কবিতা-১১ এর পেছনের গল্প
আমার নিজের জীবন স্টাইলের সাথে বর্তমান সময়ের *কর্পোরেট সংস্কৃতির অনেক কিছুই মেলে না,খুব বেশী বিপদে না পড়লে মেলাতে চাইও না, যেমন আমি ব্যাংকের ডেভিট কার্ড ব্যবহার করি কিন্তু ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করি না, স্মার্টফোন ব্যবহার করি কিন্ত অনেক বেশী অপশন ব্যবহার করে জীবনকে কমপ্লেক্স করে তুলতে চাই না ইত্যাদি। কিন্তু কর্পোরেট সংস্কৃতির এই যুগে এর থাবা থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখা খুবই মুশকিল, অনেক সময় প্রায় অসম্ভব। আমরা জেনে কিংবা না-জেনে, বুঝে কিংবা না-বুঝে কর্পোরেট ফাঁদে পা দিয়ে নিজেরাই নিজেদের সর্বনাশ করছি,এর থেকে আমাদের আর মুক্তির কোন উপায় নেই। মুলত সে রকম এক প্রেক্ষাপটে, প্রায়ই বন্ধুদের সাথে এবং সর্বশেষ কোন একদিন অফিস কলিগদের সাথে এক বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হওয়ার পরেই এই কবিতা লেখা। আমার ক্রেডিট কার্ড না থাকা এবং আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানে বড় পজিশনে চাকরি করা তাদের কাছে এক অবিশ্বাস্য কাহিনী মনে হয়েছিল, ফলে আমি সেদিন **মফিজ বনে গিয়েছিলাম এবং মফিজ অবস্থায়ই কবিতাটি লেখা হয়েছিল।
নোটঃ
** কর্পোরেট সংস্কৃতিঃ
আমার এক বন্ধু বেসরকারী ব্যাংকে চাকরী করে, উত্তরোত্তর পদন্নোতিতে বেসরকারী ব্যাংকিং ব্যবস্থাপনার সুনাম সারাদিনই বলে বেড়ায়। কোন সন্দেহ নেই বাংলাদেশের বেসরকারী ব্যাংক বিপ্লব ঘটিয়েছে মানুষের জীবনে। সপ্তাহে ৭ দিন, ২৪ ঘন্টা ব্যাংকিং ব্যবস্থাপনা, রাজধানীসহ বিভাগীয় শহরগুলোতে এটিএম বুথ স্থাপন, জীবনের প্রয়োজনীয় সময়ে ও সংকটময় মূহুর্তে ঋণ প্রদানসহ নানা আয়োজন। কিন্তু তাই বলে ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তগুলোও কি ব্যাংক ব্যবস্থাপনা কর্তৃক প্রদান হবে? যে সিদ্ধান্তগুলো পরিবার কেন্দ্রিক কিংবা স্বামী-স্ত্রী কেন্দ্রিক তাও আজকাল ব্যাংকিং ব্যবস্থাপনার সাথে সম্পর্কিত। বন্ধু কাজলকে (ছদ্মনাম), তার ব্যাংক উপদেশ দিয়েছিল ফ্ল্যাট কেনার লোনটা শোধ হলেই যেন বিয়ে করে, কাজল সে কথা রেখেছিল। পাঁচ বছর পর বিয়ে করেছিল ব্যাংকের লোন রেকর্ড ভালো রাখার জন্য। সেদিন কাজল বললো, ব্যাংক বলেছে গাড়ির লোনটা শোধ না হলে এখনই বাচ্চা নেয়াটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। বিয়ে করা, বাড়ি কেনা, ফ্ল্যাট কেনা, গাড়ি কেনা, উচ্চতর শিক্ষা অর্জন কিংবা স্বামী স্ত্রীকে বাদ দিয়ে বাচ্চা গ্রহন করার সিদ্ধান্তসমুহ প্রায় সকল গুরুত্বপূর্ন সিদ্ধান্ত গ্রহনে ব্যাংকের পরোক্ষ ভূমিকা থেকেই যাচ্ছে।ব্যক্তি জীবনের সিদ্ধান্ত এখন আর ব্যক্তি নিজে নিতে পারে না, সিদ্ধান্ত নেয় ইট সিমেন্ট আর কাঠের অফিস ব্যাংক। স্বামী স্ত্রী তাদের নিজেদের বাচ্চা গ্রহন করার সিদ্ধান্ত কিংবা উপদেশ নিতে হয় ব্যাংক লোন সেকশনের কর্মকর্তার কাছে, উচ্চতর শিক্ষা গ্রহন করবো কি করবো না কিংবা সুযোগ হবে কি হবে না তা নির্ভর করে ব্যাংক কর্তৃপক্ষের কাছে আমার গ্রহনযোগ্যতার উপর, কেননা উচ্চশিক্ষার জন্য লোন পাশ হতে হবে। তথাকথিত ও উন্নত সেবা ব্যবস্থাপনা মানুষের ব্যক্তি স্বাধীনতা, ইচ্ছা অনিচ্ছা, সিদ্ধান্ত গ্রহন করার ক্ষমতার উপর প্রতিনিয়তই প্রভাব বিস্তার করে চলেছে ব্যাংকিং ব্যবস্থাপনা।
কিছুদিন আগেও বন্ধ বান্ধব, আত্মীয় স্বজন কিংবা পড়শীদের নিকট ঋণী থাকা ছিল অনেকটা লজ্জার বিষয়, পারতো পক্ষে কেউ ঋণ নেয়ার কথা ভাবতোই না। সেটা ছিল বেহিসেবী চরিত্রের বহিঃপ্রকাশ। আয় ও ব্যয়ের মধ্যকার ভারসাম্যহীন আচরণকেই বলা হতো বেহিসেবী। কিন্তু আজকাল ব্যাংকের ক্রেডিট কার্ড হলো আভিজাত্যের প্রতীক। কারনে অকারনে মানিব্যাগ কিংবা পার্টস খুলে একাধিক ব্যাংকের ডেভিট কার্ড ও ক্রেডিট কার্ড প্রদর্শন জানান দেয়, ঋণ দেয়া কোন লজ্জার বিষয় নয় বরং মানিব্যাগ কিংবা পার্টসে ক্রেডিট কার্ড না থাকার অর্থ দাঁড়ায় ছেলেটি/মেয়েটি গ্রামে থাকে কিংবা গ্রাম থেকে সদ্য শহরে এসেছে কিংবা তা্রা অ-আধুনিক মানুষ। ঋণ শব্দটির প্রকৃত অর্থ একই আছে, বদলে গেছে শুধু ঋণের উৎস। ঋণের উৎস বদল হওয়ার কারনে তা আভিজাত্যের প্রতীক হয়ে উঠেছে। সবই কর্পোরেট কালচার যা প্রতিনিয়তই মানুষকে প্রভাবিত করছে নানা কৌশলে, নানা আদলে। মানুষ বন্দী হয়ে পড়ছে কর্পোরেট বিশ্বে যেখানে ব্যক্তি কিংবা ব্যক্তিগত বলে কোন শব্দ নেই, আছে কেবল কোম্পানী। আমরা অসুস্থ হলে এখন আর পাশের ফ্ল্যাট কিংবা পড়শীর উপর ভরসা করি না বরং মেট লাইফ কোম্পানীতে একটা ইন্সুরেন্স পলিসি করে রাখি। কর্পোরেট বিশ্ব ধীরে ধীরে রাষ্ট্রের অস্তিত্বকেও অস্বীকার করতে যাচ্ছে। সারা বিশ্ব যেমন পরিচালিত হয় কর্পোরেট ব্যবসায়ীদের নখের ইশারায়, বাংলাদেশেও তেমনি সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারনী পরিষদ, জাতীয় সংসদের অধিকাংশ সাংসদ কর্পোরেট ব্যবসায়ী, তারাই দেশের নীতি নির্ধারন করে থেকেন। এখন মানুষেরে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সেবার দায়িত্ব রাষ্ট্রের পরিবর্তে বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়, ইংলিশ মিডিয়াম বিদ্যালয়, বীমা কোম্পানী কিংবা বেসরকারী টেলিকমিউনিকেশন কোম্পানী গ্রহন করছে। আমাদের দুশ্চিন্তার সময়গুলো কি ক্রমেই কমে যাচ্ছে?
ডায়াল করুন ৭৮৯... স্বাস্থ্য সেবা তো পকেটে কিংবা সুখে অসুখে আছি, হাত বাড়ালেই আছি......ল্যাব এইড
**মফিজ
অবজ্ঞা করে বৃহত্তর রংপুর বিভাগের লোকদের মফিজ বলা হয়,দারিদ্র্যতার কারনে খেটে খাওয়া মানুষদের ঢাকামুখী হতে হয় প্রায়শই,ফলে ঢাকার সংস্কৃতির সাথে তাদের গ্রামের সহজ সরল সংস্কৃতি মেলে না,গেয়ো মনে হয়,সে কারণে ”মফিজ” শব্দটি গেয়ো কিংবা আনস্মার্ট শব্দের প্রতিশব্দ হিসেবে ব্যবহার হয়। কিন্তু প্রকৃত ঘটনা ভিন্ন, দারুন এক মানবিকতার গল্প আছে এর পেছনে।
রংপুর, গাইবান্ধা এলাকায় এক বাস কন্টাকটর ছিলেন তার নাম “মফিজ মিয়া”, তিনি সারাদিন বাসে কন্ট্রাকটরি করেই দিনযাপন করতেন, এর আয় দিয়েই নিজের সংসার চালাতেন। ভীষন রকম সৎ এবং পরোপকারী মানুষ ছিলেন তিনি। প্রায়শই তিনি যখন ডিউটিতে থাকতেন, কোন কোন বাসযাত্রি তার এলাকারই, ভাড়া চাইতে গেলে বলতেন “ হামি গরীব মানুষ, হামার কাছে তো টাহা নাই, আমার তো ঢাহাত যাইতে হইবে, কাজ করিবার লাগিবে, নাতো খাইবো কি? বউ বেটি ছাওয়ালগে কি খাওয়াইমু? মফিজ মিয়ার অন্তর কেঁদে উঠতো, প্রথম দুয়েকবার নিজের পকেট থেকে ভাড়া দিয়ে মালিকের কোটা পূরন করতেন কিন্ত এতো মানুষের ভাড়া দেয়া তার পক্ষে সম্ভব হতো না।
পরে চিন্তা করে বুদ্ধি বের করলেন, বাসের ছাদের উপর মালামাল নেয়া হয়, সেখানেও দুয়েকজন উঠিয়ে দিলে, অল্প ভাড়া দিয়েই তারা ঢাকা যেতে পারে। এভাবে বাসের ছাদের উপরে অনেক গরীব মানুষকে ঢাকা পৌঁছে দিতেন। ধীরে ধীরে মফিজ মিয়ার নাম ছড়িয়ে পরে চারদিকে। অনেক সময় তিনি হয়তো ঢাকা ট্রিপ নিয়ে এসছেন কিন্তু রংপুর থেকে কেউ ফোন করলেন অন্য বাস যাত্রী, তিনি বাসের ছাদে করে অল্প টাকায় ঢাকা যেতে চান। তখন ফোনেই বলে দিতেন, বাস কন্ট্রাকদারকে বলো, “আমি মফিজ মিয়ার লোক”, তবেই ওরা তোমাকে নিয়ে আসবে। এভাবে ধীরে ধীরে প্রচলিত হয়ে যায় “মফিজ মিয়ার লোক”, তারও পর লোকমুখে কথাটি প্রচলিত হতে হতে শুধু “মফিজ” বললেই হতো।
একটা দারুন মানবিক কাজের স্রষ্টার নামকে বিকৃত করে এখন তা নেগেটিভ আকার ধারন করেছে। মফিজ মানেই এখন বোকা, সরল, হত দরিদ্র, অ-আধুনিক, আন-স্মার্ট ইত্যাদি শব্দের প্রতিশব্দ হয়েছে।
এ ঘটনা থেকেই জন্ম হলো এই কবিতার
কর্পোরেট সংস্কৃতির আগ্রাসন
- সরদার আরিফ উদ্দিন
একটা সময়
প্রতিবেশী কিংবা আত্মীয় স্বজন থেকে
ঋণ নেয়াটা ছিল
বেহিসেবি চরিত্রের লক্ষন;
এখন
মানিব্যাগে একাধিক ব্যাংকের
ক্রেডিট কার্ড জানান দেয়;
আধুনিকতা আর কর্পোরেট সংস্কৃতির আগ্রাসন
পুঁজিবাদী অর্থনীতির আস্ফালন ।
একটা সময়
প্রতিবেশী মানুষজনই ছিল
বিপদে আপদে কিংবা
প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবায় আপনজন;
এখন
৭৮৯ স্বাস্থ্য সেবাতো পকেটে
বীমা কোম্পানি আর ব্যাংক-ই নিকটজন;
নীরবে চলছে কর্পোরেট সংস্কৃতির আগ্রাসন।
একটা সময়
সন্তান লালন পালনে
বাবা মায়ের পরেই মুখ্য ভুমিকায়
ছিল দাদা দাদী আর পরিবারের অন্যজন।
এখন
সন্তানের মুখ দেখার সময় নেই
আছে ডে-কেয়ার সেন্টার কিংবা
রক্ত সম্পর্কহীন বেতনভুক্ত কর্মী কয়েকজন;
নীরবে চলছে কর্পোরেট সংস্কৃতির আগ্রাসন।
সময়ের দাবী, সময়ের চাহিদা
ভাবার সময় নেই, সুবিধা কিংবা অসুবিধা;
পুঁজিবাদী কাঠামোয় ‘উপায়হীনতার’ ভাবনা
কর্পোরেট সংস্কৃতি থেকে মুক্তি মিলবে না।
অগাস্ট ০৭, ২০১৮
মিরপুর, ঢাকা