▪ বাংলা সাহিত্যে সনেটঃ-

বাংলা সাহিত্যে প্রথম সনেট রচনা করেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত (১৮২৪-১৮৭৩)। তার ‘কবি মাতৃভাষা’ (১৮৬০) কবিতাটি বাংলার প্রথম সনেট। তার সনেটে পেত্রার্ক বা ইতালিয়ান সনেটের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। তিনি সনেট লিখে বাংলা সাহিত্যে অত্যন্ত আলোড়ন সৃষ্টি করেছেন।
রামনাথ সেন, রাধানাথ রায়, দেবেন্দ্রনাথ সেন, বিহারীলাল চক্রবর্তী, অক্ষয় কুমার বড়াল, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, মোহিতলাল মজুমদার থেকে আরম্ভ করে বুদ্ধদেব বসু, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, বিষ্ণু দে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্রমথ চৌধুরী, জীবনানন্দ দাশ, নবকৃষ্ণ ঘোষ, প্রমথনাথ রায়, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, রাম বসু, গোবিন্দ্র চন্দ্র দাশ, রমেন্দ্রকুমার আচার্য চৌধুরী, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, শঙ্খ ঘোষ, পবিত্র মুখোপাধ্যায়, কাজী নজরুল ইসলাম, রাধারাণী দেবী,  উত্তম দাশ, পার্থপ্রতিম কাঞ্জিলাল, ফররুখ আহমদ, কামিনী রায়, রজনীকান্ত সেন, সুফি মোতাহার হোসেন, আব্দুর রাজ্জাক, আব্দুস সাত্তার, জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, আলাউদ্দিন আল-আজাদ, মোহাম্মদ মাহফুজউল্লাহ, গিরীন্দ্রমোহিনী দাসী, মানকুমারী বসু, নগেন্দ্রবালা মুস্তাফী, মৃণালিনী দেবী, প্রিয়ম্বদা দেবী, ওমর আলী, আব্দুল কাদির, আব্দুল মান্নান সৈয়দ, শামসুর রাহমান, কবি আল মাহমুদ, শহীদ কাদরী, সৈয়দ শামসুল হক, সানাউল হক প্রমুখ কবিরা এই বিষয়ে প্রচুর চর্চা করেছেন এবং আরো বহু কবি  আছেন, তাঁদের মধ্যে  জয় গোস্বামী , মৃদুল দাশগুপ্ত উল্লেখ্য। এছাড়াও গৌতম চৌধুরী, গৌরশংকর বন্দ্যোপাধ্যায়, শংকর চক্রবর্তী, উজ্জ্বল সিংহ, শ্যামলকান্তি দাশ, বিশ্বনাথ গরাই, যশোধরা রায়চৌধুরী, মন্দাক্রান্তা সেন-এর মতো কবিরা বিক্ষিপ্ত ভাবে কিছু সনেট রচনা করেছেন।
আরোও বেশ কয়েকজন কবি, যারা সুগভীর ভাবে এবিষয়ে অনুধ্যান করেছেন, তাদের সংখ্যাও নিতান্ত কম নয়। বাংলায় প্রচুর সনেট লেখা হয়েছে এবং একালেও লেখা হচ্ছে এবং হয়তো ভবিষ্যতেও অনেক এ ধারা অব্যাহত থাকবে।

বাংলা ভাষার অনেক কবিই পাশ্চাত্য রীতিতে সনেট রচনা করেছেন আবার কখনো তারা ঐ রীতি ভেঙে সনেটে নতুনত্ব এনেছেন। রবিঠাকুর, সতেন্দ্রনাথ দত্ত, প্রমথ চৌধুরী, ফররুখ আহমদ, আল মাহমুদ সহ অনেক বিখ্যাত কবি সনেটের মুল বিষয়বস্তু অক্ষুন্ন রেখে একটু নিজস্ব ধারায় সনেট রচনা করেছেন।
শিল্পীর স্বাধীনতা বলতে একটা কথা আছে। কোন শিল্পীই নিয়মের ব্যাকরণে আবদ্ধ থাকতে চান না। প্রতিভার ধর্ম নতুনত্বের দিকেই। শুধু নতুনত্ব দিয়ে শিল্পের বিচার হয় না। শিল্প ‘সহৃদয় হৃদয় সংবেদী’ পাঠকের অন্তরে কতটুকু স্থায়ীত্ব লাভ করে সেটাই বিচার্য বিষয়। এ দৃষ্টিকেঠু থেকে বিচার করলে এক জনের নাম বাংলা সনেটের ইতিহাসে উঠে আসে তিনি আল মাহমুদ।

#এখানে কয়েকজন কবির কিছু কবিতার গঠনরূপ দেখানো হলোঃ-

ফরাসী কবি Jose-Maria Heredia (১৮৪২-১৯০৫) রচিত 'বিস্মৃতি' ও 'অকালমৃতা' নামক দুটি সনেটের অনুবাদ করেছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, যার ছন্দোবন্ধ নিম্নরূপঃ

কখখক : কখখক :: গগঘ : ঙঘঙ

• প্রমথ চৌধুরী নিম্মের রূপকল্পের প্রবর্তন করেনঃ

কখখক : কখখক :: গগ : ঘঙঙঘ
কখখক : কখখক :: গগ : ঘঙঘঙ

প্রমথ চৌধুরীর ফরাসী-ঘেঁষা আদর্শের অনুসরণে কান্তিচন্দ্র ঘোষ, রিয়াজউদ্দীন চৌধুরী ও রাধারাণী দেবী বহু সনেট নির্মাণ করেছেন। এভাবে ত্রিধা-বিভক্ত হতে গিয়ে অনেক সনেট একেবারে যথেচ্চাচারের পর্যায়ে উপনীত হয়েছে। নিচে এরূপ অনিয়মিত ধাঁচের রূপকল্প দেখুনঃ

• প্রমথ চৌধুরীর 'ও' সনেটঃ কখখক : গঘঘগ :: ঙঙ : চছচছ

• রিয়াজউদ্দীন চৌধুরীর 'শাহজাহান ২ সনেটঃ  কখখক : গঘঘগ :: ঙঙ : চছচছ

• প্রিয়নাথ সেনের 'অব্যক্ত বাসনা' সনেটঃ কখকখ : গঘগঘ :: ঙঙ : চছছচ

• রাধারাণী দেবীর 'বিগত অতীত' সনেটঃ কখকখ : গঘগঘ :: ঙঙ : চছচছ

• রবীন্দ্রনাথের 'বাহু'  সনেটঃ কখখক : কগকগ :: ঘঙঘঙ : চচ

• যতীন্দ্রমোহন বাগচীর 'বিপন্না' সনেটঃ কখকখ : খকখক :: গগ : ঘঙঘঙ

• সুকান্ত ভট্টচার্যের 'অলক্ষ্যে' সনেটঃ কখখক : কগগক :: ঘঘঙ : চঙচ

• সানাউল হকের 'সম্ভবা অনন্যা' কাব্যের ৩৮ পৃষ্ঠার সনেটঃ
কখ খক : গঘ গঘ :: ঙচ ঙচ ঙচ

• শামসুর রাহমানের 'স্টেজে' ও 'একজন বেকারের উক্তি' সনেটঃ কখ খক : গঘঘগ :: ঙচছ ঙচছ

• আল মাহমুদের 'লোকান্তর' ও 'আমি' সনেটঃ কখ খক : গঘঘগ :: ঙচচ ঙচঙ

• মোহাম্মদ মনিরুজ্জামানের 'সাতাশে এপ্রিল' সনেটঃ কখ খক : গঘ ঘগ :: ঙচছ চছঙ

• বাংলা ভাষায় অনিয়মিত ধাঁচে অনেক সনেট রচিত হয়েছে; তন্মধ্যে দেবেন্দ্রনাথ সেনের প্রবর্তিত নিচের দুটি পদ্ধতি উল্লেখনীয়। তাঁর 'পরাজয়', 'গ্রীষ্মের ফল' এবং 'আমি সনেটের মিলবিন্যাস নিম্নরূপঃ

কখখক : গঘঘগ :: ঙচচঙ : ছছ

এ পদ্ধতিতে শশাঙ্কমোহন সেনের 'নিস্তব্ধতা', মোহিতলাল মজুমদারের 'প্রণয়-ভীরু', সুধীন্দ্রনাথ দত্তের 'জিজ্ঞাসা' ও 'অহেতুকী', বুদ্ধদেব বসুর 'নেশা', তালিম হোসেনের 'আলাপ : সঞ্চারী', মোহাম্মদ মাহফুজউল্লাহর 'ভাটিয়ালি বাউলের সুর' ও ফজল শাহাবুদ্দীনের 'পতিতা' সনেট বিরচিত।

• দেবেন্দ্রনাথ সেনের 'পিপাসা' সনেটের মিল বিন্যাসঃ

কখ খক : গঘ ঘগ :: ঙচঙচ : ছছ

এ পদ্ধতিতে আজিজর রহমানের 'চিরকুমারী', সুধীন্দ্রনাথ দত্তের 'অপচয়' ও 'জাদুঘর', এবং মোতাহের চৌধুরীর 'শরতে' বিরচিত।

এ ধরনের অনিয়মিত ধাঁচগুলি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় প্রচলিত রীতিগুলির নানা প্রকার মিশ্রণ ও রকমফের। রবীন্দ্রনাথের সনেটে অনিয়মিত ধাঁচের দৃষ্টান্ত সমধিক।

বাংলা সাহিত্যে অনেক কবিই মিলবিন্যাসে যেমন আদি ঘরানাকে ভেঙে নতুন কিছু সৃষ্টির প্রয়াস পেয়েছেন তেমনি গদ্য ছন্দকেও আশ্রয় করেছেন। তারা যথার্থ ছিলেন কি না এটি সাহিত্যের বোদ্ধাজনরাই নির্ধারণ করবেন। কবিতা হিসেবে সনেটের ভাবগাম্ভীর্য, মিলবিন্যাস, পঙ্ক্তির নির্দিষ্টতা এবং একটিমাত্র বিষয়ভিত্তিক চিন্তার অনুরণনসহ আবশ্যিক বিষয়গুলো ছেঁটে ফেলে তাকে নতুন আঙ্গিক দেয়া যেতেই পারে কিন্তু তাকে আদৌ ‘সনেট’ হিসেবে আখ্যায়িত করা যাবে কি না তা সময়ের হাতে ছেড়ে দেয়াই উত্তম।

মাইকেলের ১৮৬০ সালের সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে রচিত বাংলা সাহিত্যের প্রথম সনেট বা চতুর্দশপদী কবিতাটি উল্লেখ করা হলোঃ

নিজাগারে ছিল মোর | অমূল্য রতন  ক
অগণ্য; তা সবে আমি | অবহেলা করি  খ
অর্থলোভে দেশে দেশে | করিণু ভ্রমণ  ক
বন্দরে বন্দরে যথা | বাণিজ্যের তরী  খ
কাটাইনু কতকাল | সুখ পরিহরি  খ
এই ব্রতে, যথা তপো|বনে তপোধন  ক
অশন, শয়ন ত্যাজে, | ইষ্টদেবে স্মরি  খ
তাহার সেবায় সদা | সঁপি কায় মন।  ক
{অষ্টক}
বঙ্গকুল লক্ষী মোরে | নিশার স্বপনে  গ
কহিলা-‘‘হে বৎস, দেখি | তোমার ভকতি  ঘ
সুপ্রসন্ন তবপ্রতি | দেবী সরস্বতী  ঘ
নিজ গৃহে ধন তব, | তবে কি কারণে  গ
ভিখারী তুমি হে আজি, | কহ ধন-পতি?  ঘ
কেন নিরানন্দ তুমি | আনন্দ সদনে?   গ
{ষটক}

(বঙ্গভাষা/মাইকেল মধুসূদন দত্ত)
{পর্ব বিন্যাসঃ ৮+৬; স্তবক বিন্যাসঃ ৮+৬}
[এখানে অন্ত্যমিলঃ (কখকখ : খকখক :: গঘঘগঘগ)]

#বাংলা সনেট/চতুর্দশপদী কবিতায় পঙক্তির সংখ্যাঃ-

পৃথিবীর সব ভাষা এবং সব রীতির সনেটের পঙক্তি সংখ্যা ১৪ তে সীমাবদ্ধ।
অবশ্য ইংরেজ কবি জর্জ মেরিডিথ (১৮২৮-১৯০৫) তার 'Modern Love' কাব্যে ১৬ পঙক্তিতে সনেট রচনা করেছেন  এবং প্রসিদ্ধ ইংরেজ কবি দান্তে গ্যাব্রিয়েল রসটি (১৮২৮-১৮৮২) ১৬ পঙক্তি বিশিষ্ট ৩টি সনেট লিখেছেন, যার মিলবিন্যাসঃ কখখক : কখখক :: গঘগ : ঘগঘ : ঙঙ
এছাড়াও ইংরেজ কবি হপকিনস(১৮৪৪-১৮৮৯) ৬+৪+১/২ বিভাজনে ১১ পঙক্তির সনেট রচনা করেছেন। তার প্রবর্তিত 'কার্টাল রীতি' ১১ পঙক্তির সনেট।

বাংলা ভাষায় রচিত সনেটে বিভিন্ন অন্ত্যমিল লক্ষ্য করা গেলেও সব রীতিতেই সনেটের পঙক্তি সংখ্যা ১৪। অনেক কবি পঙক্তি সংখ্যা নিয়ে গবেষণা করলেও এগুলো ফলপ্রসূত হয়নি।

#বাংলা সনেট/চতুর্দশপদী কবিতায় মাত্রা সংখ্যাঃ-

শুরুতে বাংলা সনেট ১৪ মাত্রার মধ্যে সীমিত থাকলেও ধীরে ধীরে সম্প্রসারিত হয়। বাংলা সাহিত্যে সনেট ১৪, ১৬, ১৮, ২০, ২২, ২৪, ২৬, ২৮, ৩০ এবং ৩২ মাত্রা পর্যন্ত সম্প্রসারিত হয়। এছাড়াও ১০, ১১ ও ১২ মাত্রার সনেটও লক্ষ্য করা যায়।

১৪ এর পর ১৮ মাত্রার কবিতাই সর্বাধিক গৃহীত সনেট। এই মন্ময় কবিতা মানুষের জীবনের প্রায় সব বিষয় নিয়েই আবর্তিত হচ্ছে। ব্যক্তির সুখ, দুঃখ, সমস্যা, স্বদেশপ্রীতি, প্রকৃতিপ্রেম, চিন্তামূলক, স্ত্রোত, মনস্তাত্ত্বিক জটিলতাসহ সবকিছুই প্রতিভাত হচ্ছে। পয়ার বা মহাপয়ারের ওপর সনেটের ভিত্তি দাঁড়িয়ে। এর প্রতি চরণের মাত্রাসংখ্যা ৮+১০ বা ১০+৮। ১৮ মাত্রায় চরণের শেষে ভাবের সামগ্রিক সমাপ্তি অত্যাবশ্যক নয়। বরং এই বক্তব্য বা ভাবের ব্যঞ্জনা চরণ থেকে চরণান্তরে প্রবাহিত হতে পারে।

#বিভিন্ন মাত্রায় রচিত কিছু সনেট/চতুর্দশপদী কবিতা উল্লেখ করা হলোঃ

• ১০ মাত্রার সনেটঃ
১০ অক্ষরযুক্ত পঙক্তিতে সনেট রচনার চেষ্টা করেছিলেন সুরেন্দ্রনাথ মৈত্র ও বুদ্ধদেব বসু। সুরেন্দ্রনাথ মৈত্র্যের 'কামাল' কবিতাটি ১০ অক্ষরের পঙক্তিযুক্ত।

প্রাণে যার জ্বলে অনির্বাণ  ক
বহ্নিশিখা, সেই শুধু পারে  খ
অগ্নিমন্ত্র শিখাতে সবারে;  খ
প্রাণ দিতে পারে প্রাণবান। ক

তাদেরে যাহারা মুহ্যমান  ক
দাসত্বের শৃংখলের ভারে।  খ
নির্বীর্যের তরে এ-সংসারে  খ
বীরহস্তে মুক্তির কৃপাণ।  ক

তুরস্কের নব জন্মদাতা  গ
বজ্রপাণি বীরেন্দ্র কামাল।  ঘ
তুমি আর নাহি এ জগতে।  ঙ
তোমার আসন রবে পাতা   গ
নিখিলের মর্মে চিরকাল;   ঘ
ধর্মযোদ্ধা অমর মরতে।।  ঙ

(কামাল/সুরেন্দ্রনাথ মৈত্র্য)
{পর্বঃ ১; মাত্রা সংখ্যাঃ ১০}
[অন্ত্যমিলঃ কখখক : কখখক :: গঘঙ : গঘঙ]

• ১১ মাত্রার সনেটঃ
প্রমথ চৌধুরীর 'পদচারণ' কাব্যগ্রন্থের 'বিলাতে রবীন্দ্র' ও
'কবিতা লেখা' নামক সনেট দুটিতে ১১ মাত্রা লক্ষ্য করা যায়।
তার 'বিলাতে রবীন্দ্র' সনেটটি নিম্নরূপঃ

বিলাতের গেছে | সে একদিন  ক
সুরে বাঁধা ছিল | কবির বীণ,  ক
দিগন্ত-প্রসারী | ঝংকার যার  খ
আজিও কাঁপায় | মনের তার।  খ
সে সুর ভেঙেছে | নূতন তন্দ্র,  গ
এখন ক্যাঁকায় | মানুষ-যন্ত্র,  গ
দ্যুলোক পড়েছে ধোঁয়ায় চাপা,  ঘ
প্রকৃতির বাণী | কালিতে ছাপা।  ঘ

সহসা তুলেছে | জাগায়ে প্রাণ,  ঙ
পুব হতে এসে | রবির গান,  ঙ
ভারতী যাহার | কলম ধ’রে  চ
নিতি নব গান | রচনা করে,  চ
লিখে রাখে নভে, | জলে ও স্থলে,  ছ
রূপের বারতা | সোনার জলে।  ছ

(পদচারণ: বিলাতে রবীন্দ্র/প্রমথ চৌধুরী)
{পর্ব বিন্যাসঃ ৬+৫; মাত্রা সংখ্যাঃ ১১}
[এখানে অন্ত্যমিলঃ ককখখগগঘঘ || ঙঙচচছছ]

• ১২ মাত্রার সনেটঃ
১২ অক্ষরের পঙক্তি নির্মাণের পরীক্ষা করেন অক্ষয় কুমার বড়াল। তার 'ডুবছে তপন' সনেটটি দেখুনঃ

ডুবেছে তপন, | আলোক-জীবন; ক
ধরণীর বুক | ছাইছে আঁধার! খ
ফিরিছে পথিক, | মলিন বদন; ক
জগতের কাজ | নাহি যেন আর! খ

যে আলোক গেলো, | গেলো একেবারে? গ
রহিল না প্রেম, | গেলো কি সমূলে? ঘ
ধীরে আসে বায়ু, | মুছে শ্রম-ধারে, গ
যে ভুলে- যেন গো | একেবারে ভুলে! ঘ

ডুবেছে তপন, | প্রত্যক্ষের আলো, ঙ
দলে দলে তারা | ফুটিছে আবার। চ
কোটি চক্ষু মেলি | ঘেরে চারি ধার, ঙ
সমষ্টির যেন | ভগ্নকণা-জাল! চ

যে আছিস এক, | হলো শত শত! ছ
কণায় কণায় | প্রেমের জগত! ছ

(ডুবছে তপন/অক্ষয় কুমার বড়াল)
{পর্বঃ ৬+৬; মাত্রা সংখ্যাঃ ১২}
[অন্ত্যমিলঃ কখকখ : গঘগঘ :: ঙচঙচ : ছছ]

• ১৪ মাত্রার সনেটঃ
মাইকেল মধুসূদন দত্ত, গোবিন্দ্রচন্দ্র দাস, প্রমথ চৌধুরী, কান্তিচন্দ্র ঘোষ ও প্রমথনাথ বিশীর সব সনেট ১৪ মাত্রায় লেখা।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ৭৬ টি সনেটপন্থী কবিতার মধ্যে ৬৮ টিই ১৪ মাত্রার। এখানে মাইকেল মধুসূদন দত্তের 'মিত্রাক্ষর' সনেটটি উল্লেখ করা হলোঃ

বড়ই নিষ্ঠুর আমি | ভাবি তারে মনে,  ক
লো ভাষা, পীড়িতে তোমা | গড়িল যে আগে  খ
মিত্রাক্ষররূপ বেড়ি ! | কত ব্যথা লাগে   খ
পর’ যবে এ নিগড় | কোমল চরণে–   ক
স্মরিলে হৃদয় মোর | জ্বলি উঠে রাগে   খ
ছিল না কি ভাবধন, | কহ, লো ললনে,   ক
মনের ভাণ্ডারে তার, | যে মিথ্যা সোহাগে   খ
ভুলাতে তোমারে দিল | এ তুচ্ছ ভূষণে ?   ক

কি কাজ রঞ্জনে রাঙি | কমলের দলে ?    গ
নিজরূপে শশিকলা | উজ্জ্বল আকাশে !   ঘ
কি কাজ পবিত্রি’ মন্ত্রে | জাহ্নবীর জলে ?   গ
কি কাজ সুগন্ধ ঢালি | পারিজাত-বাসে ?   ঘ
প্রকৃত কবিতা রূপী | কবিতার বলে,–     গ
চীন-নারী-সম পদ | কেন লৌহ ফাঁসে ?    ঘ

(মিত্রাক্ষর/ মাইকেল মধুসূদন দত্ত)
{পর্ব বিন্যাসঃ ৮+৬; মাত্রা সংখ্যাঃ ১৪}
[অন্ত্যমিলঃ কখখক,খকখক || গঘগঘগঘ]

• ১৬ মাত্রার সনেটঃ
দেবেন্দ্রনাথ সেন ১৪ বা ১৮ মাত্রায় তার প্রায় সব সনেট লিখলেও তার ১৬ মাত্রার সনেট লক্ষ্য করা যায়। এছাড়াও রবীন্দ্রনাথের "কড়ি ও কোমল" কাব্যগ্রন্থের 'গান রচনা' কবিতায় ১৬ মাত্রা লক্ষ্য করা যায়।
নিচে দেবেন্দ্রনাথের ১৬ অক্ষর মাত্রায় লেখা একটি সনেট উদ্ধৃত হলোঃ

বৃথা ও ঘৃণার হাসি, | বৃথা ও কথার ছল;  ক
রবির কিরণ আমি, | তুমি মালঞ্চের ফুল!  খ
বৃথা তব উপহাস, | শাণিত কথার শূল;   খ
রূপের পতঙ্গ তুমি, | আমি শ্যাম দুর্বাদল!  ক

জানো না কি রবিরশ্মি | যেই পুষ্পে গিয়ে পড়ে,  গ
সেই পুষ্প হয়ে যায় | কিরণে কিরণময়?  ঘ
জানো না কি প্রজাপতি | যেই পুষ্পে বসে উড়ে,  গ
আহরিয়া তারি বর্ণ | হয় গো সুবর্ণময়?  ঘ

আমার সোহাগকুঞ্জে | বসিয়া বসিয়া তুমি   ঙ
ভুলে গিয়ে ঘৃণা হাসি, | কণ্ঠমণি হবে, ধনি!   চ
জানো না কি, ভালোবাসা | ধরার পরশমণি   চ
ঘৃণার রাজত্ব হবে | দিবানিশি চুমি চুমি?   ঙ

আজি তুমি মন-সাধে | হেসে লও ঘৃণাহাসি,  ছ
কালি এ বক্ষেতে শোবে | আপনি আপনি আসি।  ছ

(পর্ব বিন্যাসঃ ৮+৮; মাত্রা সংখ্যাঃ ১৬)
{অন্ত্যমিলঃ কখখক : গঘগঘ : ঙচঙচ : ছছ}
[ভালোবাসার জয়/দেবেন্দ্রনাথ সেন]

• ১৮ মাত্রার সনেটঃ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সনেটের মাত্রাকে ১৮ পর্যন্ত উন্নীত করেন। বর্তমানে বাংলা সাহিত্যে ১৮ মাত্রার সনেটই বেশি পরিলক্ষিত হচ্ছে। ফররুখ আহমদ, আল মাহমুদ প্রমুখ কবি এই আদর্শে সনেট চর্চা করেছেন। আল মাহমুদের 'সোনালি কাবিন' কাব্যগ্রন্থের একটি কবিতা উল্লেখ করতে যাকঃ

আমার ঘরের পাশে | ফেটেছে কি কার্পাশের ফল?  ক
গলায় গুঞ্জার মালা | পরো বালা, প্রাণের শবরী,   খ
কোথায় রেখেছো বলো | মহুয়ার মাটির বোতল  ক
নিয়ে এসো চন্দ্রালোকে | তৃপ্ত হয়ে আচমন করি।  খ
ব্যাধির আদিম সাজে | কে বলে যে তোমাকে চিনবো না  গ
নিষাদ কি কোনদিন | পক্ষিণীর গোত্র ভুল করে?  ঘ
প্রকৃতির ছদ্মবেশে | যে-মন্ত্রেই খুলে দেন খনা  গ
একই জাদু আছে জেনো | কবিদের আত্মার ভিতরে।  ঘ
নিসর্গের গ্রন্থ থেকে, | আশৈশব শিখেছি এ-পড়া  ঙ
প্রেমকেও ভেদ করে | সর্বভেদী সবুজের মূল,  চ
চিরস্থায়ী লোকালয় | কোনো যুগে হয়নি তো গড়া   ঙ
পারেনি ঈজিপ্ট, গ্রীস, | সেরাসিন শিল্পীর আঙুল।   চ
কালের রেঁদার টানে | সর্বশিল্প করে থর থর  ছ
কষ্টকর তার চেয়ে | নয় মেয়ে কবির অধর।  ছ

(সোনালী কাবিন-৫/আল মাহমুদ)
{পর্ব বিন্যাসঃ ৮+১০; মাত্রা সংখ্যাঃ ১৮}
[অন্ত্যমিলঃ কখকখ : গঘগঘ : ঙচঙচ :: ছছ]

• ২০ মাত্রার সনেটঃ
রবীন্দ্রনাথ ২০ অক্ষরবিশিষ্ট পঙক্তি যোগে 'যৌবন-স্বপ্ন', 'ক্ষণিক মিলন' ও 'সন্ধ্যার বিদায়' শিরোনামযুক্ত সনেট লিখেছেন। তার "কড়ি ও কোমল কাব্যগ্রন্থের" 'সন্ধ্যার বিদায়' সনেটটি নিম্নরূপঃ

সন্ধ্যা যায়, সন্ধ্যা ফিরে চায়, | শিথিল কবরী পড়ে খুলে—  ক
যেতে যেতে কনক- আঁচল | বেধে যায় বকুলকাননে,  খ
চরণের পরশরাঙিমা | রেখে যায় যমুনার কূলে—  ক
নীরবে- বিদায়- চাওয়া চোখে, | গ্রন্থি- বাঁধা রক্তিম দুকূলে  ক
আঁধারের ম্লানবধূ যায় | বিষাদের বাসরশয়নে।  খ
সন্ধ্যাতারা পিছনে দাঁড়ায়ে | চেয়ে থাকে আকুল নয়নে।   খ
যমুনা কাঁদিতে চাহে বুঝি, | কেন রে কাঁদে না কণ্ঠ তুলে—  ক
বিস্ফারিত হৃদয় বহিয়া | চলে যায় আপনার মনে।  খ
মাঝে মাঝে ঝাউবন হতে | গভীর নিশ্বাস ফেলে ধরা।   গ
সপ্ত ঋষি দাঁড়াইল আসি | নন্দনের সুরতরুমূলে—   ক
চেয়ে থাকে পশ্চিমের পথে, | ভুলে যায় আশীর্বাদ করা।   গ
নিশীথিনী রহিল জাগিয়া | বদন ঢাকিয়া এলোচুলে।   ক
কেহ আর কহিল না কথা, | একটিও বহিল না শ্বাস—   ঘ
আপনার সমাধি - মাঝারে | নিরাশা নীরবে করে বাস।  ঘ

(কড়ি ও কোমল: সন্ধ্যার বিদায়/রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)
{পর্ব বিন্যাসঃ ১০+১০; মাত্রা সংখ্যাঃ ২০}
[অন্ত্যমিলঃ কখককখখকখগকগক : ঘঘ]

• ২২ মাত্রার সনেটঃ
জীবনানন্দ দাশ তার 'রূপসী বাংলা' কাব্যের বেশির ভাগ কবিতা লিখেছেন ২২ অক্ষরের পঙ‌ক্তিতে।
জীবনানন্দ দাশের 'আবার আসিব ফিরে', 'এ-সব কবিতা আমি যখন লিখেছি', 'একদিন জলসিড়ি নদীর ধারে', 'একদিন যদি আমি',  'এই পৃথিবীতে এক স্থান আছে', 'বাংলার মুখ আমি' 'অশ্বত্থ বটের পথে' সহ বেশ কয়টি কবিতায় ২২ মাত্রা লক্ষ্য করা যায়। এছাড়াও আ. ন. ম. বজলুর রশীদের 'আষাঢ়' ও 'ঊর্ণনাভ'  বুদ্ধদেব বসুর 'সুদূরিকা', শামসুল হুদার 'একটি স্বপ্ন' ও 'ভারমুক্ত' ২২ মাত্রার সনেট। এছাড়াও অপূর্ব কৃষ্ণ, হুমায়ূন কবির, বিষ্ণু দে, বিমল চন্দ্র প্রমুখ কবি ২৬ মাত্রার সনেট রচনা করেছেন।
জীবনানন্দ দাশের 'আবার আসিব ফিরে' কবিতাটি উল্লেখ করা হলোঃ

আবার আসিব ফিরে | ধানসিঁড়িটির তীরে- | এই বাংলায়  ক
হয়তো মানুষ নয় | হয়তো বা শঙ্খচিল | শালিকের বেশে খ
হয়তো ভোরের কাক | হয়ে এই কার্তিকের | নবান্নের দেশে খ
কুয়াশার বুকে ভেসে | একদিন আসিব এ | কাঁঠাল-ছায়ায়; ক
হয়তো বা হাঁস হব- | কিশোরীর-ঘুঙুর র-| হিবে লাল পায়, ক
সারা দিন কেটে যাবে | কলমির গন্ধ ভরা | জলে ভেসে ভেসে; খ
আবার আসিব আমি | বাংলার নদী মাঠ | ক্ষেত ভালবেসে  খ
জলাঙ্গীর ঢেউয়ে ভেজা | বাংলার এ সবুজ | করুণ ডাঙায়; ক

হয়তো দেখিবে চেয়ে | সুদর্শন উড়িতেছে | সন্ধ্যার বাতাসে। গ
হয়তো শুনিবে এক | লক্ষ্মীপেঁচা ডাকিতেছে | শিমূলের ডালে। ঘ হয়তো খইয়ের ধান | ছড়াতেছে শিশু এক | উঠানের ঘাসে। গ
রূপসার ঘোলা জলে | হয়তো কিশোর এক | সাদা ছেঁড়া পালে ঘ
ডিঙ্গা বায়; রাঙ্গা মেঘ | সাঁতরায়ে অন্ধকারে | আসিতেছে নীড়ে ঙ
দেখিবে ধবল বক; | আমারেই পাবে তুমি | ইহাদের ভীড়ে। ঙ

(আবার আসিব ফিরে/জীবনানন্দ দাস)
{পর্ব বিন্যাসঃ ৮+৮+৬; মাত্রা সংখ্যাঃ ২২}
[অন্ত্যমিলঃ কখখক,কখখক | গঘগঘঙঙ]

• ২৬ অক্ষরের সনেটঃ
বুদ্ধদেব বসুর 'অসূর্যস্পর্শ্যা' ও 'আর কিছু নাহি সাধ' এবং জীবনানন্দ দাশের 'নদী', 'শকুন', 'তুমি কেন বহু দূরে', 'তোমরা স্বপ্নের হাতে ধরা দাও', 'বাতাসে ধানের শব্দ', 'পৃথিবীর পথে আমি' 'মানুষের ব্যথা আমি পেয়ে গেছি', 'সে কত পুরনো কথা' প্রভূতি ২৬ অক্ষরের সনেট। এছাড়াও অপূর্ব কৃষ্ণ, হুমায়ূন কবির, বিষ্ণু দে, বিমল চন্দ্র প্রমুখ কবি ২৬ মাত্রার সনেট রচনা করেছেন।

বুদ্ধদেব বসুর “পৃথিবীর পথে” কাব্যগ্রন্থের 'অসূর্যস্পর্শ্যা' কবিতাটি উল্লেখ করা হলোঃ

শ্যাম মেঘপুঞ্জ যথা | ঢেকে রাখে আকাশের | লজ্জাহীন নীলিম নগ্নতা,  ক
বিদ্রোহী তৃণের দল | অনাবৃতা ধরিত্রীর | রুক্ষ বক্ষে পরায় বসন,   খ
প্রেমের পবিত্র ব্যথা | আচ্ছাদন করি’রাখে | কুমারীর কাম চঞ্চলতা;---  ক
তেমনি ঢাকিয়া রাখো | তোমার রূপের স্বপ্নে | আমার সমস্ত প্রাণমন।  খ
দৃশ্যমান জগতের | চিহ্ন যথা লুপ্ত হয় | অমাবস্যা-আঁধার-জোয়ারে,  গ
হে অসূর্যস্পর্শ্যা, তব | রূপের বন্যার স্রোতে | মৃত্যু মোর ঘটুক তেমনি,  ঘ
নিঃশেষে নিমগ্ন হয়ে | নিজেরে হারাই যেন | আনন্দে  নীরন্ধ্র অন্ধকারে,  গ
ঝরুক তোমার প্রেম, | আকাশের ফাঁকে-ফাঁকে | কারা যথা  ঝরায় রজনী।  ঘ
তনুর ললিত ছন্দে | রচিয়াছো তিলে-তিলে | অপরূপ যে-কবিতাখানি,  ঘ
আমার ধ্যানের মন্ত্রে | নিয়ত ধ্বনিত হোক | মৌন তার সুরের ঝংকার;  ঙ
প্রাণের মৃন্ময় দীপে | অগ্নির অক্ষর এঁকে | লিখিয়াছো যে-অপূর্ব বাণী,  ঘ
মর্মের অরণ্যে মোর | মর্মরি’ উঠুক দুলি’ | সংগীতের তরঙ্গ তাহার।  ঙ
হৃদয়ের সব সুধা | সঞ্চিত করিছো যেথা | গোপনের আবরণ টানি’,  ঘ
মনের কামনা মোর | একটি কুসুম হয়ে | সেখানে করুক নমস্কার।  ঙ
(অসূর্যম্পষ্যা/বুদ্ধদেব বসু)
{পর্ব বিন্যাসঃ ৮+৮+১০; মাত্রা সংখ্যাঃ ২৬}
[অন্ত্যমিলঃ কখকখ : গঘগঘ :: ঘঙঘঙঘঙ]

#সনেটের ছন্দ নিয়ে কিছু কথাঃ-

বাংলা সাহিত্যে মাইকেল মধুসূদন দত্ত, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, অক্ষয়কুমার বড়াল, গোবিন্দচন্দ্র দাস, প্রমথ চৌধুরী, জীবনানন্দ দাশ, দেবেন্দ্রনাথ সেন, সহ প্রমুখ খ্যাতিমান কবি শুধুমাত্র 'অক্ষরবৃত্ত ছন্দেই' সনেট রচনা করেছেন। এর ফলে 'অক্ষরবৃত্ত ছন্দই' সনেট রচনার আদর্শ ছন্দ হিসেবে গৃহীত হয়েছে। প্রায় সব কবিই এ ছন্দে সনেটের চর্চা করেছেন। তবে বাংলা সাহিত্যে কিছু কবি এ নিয়ম ভেঙে 'স্বরবৃত্ত ছন্দ' ও 'মাত্রাবৃত্ত ছন্দেও' সনেট রচিত হয়েছে।

• স্বরবৃত্ত ছন্দে সনেটে/চতুর্দশপদী কবিতাঃ

কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত 'স্বরবৃত্ত ছন্দে' প্রথম সনেট লেখেন। এছাড়াও বুদ্ধদেব বসুর 'এক তরুণ কবিকে',  'প্রেমিকের গান'
সতেন্দ্রনাথ দত্তের 'বেলাশেষের গান', আ. ন. ম. বজলুর রশীদের   'একটি নিভৃতি' ও 'প্রাচীন আঙ্গিকে' কুমুদরঞ্জন মল্লিক রচিত 'বলিদান' কবিতাগুলো 'স্বরবৃত্ত ছন্দে' রচিত।
নিচে 'বলিদান' সনেটটি দেখানো হলোঃ

মা গো, আমার | গা মুছিয়ে | দিয়ে  ক
তাড়াতাড়ি | পরাও কাপড় | খান,  খ
আজকে আমি | ভুলুর সাথে | গিয়ে  ক
আসবো দেখে | কেমন বলি|দান।  খ
দেখে 'বলি' | কেমন আমোদ | হবে।  গ
নাচবে সবাই, | বললে ভুলু | মোরে,  ঘ
'মা' 'মা' বলে | ডাকবে যখন | সবে  গ
বাজাবে ঢোল | খাজ্‌জি-মাঝো | করে।  ঘ

শেষে যখন | ফিরলো খোকা | বাড়ি,  ঙ
মুখটি মলিন, | চোখ যে ছল|ছল,  চ
জননী তার | শুধায় তাড়া|তাড়ি-  ঙ
কেমন 'বলি' | দেখলি বাছা | বল?  চ
কেঁদে খোকা | বললে: কোথায় | বলি?  ছ
শুধু আহা | কাটছে ছাগল|গুলি।   ছ

(বলিদন/কুমুদরঞ্জন মল্লিক)
{ছন্দঃ স্বরবৃত্ত; মাত্রা বিন্যাসঃ ৪+৪+২}
[অন্ত্যমিলঃ কখকখ : গঘগঘ :: ঙচঙচ : ছছ]

• মাত্রাবৃত্ত ছন্দে সনেটে/চতুর্দশপদী কবিতাঃ

মাত্রাবৃত্ত ছন্দে প্রথম সনেট লেখেন কবি গোলাম মোস্তফা। এছাড়াও মোতাহার হোসেন চৌধুরী, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, জগদীশ ভট্টাচার্য, সুরেন্দ্রনাথ মৈত্র, অজিতকুমার দত্ত, রাধারাণী, অপূর্ব কৃষ্ণ, বিষ্ণু দে, অজিত দত্ত, মণীশ ঘটক, কালীকিঙ্কর, সাবিত্রীপ্রসূন্ন, মোহাম্মদ মাহফুজউল্লাহ, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, আ. ন. ম. বজলুর রশীদ, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত প্রমুখ কবি 'মাত্রাবৃত্ত ছন্দে' সনেট রচনা করেছেন। এখানে সুধীন্দ্রনাথ দত্তের 'অবিনশ্বর' সনেটটি উল্লেখ করা হলোঃ

বরষা পুন | এসেছে ঘন | গৌরবে:   ক
কুহরি কেকা | নাচিছে মেলি | পুচ্ছটি,  খ
মুক্ত মন | সিক্ত ক্ষিতি | সৌরভে,  ক
দিকের সীমা | মুছিয়া দিছে | কুজ্ঝটি  খ

যুগান্তরে | কদম পুল|কাঞ্চিত   গ
আবার যবে | খুঁজিয়া পাবে | ধন্যতা,  ঘ
আমারি ভাগে | সময়-নেমী | লাঞ্ছিত  গ
পথের রজে | ঘটিবে শুধু | অন্যথা।   ঘ

জলদ-যানে | বৈতরিণী | উত্তরে   ঙ
যক্ষ যথা | বিহরে আজো | অনঙ্গে  চ
তেমনি আমি | ভ্রমিব সখী | সন্তরে  ঙ
নবোত্থিত | মানস-রস-| তরঙ্গে,  চ
আমারো বাণী | বাজিবে তব | অন্তরে  ঙ
বায়ুর গানে, | মেঘের মৃদু  | মৃদঙ্গে।  চ

(অবিনশ্বর/সুধীন্দ্রনাথ দত্ত)
{ছন্দঃ মাত্রাবৃত্ত; মাত্রা বিন্যাসঃ ৫+৫+৪=১৪}
[অন্ত্যমিলঃ কখকখ : গঘগঘ :: ঙচঙচঙচ]

→চলবে...