বিমুর্তবাদ বা বিমূর্ততাবাদ (Abstractionism) সাহিত্যে ও শিল্পকলার একটি ধারা, যেখানে প্রতীক ও ভাবনাকে সরাসরি উপস্থাপন না করে নানা রকম বিমূর্ত ইঙ্গিত ও রূপকের মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়। বিমূর্তবাদ (abstructionism) ধারনায়, আকৃতি, ফর্ম, রঙ এবং লাইনের ভিজ্যুয়াল ভাষা ব্যবহার করে এমন একটি রচনা তৈরি করা হয়, যা দর্শককে পৃথিবীর দৃশ্যমান বাস্তবতার বাইরে দাঁড় করায়। এই শিল্পে প্রকৃতির বা বস্তুজগতের সরাসরি চিত্রায়ণ করা হয় না, বরং শিল্পী নিজস্ব ধ্যান-ধারণা ও অনুভূতির রূপ প্রকাশ করে থাকেন। বিমূর্ত শিল্পের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো এর স্বাধীনতা, যেখানে শিল্পী দৃশ্যমান বাস্তবতার বাইরে গিয়ে নিজের মনের ভাবনা ও কল্পনাকে নতুন আকারে ফুটিয়ে তোলেন।
রেনেসাঁ থেকে উনিশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত, পশ্চিমা শিল্প দৃশ্যমান বাস্তবতার বস্তুনিষ্ঠ পুনরুৎপাদনের দিকে ঝুঁকেছিল, যেখানে দৃষ্টিভঙ্গি ও বস্তুর সুনির্দিষ্ট বর্ণনা ছিল মুখ্য। তবে, উনিশ শতকের শেষ দিকে শিল্পীরা অনুভব করতে থাকেন যে, প্রযুক্তি, বিজ্ঞান ও দর্শনের পরিবর্তনকে শিল্পে প্রতিফলিত করার জন্য নতুন কৌশল ও ধারা প্রয়োজন। এর ফলে বিমূর্ত শিল্পের উত্থান ঘটে, যেখানে চাক্ষুষ অভিজ্ঞতার বাইরে গিয়ে এক নতুন ধরনের রূপ প্রকাশ পায়। বিমূর্ত শিল্পকে বিভিন্ন নামে ডাকা হয়, যেমন অবয়বহীন শিল্প, অবস্তুগত শিল্প, বা অপ্রতিনিধিত্বমূলক শিল্প। যদিও এ সবই প্রায় একই অর্থ বহন করে, তবে তাদের মধ্যে কিছু সূক্ষ্ম পার্থক্য আছে। বিমূর্ত শিল্পের মধ্যে জ্যামিতিক বিমূর্ততা একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারা, যেখানে কোনো প্রকৃতি বা বাস্তব জীবনের রূপ স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয় না। ফভিজম এবং কিউবিজমের মতো আন্দোলনগুলি এই ধরণের বিমূর্ততার উদাহরণ, যেখানে রঙ এবং ফর্মের মাধ্যমে বাস্তবতার ভিন্ন রূপ প্রকাশ করা হয়। বিমূর্ত শিল্পের বিকাশে রোমান্টিকতা, ইমপ্রেশনবাদ এবং এক্সপ্রেশনবাদের মতো আন্দোলনগুলিও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে, কারণ তারা শিল্পীকে বাস্তবতার বাইরে গিয়ে মনের গভীর ভাব প্রকাশ করার পথ দেখায়। সর্বোপরি, বিমূর্ত শিল্প এমন এক মাধ্যম, যা বাস্তব জগতের রূপ থেকে মুক্ত হয়ে শিল্পীকে চিন্তা ও অনুভূতির মাধ্যমে এক নতুন জগতে প্রবেশের সুযোগ দেয়।
শিল্পকলার ছয় কলা অর্থাৎ সাহিত্য, চিত্রকলা, ভাস্কর্য, সঙ্গীত, নৃত্য এবং চলচ্চিত্র এর মধ্যে চিত্রকলা এবং ভাস্কর্যে বিমূর্তবাদের আধিপত্য দেখা যায় সবচেয়ে বেশি, কিন্তু সাহিত্যের নানা শাখায়ও বিমূর্তবাদের প্রকাশ দেখা যায় বেশ, বিশেষ করে, বাংলা কবিতায় বিমূর্তবাদ একটি গঠনমূলক সাহিত্যিক ধারা, যেখানে কবির মনন ও কল্পনার জগতের বহিঃপ্রকাশ ঘটে জটিল, আড়ালপূর্ণ, এবং রহস্যময় রূপে। বিমূর্ত কবিতায় বাস্তবতা সরাসরি প্রতিফলিত না হয়ে, ছায়াময় ইঙ্গিত, রূপক, এবং অনুভূতির মাধ্যমে প্রকাশিত হয়। বাংলা সাহিত্যের অগ্রদূতেরা তাদের চিন্তা-ভাবনা এবং অনুভূতিকে কখনো সরাসরি প্রকাশ না করে বিমূর্ততার আশ্রয়ে পাঠকের সামনে তুলে ধরেছেন, যা পাঠককে নিজস্ব অভিজ্ঞতার আলোকে বোঝার সুযোগ দেয়।
বিমূর্তবাদের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস: বিমূর্তবাদ (Abstractionism) একটি শিল্প ও সাহিত্যধারা, যেখানে রূপ, আকার, বা দৃশ্যের পরিবর্তে চিন্তা, অনুভূতি, এবং ধারণাকে মূল ফোকাস হিসেবে নেওয়া হয়। বিমূর্তবাদ কোনো নির্দিষ্ট চিত্র বা বস্তুর সঙ্গে সম্পৃক্ত না থেকে, মননের গভীরে প্রবেশ করে অনুভব বা দর্শনের অমূর্ত প্রকাশ ঘটায়। কবিতায় বিমূর্তবাদ সাধারণত দৃশ্যমান চিত্র বা বাস্তবতার সরাসরি প্রতিফলন না দিয়ে একটি অনুভূতিমূলক পরিবেশ তৈরি করে, যা পাঠকের কল্পনা এবং অভিজ্ঞতার উপর নির্ভর করে অর্থ খুঁজে নেয়।
১. উত্থান ও প্রাথমিক ধারণা: বিমূর্তবাদের মূল উত্থান উনিশ শতকের শেষ এবং বিশ শতকের শুরুর দিকে ঘটে। শিল্পকলার ক্ষেত্রে এর সূচনা হলেও পরবর্তীতে সাহিত্যেও এর প্রভাব বিস্তার করে। আধুনিক শিল্প আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে বিমূর্তবাদ মূলত শিল্প ও সাহিত্যে বাস্তবতাবাদ বা প্রাকৃতিক রূপের সরাসরি চিত্রায়ণের বিপরীতে আবির্ভূত হয়। শিল্পকলায় যেমন কাজিমির মালেভিচ, পিট মন্ড্রিয়ান, এবং ভাসিলি কান্দিনস্কির মতো শিল্পীরা বিমূর্ত শৈলীতে কাজ করেছেন, তেমনই সাহিত্যে চিন্তা ও অনুভূতির বিমূর্ত প্রকাশ জনপ্রিয়তা পায়।
২. শিল্পকলায় বিমূর্তবাদের উত্থান: শিল্পকলায় বিমূর্তবাদের পথিকৃৎ ভাসিলি কান্দিনস্কি (Vasily Kandinsky), যিনি মনে করতেন যে শিল্পকর্মের উদ্দেশ্য কেবল চাক্ষুষ বাস্তবতার পুনরুৎপাদন করা নয়, বরং অনুভূতির গভীর স্তরকে প্রকাশ করা। তাঁর বিশ্বাস ছিল যে রং এবং আকারের মাধ্যমে এমন এক অভিজ্ঞতা সৃষ্টি করা সম্ভব, যা বস্তুর নির্দিষ্টতাকে ছাড়িয়ে যায়। ১৯১০-এর দশকের দিকে, শিল্পকলার বিমূর্তবাদ বিস্তৃত হতে থাকে এবং "অবজেক্টলেস" বা "নির্গঠন" শিল্পের উত্থান ঘটে। ছবিতে বস্তু বা ব্যক্তির নির্দিষ্ট রূপ বা আকার ছাড়াই আবেগের প্রকাশ ঘটানোই ছিল এর মূল লক্ষ্য।
৩. সাহিত্যে বিমূর্তবাদের প্রভাব: বিমূর্তবাদের এই ধারা পরবর্তীতে সাহিত্যেও প্রভাব ফেলে, যেখানে কবিতায় বা গল্পে বস্তুগত ঘটনা বা চরিত্রের পরিবর্তে ভাবনা, অনুভূতি, এবং দর্শনের জটিল ও গভীর স্তর ফুটিয়ে তোলা হয়। সাহিত্যে বিমূর্তবাদের ক্ষেত্রে স্পষ্ট বাস্তবতাকে পাশ কাটিয়ে ইঙ্গিতপূর্ণ এবং প্রতীকী ভাষার মাধ্যমে চিন্তা ও অনুভূতির প্রতিফলন করা হয়। এর মাধ্যমে লেখক সরাসরি কোনো দৃশ্য বা ঘটনার বর্ণনা না দিয়ে পাঠকের মনের মধ্যে কল্পনার বিস্তার ঘটাতে চেষ্টা করেন। বাংলা কবিতায় বিমূর্ততার যাত্রা মূলত বিশ শতকের প্রথমার্ধে শুরু হয়।
কবিতায় বিমূর্তবাদ এমন এক সাহিত্যিক ধারা যেখানে কবি সরাসরি কোনো চিত্র, ঘটনা, বা বস্তুর বর্ণনা না দিয়ে অনুভূতি, ভাবনা, এবং দর্শনের বিমূর্ত প্রকাশ ঘটান। এটি এমনভাবে রচনা করা হয়, যা পাঠকের কল্পনা এবং অভিজ্ঞতার ওপর নির্ভরশীল। কবিতায় বাস্তব দৃশ্য বা ঘটনার নির্দিষ্ট চিত্রায়ণ না থাকলেও প্রতীকের মাধ্যমে কবিতার গভীর ভাবনা প্রকাশ পায়। বিমূর্তবাদী কবিতার একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো এর অস্পষ্টতা, যা পাঠককে কবিতার অর্থ খুঁজে পেতে উৎসাহিত করে। পাঠক তার ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গি ও অভিজ্ঞতার আলোকে কবিতার অর্থ নির্ধারণ করেন।
বিমুর্তবাদী কবিতা সাধারণত পাঠকের সামনে সরাসরি কোনো গল্প বা ঘটনার বর্ণনা দেয় না, বরং শব্দের গভীরতা, ভাবনাগুলির মিশ্রণ, এবং আলগা ধারণার মাধ্যমে একটি নির্দিষ্ট মনের অবস্থা বা অনুভূতি তুলে ধরে। বিমূর্তবাদ একটি জটিল ও গভীর ভাবধারা যেখানে কবি সরাসরি প্রকাশের বদলে অনুভূতির ধোঁয়াশা তৈরি করে পাঠককে নিজস্ব অর্থ খুঁজে পেতে উদ্বুদ্ধ করেন। বাংলা সাহিত্যে বিমূর্তবাদ একটি বিশেষ ধারার প্রকাশ যেখানে কল্পনা, অনুভূতি, ও ভাবের গভীরতা প্রতিফলিত হয়, তবে তা সরাসরি নয়। বিমূর্ততা মানে নির্দিষ্ট কোনো রূপ বা আকারের বদলে চিন্তা ও অনুভূতিকে মুক্তভাবে প্রকাশ করা। বাংলা কবিতায় এই বিমূর্ত ধারা মূলত চিন্তা ও অনুভূতির জটিল রূপের প্রকাশ যা সরাসরি পাঠকের কাছে ধরা পড়ে না। পাঠককে সেই অর্থ খুঁজে নিতে হয় নিজেদের অভিজ্ঞতা ও কল্পনার জগতে, যেমন-
অদেখা বীজে বোনা ঘাসের ডানায়,
একলা পাখির ডাক ভেসে আসে,
শব্দহীন সুরের মাঝে মিলায়
অন্ধকার আলোয় লেগে আছে।
এই ধরনের কবিতা সরাসরি কোনো দৃশ্য বা ঘটনার কথা না বলে, কেবল চিন্তা বা অনুভূতির ইঙ্গিত দেয়। পাঠক তার নিজের মনের মধ্যে সেই অর্থ খুঁজে পায়, যা বিমূর্ত কবিতার মূল সুর। বিমূর্ত কবিতা পাঠের এক অন্যরকম অভিজ্ঞতা তৈরি করে, যেখানে প্রতিটি পাঠক তার নিজের মতো করে কবিতাকে উপলব্ধি করে। কবিতায় বিমূর্তা ধারায় কয়েকটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য দেখা যায় যেমন-
১। শব্দের এবং ভাষার খেলা: বিমূর্ত কবিতায় ভাষা এক ধরনের খেলার মাধ্যমে প্রকাশিত হয়। শব্দের গভীরতা, সুর, এবং ছন্দময়তা পাঠকের কাছে একাধিক অর্থ তৈরি করে। কবি এখানে ভাষার মাধ্যমে বহুমুখী ব্যাখ্যার সুযোগ দেন। ভাষার সঙ্গে এই খেলা চলে, যেখানে শব্দগুলো সরাসরি কোনো ধারণাকে প্রকাশ না করে, কেবল আবছা ইঙ্গিত দেয়। এই ধরনের কবিতা অনেক সময় একাধিক স্তরে অর্থ তৈরি করে। কবিতায় সরাসরি বক্তব্য না থাকলেও শব্দের বিন্যাস ও ছন্দময়তা এক বিশেষ অর্থ তৈরি করবে। উদাহরণস্বরূপ, শব্দগুলো একের পর এক ভেসে উঠবে, কিন্তু তা স্পষ্ট অর্থ প্রদান করবে না।
২। ভাবের আভাস বা ইঙ্গিতময়তা: বিমুর্ত কবিতায় কোনো নির্দিষ্ট বিষয়বস্তু না থাকলেও পাঠকের মনের উপর অনুভূতির একটা ছাপ পড়ে। এটি হতে পারে একটি নির্দিষ্ট দৃশ্য বা অনুভূতির বিমূর্ত প্রকাশ। এই কবিতায় ভাব বা চিন্তাধারাকে সরাসরি না বলে ধীরে ধীরে ইঙ্গিত দেওয়া হয়। একটি নির্দিষ্ট ভাব বা বিষয়কে প্রকাশ করার বদলে বিভিন্ন ছাপ দিয়ে তা তুলে ধরা হয়।
৩। চিত্রকল্পের মিশ্রণ: সাধারণ চিত্রকল্পের সাথে অস্বাভাবিক বা অসম্পূর্ণ চিত্রের মিশ্রণ ঘটে, যা পাঠককে চিন্তার জগতে নিয়ে যায়।
৪। চিন্তার গভীরতা: বিমূর্ত কবিতায় সরাসরি কোনো অর্থ প্রকাশিত হয় না, বরং এটি চিন্তা বা অনুভূতির দোলাচলের মাধ্যমে নিজেকে তুলে ধরে। পাঠককে একে অনুধাবন করতে হয়।
৫। রূপক ও প্রতীকের ব্যবহার: বিমূর্ত কবিতায় সরাসরি চিত্র বা ঘটনা প্রকাশ না করে প্রতীকের মাধ্যমে ভাব প্রকাশ করা হয়। প্রতীকগুলো বাস্তব জগতের সাথে মিল থাকতে পারে, কিন্তু তা কখনো সরাসরি ঘটনার বা বস্তুগত দিকের প্রতিফলন নয়। মুলত, প্রতীক এবং রূপকের মাধ্যমে বিমূর্ত কবিতা অনুভূতির জটিলতা প্রকাশ করে, কবিতায় গভীরতা এবং ব্যাখ্যার স্তর তৈরি হয়, যা পাঠকের নিজের উপলব্ধির উপর নির্ভর করে।
৬। অস্পষ্টতা ও রহস্য: বিমূর্ত কবিতার একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো এর ভাষা বা উপমা অস্পষ্টতা থাকে। অনেক সময় কবিতার অর্থ বা বিষয় সরাসরি বোঝা যায় না, যা কবিতাকে রহস্যময় করে তোলে এবং পাঠককে নতুন অর্থ খুঁজে পেতে উদ্বুদ্ধ করে। তবে সেই অস্পষ্টতাই কবিতার মূল শক্তি, কারণ তা পাঠককে নিজের মতো করে বুঝতে ও অনুভব করতে উদ্বুদ্ধ করে।
মূলত, অ্যাবস্ট্রাক্ট বা বিমূর্ত কবিতা এমন একটি কবিতার রূপ যা আইডিয়া, অনুভূতি এবং অভিজ্ঞতাকে গুরুত্ব দেয় এমন ভাষার মাধ্যমে, যা প্রচলিত কাহিনী গঠনের কাঠামো বা কংক্রিট চিত্রাবলীর সঙ্গে মেলে না। নির্দিষ্ট বিষয় বা স্পষ্ট অর্থের পরিবর্তে, অ্যাবস্ট্রাক্ট কবিতা প্রায়ই একটি মুক্ত শৈলী গ্রহণ করে, অনুভূতি উদ্দীপিত করতে বা চিন্তা উত্সাহিত করতে নতুনভাবে ভাষার ব্যবহার করে। বিশ্ব সাহিত্যের কবিতায় বিমূর্ততার উদাহরন-
১। Gertrude Stein - তার কাজগুলি প্রথাগত কাহিনীকে অস্বীকার করে এবং পুনরাবৃত্তি এবং সুরকে গ্রহণ করে, যেমন "Tender Buttons."।
২। Ezra Pound - তার কবিতা "In a Station of the Metro" উজ্জ্বল চিত্রাবলী ব্যবহার করে যা সরাসরি একটি গল্প বলার পরিবর্তে অনুভূতি উত্পন্ন করে।
৩। William Carlos Williams - "The Red Wheelbarrow" এর মতো কবিতা সহজ চিত্রাবলী ব্যবহার করে গভীর অর্থ প্রকাশ করে, যা প্রায়ই ব্যাখ্যার জন্য উন্মুক্ত থাকে।
৪। T.S. Eliot "The Waste Land," এ, এলিয়ট ভাঙা আইডিয়া এবং বিমূর্ত ধারণাগুলি মিশ্রিত করে, একটি জটিল অর্থের পটভূমি তৈরি করে।
বাংলা কবিতায় বিমূর্ততার বিবর্তন:
বাংলা কবিতায় বিমূর্ততার যাত্রা মূলত বিশ শতকের প্রথমার্ধে শুরু হয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জীবনানন্দ দাশ, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত প্রমুখ কবির কবিতায় বিমূর্ততার সূচনা দেখা যায়। তারা প্রকৃতি, জীবন, মৃত্যু, সময় এবং একাকিত্বকে গভীর, রহস্যময়ভাবে প্রকাশ করেছেন। তারা বিমূর্ততার মধ্য দিয়ে তাদের চিন্তা-চেতনা এবং দার্শনিক জিজ্ঞাসা তুলে ধরেছেন। বাংলা সাহিত্যের অনেক কবি তাদের সৃষ্টিকর্মে বিমূর্ততাকে অন্তর্ভুক্ত করেছেন। এদের প্রতিটি কবির রচনায় বিমূর্ততার ভিন্নতা এবং গভীরতা লক্ষণীয়, যা বাংলা কবিতাকে সমৃদ্ধ করেছে।
১। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর: রবীন্দ্রনাথের কবিতায় বিমূর্ততার সুর আছে, যদিও তিনি সরাসরি বিমূর্ত কবি নন। তাঁর কবিতার অনেক জায়গায় সরাসরি বাস্তবতা নয়, বরং অনুভব, দর্শন এবং মানবমনের অন্তর্গত রহস্যের বিমূর্ত প্রকাশ ঘটে। যেমন, তাঁর "গীতাঞ্জলি" কাব্যগ্রন্থে দেখা যায় আত্মার জিজ্ঞাসা, ঈশ্বরের সাথে সম্পর্ক ইত্যাদি বিষয়গুলো অত্যন্ত বিমূর্তভাবে প্রকাশিত হয়েছে, উদাহরণ:
আমার মুখের কথা কেবল আমার নয়,
কান পেতে রহিয়াছে তোমার মুখপানে।
কোনো কথা বলিতে চাই না—
তবুও যেন কথা আসে নেমে।
২। জীবনানন্দ দাশ: বাংলা সাহিত্যে বিমূর্ত কবিতার অন্যতম প্রধান কবি জীবনানন্দ দাশ। তার কবিতায় সময়, মৃত্যু, নিঃসঙ্গতা, এবং প্রকৃতি গভীর বিমূর্ততা নিয়ে হাজির হয়। তাঁর রচনায় নিস্তব্ধতা, অন্ধকার এবং সময়ের ধীরগতির মধ্যে বিমূর্ততা ধরা দেয়। তাঁর কবিতার চিত্রকল্প এবং প্রতীকের ব্যবহারও বিমূর্ততার পরিচায়ক। তিনি কখনো সরাসরি অনুভূতি বা ঘটনা বলার বদলে তাদের ইঙ্গিত দিয়ে গেছেন, উদাহরণ:
বনলতা সেন:
হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে,
সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয় সাগরে অনেক ঘুরেছি আমি;
বিম্বিসার অশোকের ধূসর জগতে সেখানে ছিলাম আমি;
আরো দূর অন্ধকারে বিদর্ভ নগরে;
আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন,
আমারে দুদণ্ড শান্তি দিয়েছিল নাটোরের বনলতা সেন।
এই কবিতায় সময় এবং ইতিহাসের সাথে কবির সম্পর্ক অত্যন্ত বিমূর্তভাবে প্রকাশিত হয়েছে। সুনির্দিষ্ট কোনো ঘটনার কথা বলা হচ্ছে না, বরং একটি প্রতীকী সময়ের ধারণা দেওয়া হচ্ছে। জীবনানন্দ দাশ এর উল্লেখযোগ্য রচনা: রূপসী বাংলা, বনলতা সেন, মহাপৃথিবী
৩। সুধীন্দ্রনাথ দত্ত: সুধীন্দ্রনাথ দত্তের কবিতায় বিমূর্ততা এবং জটিল দার্শনিক চিন্তাধারা পাওয়া যায়। তাঁর রচনায় চেতনাগত প্রশ্ন ও অভিজ্ঞতার জটিলতা গভীরভাবে ফুটে ওঠে, যা পাঠককে ভাবনার নতুন দিগন্তে নিয়ে যায়। বিমূর্ততার মাধ্যমে মানবিক অস্তিত্ব এবং সময়ের অসীমতার ধারণা তিনি কবিতায় তুলে ধরেছেন, উদাহরণ:
তোমার সোনার মুদ্রা আমার পকেটে জমা নাই,
তবুও প্রতিমুহূর্তে তোমার সেই অন্ধ মুদ্রার খোঁজে রাত্রি।
রাত্রির মধ্য দিয়ে আমি—তুমি ছুঁতে থাকো নীরবতায়।
এই ধরনের কবিতা পাঠকের চিন্তার জগতে নতুন মাত্রা তৈরি করে। এখানে কোনো নির্দিষ্ট ঘটনা বা দৃশ্য নেই, বরং একধরনের বিমূর্ত বোধের ইঙ্গিত দেওয়া হচ্ছে। সুধীন্দ্রনাথ দত্ত এর উল্লেখযোগ্য রচনা: সংবর্ত, উত্তরফাল্গু
৪। বুদ্ধদেব বসু: বুদ্ধদেব বসু ছিলেন আধুনিক বাংলা সাহিত্যের এক গুরুত্বপূর্ণ কবি। তাঁর কবিতায় বিমূর্ততার ছাপ স্পষ্ট। প্রেম, একাকিত্ব, এবং মানবিক সম্পর্কের জটিলতা তাঁর কবিতায় বিমূর্তভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। বুদ্ধদেব বসুর উল্লেখযোগ্য রচনা: তিথিডোর, রাত্রির রূপকথা
৫। অমিয় চক্রবর্তী: অমিয় চক্রবর্তীর কবিতায় গভীর দার্শনিক চিন্তা এবং বিমূর্ত প্রকাশ দেখতে পাওয়া যায়। তাঁর কবিতায় মানব মননের নানা দিক এবং জীবনের জটিলতা বিমূর্ততার আকারে প্রকাশিত হয়েছে। অমিয় চক্রবর্তীর উল্লেখযোগ্য রচনা: কবিতাসংগ্রহ, প্রতিধ্বনি
৬। শক্তি চট্টোপাধ্যায়: শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতায় বিমূর্ততার মাধ্যমে বেদনাবোধ, আত্মঅন্বেষণ এবং জীবন দর্শনের বিভিন্ন দিক ফুটে ওঠে। তাঁর কবিতায় চিত্রকল্প এবং ইমেজারি শক্তিশালী, যা বিমূর্ততার অন্যতম উদাহরণ। শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের উল্লেখযোগ্য রচনা: যেতে পারি কিন্তু কেন যাব, ধূসর পান্ডুলিপি
৭। সুভাষ মুখোপাধ্যায়:
সুভাষ মুখোপাধ্যায় একজন প্রগতিশীল কবি হলেও তাঁর কবিতায় বিমূর্ততার ছাপ স্পষ্ট। তিনি তাঁর কবিতার মাধ্যমে মানুষের মনোজগতের গভীরতা ও সামাজিক বাস্তবতাকে বিমূর্তভাবে তুলে ধরেছেন। সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের উল্লেখযোগ্য রচনা: পদাতিক, জলফড়িং
৮। শঙ্খ ঘোষ: শঙ্খ ঘোষের কবিতায় মানবিক বেদনা, সামাজিক অবক্ষয়, এবং সম্পর্কের জটিলতা বিমূর্তভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। তাঁর ভাষা এবং রূপকের ব্যবহার তাঁকে বিমূর্ত ধারার কবি হিসেবে চিহ্নিত করে। শঙ্খ ঘোষের উল্লেখযোগ্য রচনা: বাবরের প্রার্থনা, মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে
৯। আল মাহমুদ: আধুনিক বাংলা কবিতায় আল মাহমুদের কবিতায় বিমূর্ততার একটি বিশেষ ধারা দেখা যায়। তাঁর কবিতায় ধর্ম, দেশপ্রেম, এবং ব্যক্তিগত অনুভূতির মিশ্রণে বিমূর্ত প্রকাশ ঘটেছে। আল মাহমুদের উল্লেখযোগ্য রচনা: সোনালী কাবিন, বখতিয়ারের ঘোড়া
১০। আহসান হাবীব: আহসান হাবীব ছিলেন একজন আধুনিক কবি, যিনি বিমূর্ততার মাধ্যমে তাঁর অনুভূতি ও চিন্তাধারাকে ফুটিয়ে তুলেছেন। তাঁর কবিতায় সমাজের জটিল বাস্তবতা এবং ব্যক্তিগত বেদনা বিমূর্তভাবে প্রকাশিত হয়। আহসান হাবীবের উল্লেখযোগ্য রচনা: রাত্রির কবিতা, ছায়াহীন মানুষ
১১। আবুল হাসান: আবুল হাসানের কবিতায় গভীর বিমূর্ততা এবং মননের প্রতিফলন দেখা যায়। তাঁর কবিতায় প্রেম, দুঃখবোধ, এবং সময়ের বিমূর্ত চিত্রায়ণ পাঠককে ভাবতে বাধ্য করে। আবুল হাসানের উল্লেখযোগ্য রচনা: জীবন আমার বোন, অন্ধকারে সন্ধান
১২। শামসুর রাহমান: শামসুর রাহমানের কবিতায় দেশপ্রেম, সামাজিক দ্বন্দ্ব এবং ব্যক্তিগত বেদনার বিমূর্ত প্রকাশ পাওয়া যায়। তাঁর কবিতায় চিত্রকল্পের মাধ্যমে বিমূর্ত অনুভূতির সৃষ্টি হয়েছে। শামসুর রাহমানের উল্লেখযোগ্য রচনা: বন্দি শিবির থেকে, দুঃসময়ের মুখোমুখি
১৩। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়: সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতায় প্রেম, সময়, এবং সামাজিক বাস্তবতার বিমূর্ত প্রকাশ লক্ষণীয়। তাঁর কবিতার গভীরতা এবং চিন্তার ধারা তাঁকে বিমূর্ততার স্রোতে ভাসিয়েছে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের উল্লেখযোগ্য রচনা: অর্ধেক জীবন, ভালো আছি ভালো থেকো
কবিতায় বিমূর্ততা, উপমা, রূপক এর ব্যবহারঃ
কবিতায় বিমূর্ততা, উপমা, এবং রূপক—এই তিনটি ধারণা বিভিন্নভাবে ব্যবহার করা হয়, তবে প্রতিটি ধারণার আলাদা বৈশিষ্ট্য এবং ব্যবহার আছে। এগুলোর মধ্যে প্রধান পার্থক্য হলো কীভাবে তারা ভাব, অর্থ, বা চিত্রকে প্রকাশ করে।
১. বিমূর্ততা (Abstractionism): বিমূর্ততা হলো কোনো নির্দিষ্ট, দৃশ্যমান বা বস্তুরূপকে সরাসরি না দেখিয়ে সেই বস্তুর বা ভাবনার একটি অস্পষ্ট, অনুভূতিমূলক, অথবা ধারণাগত প্রকাশ। বিমূর্ত কবিতায় সাধারণত কোনো নির্দিষ্ট ঘটনা বা ছবি সরাসরি বর্ণিত হয় না, বরং পাঠকের মননে নানা ভাবনার জন্ম দেয়। এই ধরনের কবিতায় বস্তুর সুনির্দিষ্টতা কম থাকে, কিন্তু অনুভূতির গভীরতা থাকে বেশি, এবং এর বৈশিষ্ট্যগুলো-স্পষ্ট চিত্র বা ঘটনা নেই, চিন্তা বা অনুভূতির ইঙ্গিত থাকে, এবং পাঠকের কল্পনার উপর নির্ভর করে অর্থ খুঁজে নেওয়া, উদাহরণ:
অন্ধকারের মাঝে ভেসে ওঠা
আলোর শূন্যতা, আর কিছুই না—
শব্দের সুরে হারায় সকল রং।
এখানে কোনো নির্দিষ্ট দৃশ্য বা বস্তুর কথা বলা হয়নি, বরং একটি অনুভূতি বা অবস্থা তুলে ধরা হয়েছে।
২. উপমা (Simile): উপমা হলো এক ধরনের তুলনা, যেখানে এক বস্তু বা ভাবকে অন্য একটি বস্তুর সাথে তুলনা করে বিশেষণের মাধ্যমে তা প্রকাশ করা হয়। সাধারণত "যেন," "মতো," "প্রতীত," ইত্যাদি শব্দের মাধ্যমে উপমা গঠিত হয়। এটি একটি সরাসরি তুলনা, যা দুটি বস্তুর মধ্যে মিলের ইঙ্গিত দেয় এবং এর বৈশিষ্ট্য হলো-সরাসরি তুলনা করা হয়, "যেন," "মতো," "প্রতীত" ইত্যাদি শব্দ ব্যবহৃত হয়, উদাহরণ:
তোমার মুখ যেন পূর্ণিমার চাঁদ।
এখানে সরাসরি মুখের সৌন্দর্যকে চাঁদের সাথে তুলনা করা হয়েছে।
৩. রূপক (Metaphor): রূপক হলো একটি কৌশল, যেখানে একটি বস্তু বা ভাবের জন্য অন্য একটি বস্তুকে সরাসরি প্রতিস্থাপন করা হয়, কিন্তু উপমার মতো "যেন" বা "মতো" ব্যবহার করা হয় না। রূপক সরাসরি একটি বস্তুর সাথে অন্য একটি বস্তুর পরিচয় বা সাদৃশ্য স্থাপন করে। অর্থাৎ, এক বস্তু বা ভাবকে অন্যের প্রতীক বা মূর্তরূপে দেখা হয় এবং এর বৈশিষ্ট্য হলো-সরাসরি অন্য একটি বস্তু বা ধারণার সাথে তুলনা করা হয়, "যেন" বা "মতো" ব্যবহার করা হয় না, উদাহরণ:
তুমি আমার জীবনের আলো
এখানে সরাসরি "আলো" শব্দটি ব্যবহার করে রূপক তৈরি করা হয়েছে, যা আসলে জীবনের সুখ বা শক্তির প্রতীক।
বিমূর্তবাদ মূলত এক ধরনের শিল্প এবং সাহিত্যিক আন্দোলন, যা চিন্তা ও অনুভূতিকে কেন্দ্র করে বিকশিত হয়েছে। বাংলা সাহিত্যে এই ধারার প্রভাব পড়ে আধুনিক কবিদের রচনায়, যেখানে তাঁরা বাস্তবতার বাইরে গিয়ে মানুষের মনের জটিলতা এবং অভিজ্ঞতার বিমূর্ত প্রকাশ ঘটিয়েছেন।
বিমূর্ত কবিতা এবং পাঠক প্রতিক্রিয়ার সম্পর্ক:
হেলাল হাফিজ তাঁর ‘অশ্লীল সভ্যতা’ কবিতায় বলেছেন-
`নিউট্রন বোমা বোঝ
মানুষ বোঝ না!’
আজকাল যেখানে মানুষই বোঝা দুঃসাধ্য ব্যাপার সেখানে সব কবিতা বোঝা যাবে না এটাই হয়তো স্বাভাবিক। তাই বলে দুর্বোধ্যতার দায় শুধু কি কবির একার? পাঠকেরও নয়? অবশ্য অনেকে পৃথিবীর জটিল তত্ত্বগুলো বোঝেন, হিরোশিমা-নাগাসাকি বোঝেন, রাজনীতি বোঝেন, হেলেনের যে সৌন্দর্যে- প্রেমে ট্রয় নগরী ধ্বংস হয়েছিল তাও বোঝেন কিন্তু কবিতা বোঝেন না!
কবি কি কোনো ভিনগ্রহণের প্রাণী? কবি যে ভাষায় কথা বলেন, যে ভাষায় বায়ূ গ্রহণ করেন, যে রাস্তায় হাঁটেন, যে সমাজে বসবাস করেন সে ভাষা কি পাঠকের নয়? পাঠক কি সে বায়ূ গ্রহণ করেন না? সে রাস্তায় পাঠক হাঁটেন কিংবা সে সমাজে পাঠক বসবাস করেন না? কবির কাছে কি আলাদা কেনো অভিধান আছে যে অভিধান পাঠকের কাছে নেই?
কবিতা না বোঝার দায় কি শুধু কবির একার? পাঠকের নয়? কোনো কোনো পাঠকের অভিযোগ, কবিতা বুঝতে হলে যদি কবির শরণাপন্ন হতে হয় কিংবা অভিধান খুলে বসতে হয় তাহলে কবিতা পড়ার কী দরকার? অথবা বর্তমান সময়ে কবিতা পাঠকের সংখ্যা কমে যাওয়ার কারণ হিসেবে অনেকে কবিতার দুর্বোধ্যতাকে, কবিতার বিমূর্ততাকে দায়ী করেন। আসলে কি তাই? অথবা এ দায় কি কবির একার শুধু?
পাঠক বুঝলেই তা কবিতা কিংবা না বুঝলে তা কবিতা নয়! তাই কি? পাঠক হিসেবে একটি কবিতা পাঠ করে বুঝলেন না। এর জন্য কবিকে দায়ী করা হলো এই বলে যে, কবি কী কবিতা লিখেছেন যা পাঠকের বোধগম্য হলো না? পাঠক হিসেবে এ কবিতা না বোঝার দায় কি শুধু কবির? আসলে কি তাই? উত্তর হ্যাঁ অথবা না দুটোই হতে পারে। তবে কবিতায় বিমূর্ততার মূল সমস্যাঃ
১. পাঠকের কল্পনা এবং ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার ভূমিকা: বিমূর্ত কবিতা সরাসরি বর্ণনা বা দৃশ্য না দিয়ে একটি ধাঁধার মতো কাজ করে। পাঠককে নিজেদের অভিজ্ঞতা, চিন্তা, এবং অনুভূতি দিয়ে কবিতার অর্থ খুঁজতে হয়। যেহেতু কবিতায় কোনো নির্দিষ্ট বাস্তবতা বা ঘটনা বর্ণনা করা হয় না, তাই বিভিন্ন পাঠকের জন্য একই কবিতার অর্থ ভিন্ন হতে পারে, উদাহরণ:
আকাশের কোণে ঝুলে থাকা নীল রং,
অবচেতন থেকে টেনে নেয় স্মৃতির ক্যানভাস।
এই কবিতার চিত্রকল্পে একটি নির্দিষ্ট ঘটনা নেই, তবে পাঠক তার নিজের জীবনের স্মৃতি এবং অনুভূতির ওপর নির্ভর করে এর মধ্যে বিভিন্ন অর্থ খুঁজে পেতে পারে।
২. পাঠকের প্রতিক্রিয়ার ভিন্নতা: বিমূর্ত কবিতার সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো, এটি একাধিক স্তরে পাঠ করা যায়। পাঠক ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে কবিতাকে দেখতে পারে এবং বিভিন্ন প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে পারে। কেউ কেউ এই ধরনের কবিতায় নিজস্ব মানসিক অবস্থা বা অভিজ্ঞতার প্রতিফলন খুঁজে পান, আবার কেউ বিমূর্ত চিত্রকল্পে দার্শনিকতা বা আধ্যাত্মিকতা আবিষ্কার করেন।
৩. পাঠকের অংশগ্রহণ এবং চিন্তার প্রসার: বিমূর্ত কবিতা পাঠকের মননশীলতাকে উস্কে দেয়। পাঠককে কবিতার গভীরে প্রবেশ করে চিন্তা করতে হয়, অর্থ খুঁজে বের করতে হয়। এর ফলে পাঠক শুধুমাত্র কবির দেয়া বক্তব্য বা অর্থ অনুসরণ করেন না, বরং কবিতায় নিজেকে সম্পৃক্ত করে। এভাবেই পাঠকের ব্যক্তিগত প্রতিক্রিয়া কবিতাকে জীবন্ত করে তোলে।
৪. বিমূর্ত কবিতা এবং পাঠকের সংযোগ: যেহেতু বিমূর্ত কবিতা সরাসরি ব্যাখ্যা দেয় না, তাই কবিতা এবং পাঠকের মধ্যে এক ধরনের অন্তর্গত সংযোগ তৈরি হয়। পাঠক নিজস্ব অভিজ্ঞতা এবং মনস্তত্ত্ব দিয়ে কবিতার অর্থ খুঁজে পেয়ে এক ধরনের ব্যক্তিগত সম্পৃক্ততা অনুভব করেন।
৫. পাঠকের জন্য চ্যালেঞ্জ: বিমূর্ত কবিতা কখনও কখনও পাঠকের জন্য চ্যালেঞ্জিং হয়ে দাঁড়ায়। সরাসরি চিত্রকল্প বা ঘটনা না থাকার ফলে পাঠককে গভীরভাবে ভাবতে হয় এবং কবিতার অভ্যন্তরীণ সৌন্দর্য বা ভাব প্রকাশ খুঁজে পেতে হয়। এটি পাঠককে আবেগীভাবে আরো গভীর স্তরে নিয়ে যায়, যেখানে চেতনা এবং অনুভূতির মিশ্রণে কবিতার নতুন দিক উন্মোচিত হয়।
৬. বিমূর্ত কবিতা পাঠের পর অনুভূতি: অনেক পাঠক বিমূর্ত কবিতার অস্পষ্টতা উপভোগ করেন, কারণ এটি তাদের মননশীলতা এবং কল্পনাশক্তিকে জাগ্রত করে। তবে কিছু পাঠকের কাছে এ ধরনের কবিতা জটিল ও দুর্বোধ্য মনে হতে পারে, কারণ এর অর্থ পুরোপুরি স্পষ্ট নয়। সেই কারণে বিমূর্ত কবিতা কখনোই নির্দিষ্ট অর্থ প্রদান করে না, বরং পাঠককে নিজস্ব ভাবনার জগতে টেনে নেয়।
বিমূর্ত কবিতা এবং পাঠক প্রতিক্রিয়ার মধ্যে একটি নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। এই ধরণের কবিতা পাঠকের মনের ওপর বিশেষ প্রভাব ফেলে, কারণ এটি পাঠককে কল্পনা এবং চিন্তার দ্বারা গভীরভাবে সম্পৃক্ত করে। প্রতিটি পাঠকের প্রতিক্রিয়া ভিন্ন হতে পারে, যা বিমূর্ত কবিতাকে আরও সমৃদ্ধ এবং বহুমাত্রিক করে তোলে।