উদাহরণ নেওয়া যাক,
১) সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত : ফুলের ফসল বইটা নেওয়া যাক, সত্যেনবাবু কবিতার অনুবাদ গুলো না করলে আমরা জালালুদ্দিন রুমী অথবা হাসান আল বাগদাদির নাম অব্দি জানতে পারতাম না।
২)কাল্পনিক উদাহরণ (আমি): সিডনি সেলডনের কোনো একখানা বই বাংলায় অনুবাদ করে আমার নামে ছেপে বাজারে ছেড়ে দিলাম।
কিন্তু সত্যেনবাবুর অনুবাদ আর আমার চুরির মধ্যে একখানা লম্বা গভীর খাতের পার্থক্য আছে।
আমি চুরি করলে নিজের নামে চালাই। আর দত্তবাবু রুমীর নামে চালান। আমারটা প্লেজারীসম, আইনের চোখে দণ্ডনীয় অপরাধ। আর দত্তবাবুর সৃষ্টি সাহিত্যের অমূল্য রতন।
মোদ্দা কথা হলো,
*) প্রকাশক/সম্পাদকের দায়িত্ব নেওয়া উচিত একটুখানি। যাতে চুরি টুরি ব্যাপারটা আটকানো যায়।
*) কপিরাইটের ব্যাপারেও প্রকাশক/সম্পাদককেই দায়িত্ব নিতে হবে। আইনের হাত শুনেছি অনেক লম্বা হয়।
*) লেখক/লেখিকা কবি/মহিলা-কবিদের আরেকটু সতর্কতা নিয়ে লেখা উচিত। চুরি করতে নিষেধ করার অধিকার অথবা ক্ষমতা দুটোই আমার নেই। কিন্তু ভেবেচিন্তে চুরি করা উচিত। ধরা না পড়লেই হলো।
যেহেতু এই ওয়েবসাইট একখানি প্ল্যাটফর্ম। পোস্টারবোর্ড বলা যেতে পারে, এডমিনদের আরো একটুখানি কড়া হওয়া প্রয়োজন।
নীচের লিংক গুলো ভারত ও বাংলাদেশের কপিরাইট আইন সমন্ধে কিছু তথ্য:
******
******