▪ প্রমথ চৌধুরীর সনেটঃ-

বাংলা সাহিত্যে ইতালিয় সনেট এর প্রবর্তক বলে খ্যাত
প্রমথ চৌধুরী (১৮৬৮-১৯৪৬) বাংলা সনেট রচনার ক্ষেত্রে অভিনবত্বের ছাপ রেখেছেন। তিনি পেত্রার্কীয় রীতির সাথে ফরাসী ধাঁচের মিশ্রন ঘটিয়েছেন।

কবিতার বিভিন্ন বাণী ভঙ্গি নিয়ে গবেষণা করলেও তার মূখ্য কাব্যবাহন হলো 'সনেট'। তার দুইটি কাব্যগ্রন্থের 'সনেট পঞ্চাশৎ' এর সবগুলি কবিতাই সনেট এবং 'পদচারণ' কাব্যগ্রন্থের বেশিভাগ কবিতাই সনেট প্রকৃতির। এছাড়াও তার কিছু সনেট কবিতা রয়েছে। তার মোট ১০৯ টি কবিতার মধ্যে ১০০ টিই সনেট। তিনি তার প্রথম সনেট  ''সনেট পঞ্চাশৎ'' কাব্যের 'সনেট' নামক কবিতায় "বঙ্গ সরস্বতীকে বর্নেট পড়িয়ে নব সাজে সজ্জিত করার ঘোষণা করেছেন"।

প্রমথ চৌধুরী সতেন্দ্রনাথ দত্তের একটি চিঠির উত্তরে নিজেই বলেছেনঃ “আপনি ঠিকই ধরেছেন, আমি ফরাসী ছাঁচই অবলম্বন করেছি। ফরাসীরা ষটককে দুই ভাগ করেছেন। প্রথম একটি দ্বিপদী, পরে একটি চতুষ্পদী।…… ফরাসী সনেট গড়া অনেক অপেক্ষাকৃত সহজ। তাই আমি ঐ Form টাই নিই।”

প্রমথ চৌধুরী তাঁর “সনেট পঞ্চাশৎ" (১৯১৩) নামক সনেট সংকলন গ্রন্থে সনেট সম্বন্ধে বলেছেনঃ—
“ভালোবাসি সনেটের কঠিন বন্ধন,
শিল্পী যাহে মুক্তি লভে অপরে ক্রন্দন"।

প্রমথ চৌধুরীর ফরাসী রীতিতে লেখা সনেটগুলির ভাবাবয়ব ত্রিধা-বিভক্ত, তাতে অষ্টক ও শেষ চতুষ্কটির মধ্যে সেতুবন্ধ-স্বরূপ স্বতন্ত্রভাবে একটি সমিল শ্লোক অবস্থিত।

ফরাসী রীতি ভেঙে প্রমথ চৌধুরী নিম্নের নতুন রূপকল্পের প্রবর্তন করেনঃ

★ কখখক | কখখক || গগ | ঘঙঙঘ

★ কখখক | কখখক || গগ | ঘঙঘঙ

প্রমথ চৌধুরীর ফরাসী-ঘেঁষা আদর্শের অনুসরণে কান্তিচন্দ্র ঘোষ, রিয়াজউদ্দীন চৌধুরী ও রাধারাণী দেবী বহু সনেট নির্মাণ করেছেন।

#প্রমথ চৌধুরীর সনেটের রূপ - রীতি(অন্ত্যমিল) ও স্তবক বিন্যাসসমূহ নিম্মরূপঃ-

• অন্ত্যমিলঃ কখখক | কখখক || গগ | ঘঙঘঙ
{স্তবক বিন্যাসঃ ৪+৪+২+৪}
উদাহরণঃ
সনেট পঞ্চাশৎ কাব্য: বাংলার যমুনা, বালিকা বধু, ভর্ত্তৃহরি, বানার্ডশো, মানব জীবন, ব্যর্থ সমাজ, হাসি ও কান্না, ধরণী, কাঁঠালীচাঁপা, করবী, অপরাহ্ন, ব্যর্থবৈরাগ্য, অন্বেষণ, শিব, বিশ্বরূপ, বিশ্বব্যাকরণ, বিশ্বকোষ, সুরা, শিখা ও ফুল, পরিচয়, স্মৃতি আত্মকথা।

পদচারণা কাব্য: বর্ষা, কবিতা, কাব্যকলা, আমার সমালোচক, ফসলে গুলমে ময়সে তৌবা, সনেট সপ্তক- দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ, পঞ্চম, ডিজেন্দ্রলাল, স্নেহলতা।

অন্যান্য কবিতা: দুনিয়া, ফরমাশি সনেট।

• অন্ত্যমিলঃ কখখক | কখখক || গগ | ঘঙঙঘ
{স্তবক বিন্যাসঃ ৪+৪+২+৪}
উদাহরণঃ
সনেট পঞ্চাশৎ কাব্য: জয়দেব, বন্ধুর প্রতি, কাঠমল্লিকা, রূপক, হাসি
পদচারণা কাব্য: সনেট সপ্তক - ষষ্ঠ, শরৎ
অনান্য কবিতা: পঞ্চাশোর্ধে।

• অন্ত্যমিলঃ কখখক কখখক গগ ঘঙঘঙ
স্তবক বিন্যাসঃ ১৪
উদাহরণঃ
সনেট পঞ্চাশৎ কাব্য: পূরবী

• অন্ত্যমিলঃ কখখক কখখক || গগ ঘঘঘঘ
{স্তবক বিন্যাসঃ ৮+৬}
উদাহরণঃ
সনেট পঞ্চাশৎ কাব্য: চোরকবি

• অন্ত্যমিলঃ কখখক | কখখক || গগ | ঘঘঘঘ
{স্তবক বিন্যাসঃ ৪+৪+২+৪}
উদাহরণঃ
সনেট পঞ্চাশৎ কাব্য: তাজমহল, ফুল

• অন্ত্যমিলঃ কককক | কককক || খখ | গঘগঘ
{স্তবক বিন্যাসঃ ৪+৪+২+৪}
উদাহরণঃ
সনেট পঞ্চাশৎ কাব্য: বসন্তসেনা।

• অন্ত্যমিলঃ কখখক কখখক || গগ ঘকঘক
{স্তবক বিন্যাসঃ ৮+৬}
উদাহরণঃ
সনেট পঞ্চাশৎ কাব্য: পত্রলেখা, গোলাপ, ধুতরার ফুল।
পদচারণ: বন্ধুর প্রতি।

• অন্ত্যমিলঃ কখখক কখখক || গগ | ঘকঘক
{স্তবক বিন্যাসঃ ৮+২+৪}
উদহরণঃ
সনেট পঞ্চাশৎ কাব্য: আত্মপ্রকাশ।

• অন্ত্যমিলঃ কখখক | কখখক || গগ | কঘকঘ
{স্তবক বিন্যাসঃ ৪+৪+২+৪}
উদাহরণঃ
সনেট পঞ্চাশৎ কাব্য: সনেট, বাহার, পাষাণী।

• অন্ত্যমিলঃ কখখক | কখখক || গগ | কঘঘক
{স্তবক বিন্যাসঃ ৪+৪+২+৪}
উদাহরণঃ
সনেট পঞ্চাশৎ কাব্য: ভাষ, রজনীগন্ধা, স্বপ্নলঙ্কা।

• অন্ত্যমিলঃ কখখক | কখখক || গগ | ঘখখগ
{স্তবক বিন্যাসঃ ৪+৪+২+৪}
উদাহরণঃ
সনেট পঞ্চাশৎ কাব্য: রোগসয্যা

• অন্ত্যমিলঃ কখখক | কখখক || গগ | খঘখঘ
{স্তবক বিন্যাসঃ ৪+৪+২+৪}
উদাহরণঃ
সনেট পঞ্চাশৎ কাব্য: গজল, ফুলের ঘুম
পদচারণ: আমার সনেট।

• অন্ত্যমিলঃ কখখক | কখখক || গগ | খঘঘখ
{স্তবক বিন্যাসঃ ৪+৪+২+৪}
উদাহরণঃ
পদচারণ কাব্য: সনেটসপ্তক- সপ্তক।

• অন্ত্যমিলঃ কখখক কখখক || গগ খকখক
{স্তবক বিন্যাসঃ ৮+৬}
উদাহরণঃ
সনেট পঞ্চাশৎ কাব্য: একদিন।

• অন্ত্যমিলঃ কখখক | কখখক গগ | কগগক
{স্তবক বিন্যাসঃ ৪+৬+৪}
উদাহরণঃ
সনেট পঞ্চাশৎ কাব্য: মুশকিল আশান।

• অন্ত্যমিলঃ কখখক | কখখক || গগগগগগ
{স্তবক বিন্যাসঃ ৪+৪+৬}
উদাহণঃ
সনেট পঞ্চাশৎ কাব্য: প্রতিমা।

• অন্ত্যমিলঃ কখখক | গঘগঘ || ঙঙ | চছচছ
{স্তবক বিন্যাসঃ ৪+৪+২+৪}
উদাহরণঃ
পদচারণ কাব্য: ও।

• অন্ত্যমিলঃ ককখখগগঘঘ || ঙঙচচছছ
{স্তবক বিন্যাসঃ ৮+৬}
উদাহরণঃ
পদচারণ কাব্য: বিলাতে রবীন্দ্রনাথ, কবিতা লেখা।


• অন্ত্যমিলঃ ককখখ | গগঘঘ || ঙঙচচ | ছছ
{স্তবক বিন্যাসঃ ৪+৪+৪+২}
উদাহরণঃ
পদচারণ কাব্য: সনেটসপ্তক- প্রথম

• অন্ত্যমিলঃ ককখখ গগঘঘ ঙঙচচছছ
{স্তবক বিন্যাসঃ ১৪}
উদাহরণঃ
পদচারণ কাব্য: তত্ত্বদর্শীর সিন্ধুদর্শন।


• অন্ত্যমিলঃ কখখক | কখখক || গঘঙগঘঙ
{স্তবক বিন্যাসঃ ৪+৪+৬}
উদাহরণঃ
পদচারণ কাব্য: সনেটসুন্দরী।

• অন্ত্যমিলঃ কখখক | কখখক | গঘঙগ | ঘঙ
{স্তবক বিন্যাসঃ ৪+৪+৪+২}
উদাহরণঃ
অন্যান্য কবিতা: সনেট।

• অন্ত্যমিলঃ কখখক কখখক || গঘঙগঘঙ
{স্তবক বিন্যাসঃ ৮+৬}
উদাহরণঃ
পদচারণ কাব্য: চেরিপম্প।

• অন্ত্যমিলঃ কখখক কখখক গঘঙ গঘঙ
{স্তবক বিন্যাসঃ ১৪}
উদাহরণঃ
পদচারণ কাব্য: বনফুল।

• অন্ত্যমিলঃ কখখক | কখখক || গগ | ঘঙঘঙ
{স্তবক বিন্যাসঃ ৪+৪+২+৪}
উদাহরণঃ
পদচারণ কাব্য: অকালবর্ষা

#প্রমথ চৌধুরীর তিনটি সনেট/চতুর্দশপদী কবিতার উদাহরণঃ-
★ ১.
ঘরকন্না নিয়ে ব্যস্ত | মানব-সমাজ।  ক
মাটির প্রদীপ জ্বেলে | সারানিশি জাগে,  খ
ছোট ঘরে দ্বোর দিয়ে | ছোট সুখ মাগে,  খ
সাধ করে’ গায়ে পরে | পুতুলের সাজ॥  ক

কেনা আর বেচা, আর | যত নিত্য কাজ,  ক
চিরদিন প্রতিদিন ভাল | নাহি লাগে।  খ
আর কিছু আছে কি না, | পরে কিম্বা আগে,  খ
জানিতে বাসনা মোর | মনে জাগে আজ॥  ক

বাহিরের দিকে মন | যাহার প্রবণ,—  গ
সে জানে প্রাণের চেয়ে | অধিক জীবন॥  গ

মন তার যায় তাই | সীমানা ছাড়িয়ে,  ঘ
করিতে অজানা দেশ | খুঁজে আবিষ্কার।  ঙ
দিয়ে কিন্তু মানবের | সাম্রাজ্য গাড়িয়ে,   ঘ
সমাজের তিরস্কার | পায় পুরস্কার!  ঙ

(সনেট পঞ্চাশৎ: মানব সমাজ)
{এখানে অন্ত্যমিলঃ কখখক | কখখক || গগ | ঘঙঘঙ}
[পর্ব বিন্যাসঃ ৮+৬; স্তবক বিন্যাসঃ ৪+৪+২+৪]

★ ২.
বিলাতে গেছে | সে একদিন  ক
সুরে বাঁধা ছিল | কবির বীণ,  ক
দিগন্ত-প্রসারী | ঝংকার যার  খ
আজিও কাঁপায় | মনের তার।  খ
সে সুর ভেঙেছে | নূতন তন্দ্র,  গ
এখন ক্যাঁকায় | মানুষ-যন্ত্র,  গ
দ্যুলোক পড়েছে ধোঁয়ায় চাপা,  ঘ
প্রকৃতির বাণী | কালিতে ছাপা।  ঘ

সহসা তুলেছে | জাগায়ে প্রাণ,  ঙ
পুব হতে এসে | রবির গান,  ঙ
ভারতী যাহার | কলম ধ’রে  চ
নিতি নব গান | রচনা করে,  চ
লিখে রাখে নভে, | জলে ও স্থলে,  ছ
রূপের বারতা | সোনার জলে।  ছ

(পদচারণ: বিলাতে রবীন্দ্রনাথ)
(এখানে অন্ত্যমিলঃ ককখখগগঘঘ || ঙঙচচছছ)
[পর্ব বিন্যাসঃ ৬+৫; স্তবক বিন্যাসঃ ৮+৬]

★ ৩.
সন্ধ্যার ছায়ায় লীন, | মলিন পূরবী!  ক
বিষাদ তোমার চোখে, | অবসাদ প্রাণে।  খ
মগ্ন তুমি হ’য়ে আছ | সূৰ্য্যাস্তের ধ্যানে,  খ
ধূম্ৰ তব কেশপাশে | ধূপের সুরভি।  ক
উদাসিনী তুমি, নও | করুণ ভৈরবী,  ক
উন্মনা তোমার গানে, | মনে সন্ধ্যা আনে।  খ
আঁখি খোঁজে শেষ আলো | অস্তাচলপানে,  খ
লেখে যথা চিত্রস্বর্ণে, | হরফে আরবী,   ক
সূৰ্য্য তার রূপকথা; | পড়িতে না জানি,  গ
নিশায় মিলিত দিবা | স্বপ্ন হেন মানি।  গ
শ্রান্তিভরা শান্তি আছে | তব শ্লথ সুরে,  ঘ
উদাসিনি! তব মন্ত্রে | হ’য়েছি উদাস।  ঙ
তোমার প্রণয়ী ছিল | কবি নিশাপুরে,  ঘ
হে পূরবী! কর মোরে | তব সুরদাস॥  ঙ

(সনেট পঞ্চাশৎ: পূরবী)
{এখানে অন্ত্যমিলঃ কখখক কখখক গগ ঘঙঘঙ}
[পর্ব বিন্যাসঃ ৮+৬; স্তবক বিন্যাসঃ ১৪]

-----★★-----

▪ জীবনানন্দ দাশের সনেট কবিতাঃ
(১৮৯৯-১৯৫৪)
রূপসী বাংলার সনেটগুচ্ছের প্রতিটি পংক্তিতে আবহমান বাংলার রূপ-বৈভবের প্রতিভাস উৎকীর্ণ। জীবনানন্দ এই কাব্যগ্রন্থে বৃক্ষরাজি, ঘাস, নদী, পাখি ইত্যাদির রূপ-সৌন্দর্য নিখুঁতভাবে অংকন করেছেন। রূপসী বাংলার রূপের মধ্যে তিনি খুঁজেছেন লোকজ পুরাণকে, ইতিহাসের প্রবাহমানতাকেও তিনি এড়িয়ে যান নি। অতিলৌকিক আবহ ঘুরে ফিরেই তাঁকে আচ্ছন্ন করেছে। পাতা ঝরে পড়ার বিষণ্নতা থেকেও তিনি সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন নন। প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে মানুষের প্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়াকে তিনি স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করেও দীর্ঘশ্বাস ফেলেছেনঃ
"আমি চলে যাব বলে
চালতাফুল কি আর ভিজিবে না শিশিরের জলে"?

জীবনানন্দ দাশ তার 'রূপসী বাংলা'র বেশির ভাগ কবিতা লিখেছেন ২২ অক্ষরের পঙ্‌ক্তিতে, এবং অনেক কবিতা লিখেছেন ২৬ অক্ষরের পঙ্‌ক্তি যোগে। কোথাও কোথাও সনেটীয় রূপকল্প বজায় রেখেছেন ঠিকই, কিন্তু একই কবিতায় অক্ষরের তারতম্য লক্ষ্য করা গেছে। অনেক সনেটে আবার সনেটীয় ৮+৬ পঙ্‌ক্তির বিভাজন না রেখে মাত্র একটি স্তবকে কবিতা শেষ করেছেন। কবি আবদুল কাদির তাঁর 'ছন্দ সমীক্ষণ পুস্তকে' 'বাংলা সনেটের রূপ ও রীতি' প্রবন্ধে জীবনানন্দ দাশের এসব কবিতাকে 'সনেটের অযত্নখচিত বিস্রস্ত রূপ' হিসাবে উল্লেখ করেছেন।

#জীবনানন্দের সনেট/চতুর্দশপদী কবিতার উদাহরণঃ-

★ জীবনানন্দের ১৮ মাত্রার সনেট/চতুর্দশপদী কবিতার উদাহরণঃ


★ জীবনানন্দের ২২ মাত্রার সনেট/চতুর্দশপদী কবিতার উদাহরণঃ-
(১)
• {আকাশে সাতটি তারা}
আকাশে সাতটি তারা | যখন উঠেছে ফুটে | আমি এই ঘাসে  ক
বসে থাকি; কামরাঙা- | লাল মেঘ যেন মৃত মনিয়ার মতো  খ
গঙ্গাসাগরের ঢেউয়ে | ডুবে গেছে- আসিয়াছে | শান্ত অনুগত  খ
বাংলার নীল সন্ধ্যা- | কেশবতী কন্যা যেন | এসেছে আকাশেঃ ক
আমার চোখের ’পরে | আমার মুখের ’পরে | চুল তার ভাসে;  ক
পৃথিবীর কোনো পথ | এ কন্যারে দেখেনিকো- | দেখি নাই অত  খ
অজস্র চুলের চুমা | হিজলে কাঁঠালে জামে | ঝরে অবিরত, খ
জানি নাই এত স্নিগ্ধ | গন্ধ ঝরে রূপসীর | চুলের বিন্যাসে  ক


পৃথিবীর কোনো পথেঃ | নরম ধানের গন্ধ- | কল্‌মীর ঘ্রাণ,  গ
হাঁসের পালক, শর, | পুকুরের জল, চাঁদা | সরপুটিদের  ঘ
মৃদু ঘ্রাণ, কিশোরীর | চাল ধোয়া ভিজে হাত- | শীত হাতখান,  গ
কিশোরের পায়ে- দলা | মুথা ঘাস,- লাল-লাল | বটের ফলের  ঘ
ব্যথিত গন্ধের ক্লান্ত | নীরবতা- এরি মাঝে | বাংলার প্রাণঃ  গ
আকাশে সাতটি তারা | যখন উঠেছে ফুটে | আমি পাই টের।  ঘ

(পর্ব বিন্যাসঃ ৮+৮+৬)
[এখানে অন্ত্যমিলঃ কখখক কখখক | গঘগঘগঘ]

(২)
• {একদিন জলসিড়ি}
একদিন জলসিড়ি | নদীটির পারে এই | বাংলার মাঠে  ক
বিশীর্ণ বটের নিচে | শুয়ে র’ব;-পশমের | মতো লাল ফল  খ
ঝরিবে বিজন ঘাসে,- | বাঁকা চাঁদ জেগে রবে,- | নদীটির জল  খ
বাঙালী মেয়ের মতো | বিশালাক্ষ্মী  মন্দিরের | ধূসর কপাটে  ক
আঘাত করিয়া যাবে ভয়ে-ভয়ে- তারপর | যেই ভাঙা ঘাটে  ক
রূপসীরা আজ আর | আসেনাকো পাট শুধু | পচে অবিরল,  খ
সেইখানে কলমীর | দামে বেঁধে প্রেতিনীর | মতন কেবল  খ
কাঁদিবে সে সারারাত,- | দেখিবে কখন কারা | এসে আমকাঠে  ক

সাজায়ে রেখেছে চিতাঃ | বাংলার শ্রাবণের | বিস্মিত আকাশ  গ
চেয়ে র’বে; ভিজে পেঁচা | শান্ত স্নিগ্ধ চোখ মেলে | কদমের বনে ঘ
শোনাবে লক্ষ্মীর গল্প- | ভাসানের গান নদী | শোনাবে নির্জনে;  ঘ
চারিদিকে বাংলার | ধানী শাড়ি- শাদা শাঁখা- | বাংলার ঘাস  গ
আকন্দ বাসকলতা | ঘেরা এক নীল মঠ- | আপনার মনে  ঘ
ভাঙিতেছে ধীরে-ধীরে;- | চারিদিকে এই সব | আশ্বর্য উচ্ছ্বাস-  গ

পর্ব বিন্যাসঃ ৮+৮+৬)
[এখানে অন্ত্যমিলঃ কখখক কখখক | গঘঘগঘগ]

★ জীবনানন্দের ২৬ মাত্রার সনেট/চতুর্দশপদী কবিতার উদাহরণঃ-

(১)
• {বাতাসে ধানের শব্দ}
বাতাসে ধানের শব্দ শুনিয়াছি- ঝরিতেছে ধীরে ধীরে অপরাহ্ন ভ’রে;  ক
সোনালী রোদের রঙ দেখিয়াছি-দেহের প্রথম কোন্‌ প্রেমের মতন  খ
রূপ তার- এলোচুল ছড়ায়ে রেখেছে ঢেকে গুঢ় রূপ-আনারস বন;  খ
ঘাস আমি দেখিয়াছি; দেখেছি সজনে ফুল চুপে-চুপে পড়িতেছে ঝ’রে  ক
মৃদু ঘাসে; শান্তি পায়; দেখেছি হলুদ পাখি বহুক্ষণ থাকে চুপ ক’রে,  ক
নির্জন আমের ডালে দুলে যায়- দুলে যায়- বাতাসের সাথে বহুক্ষণ;  খ
শুধু কথা, গান নয়- নীরবতা রচিতেছে আমাদের সবার জীবন  খ
বুঝিয়াছিঃ শুপুরীর সারিগুলো দিনরাত হাওয়ায় যে উঠিতেছে ন’ড়ে,  ক


দিনরাত কথা কয়, ক্ষীরের মতন ফুল বুকে ধরে, তাদের উৎসব  গ
ফুরায় না; মাছরাঙাটির সাথী ম’রে গেছে- দুপুরের নিঃসঙ্গ বাতাসে  ঘ
তবু ঐ পাখিটির নীল লাল কমলা রঙের ডানা স্ফুট হ’য়ে ভাসে  ঘ
আম জাম জামরুলে প্রসন্ন প্রাণের স্রোত- অশ্রু নাই- প্রশ্ন নাই কিছু,  ঙ
ঝিলমিল ডানা নিয়ে উড়ে যায় আকাশের থেকে দূর আকাশের পিছু;  ঙ
চে’য়ে দেখি ঘুম নাই- অশ্রু নাই- প্রশ্ন নাই বটফলগন্ধ-মাখা ঘাসে।  ঘ

(এ কবিতায় পর্ব বিন্যাসে গড়মিল লক্ষ্য করা যায় সুতরাং কবিতাটি এক পর্বে শেষ হয়েছে ধরা যায়)
[এখানে অন্ত্যমিলঃ কখখক কখখক গঘঘঙঙঘ]

(২)
• {পৃথিবীর পথে আমি}
পৃথিবীর পথে আমি বহুদিন বাস ক’রে হৃদয়ের নরম কাতর  ক
অনেক নিভৃত কথা জানিয়াছি; পৃথিবীতে আমি বহুদিন  খ
কাটায়েছি; বনে-বনে ডালপালা উড়িতেছে- যেন পরী জিন  খ
কথা কয়; ধূসর সন্ধ্যায় আমি ইহাদের শরীরের ’পর  ক
খইয়ের ধানের মতো আমি দেখিয়াছি ঝরে ঝ্‌র ঝ্‌র  ক
দু’-ফোঁটা মাঘের বৃষ্টি-শাদা ধুলো জলে ভিজে হয়েছে মলিন,  খ
ম্লান গন্ধ মাঠে ক্ষেতে- গুবরে পোকার তুচ্ছ বুক থেকে ক্ষীণ  খ
অস্ফুট করুণ শব্দ ডুবিতেছে অন্ধকারে নদীর ভিতরঃ  ক


এই সব দেখিয়াছি;- দেখিয়াছি নদীটিরে- মজিতেছে ঢালু অন্ধকারে;  গ
সাপমাসী উড়ে যায়; দাঁড়কাক অশ্বত্থের নীড়ের ভিতর  ক
পাখ্‌নার শব্দ করে অবিরাম; কুয়াশায় একাকী মাঠের ঐ ধারে  গ
কে যেন দাঁড়ায়ে আছে; আরো দূরে দু’-একটা স্তব্ধ খোড়ো ঘর  ক
প’ড়ে আছে; খাগড়ার বনে ব্যাং ডাকে কেন- থামিতে কি পারে;  গ
(কাকের তরুণ ডিম পিছলায়ে প’ড়ে যায় শ্যাওড়ার ঝাড়ে।)    গ

(এ কবিতায় পর্ব বিন্যাসে গড়মিল লক্ষ্য করা যায় সুতরাং কবিতাটি এক পর্বে শেষ হয়েছে ধরা যায়)
[এখানে অন্ত্যমিলঃ কখখক কখখক গকগকগগ]

-------★★------

→চলবে...