কবিতা-৬ এর পেছনের গল্প

আমার ২৪ বছর কর্মজীবনে, ১০টি সংস্থায় কাজ করেছি, সর্বোচ্চ ১০ বছর এবং সর্বনিম্ন ৬ মাস সময়। এর মধ্যে ছিল ১টি জাতীয় পর্যায়ের এনজিও, ৫টি আন্তর্জাতিক এনজিও, ২টি ইউএন এজেন্সী, ১টি কর্পোরেট এবং ১টি স্বায়ত্ত শাসিত সরকারী প্রতিষ্ঠান। গল্পটি ৩য় চাকুরীর, একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা। সেখানে মাত্র ১ বছর কাজ করেছিলাম। মোটামুটি বাধ্যহয়েই রেজিগনেসন লেটার ছিয়েছিলাম।

মূল ঘটনাটি ছিল, “বাউন্ডারী ইস্যু”, তখন আমি Boundary Concept ভালভাবে বুঝতাম না। আমি ডিরেক্টর লেভেলে কাজ করতাম সেখানে, একজন নারী ছিলেন আমার সমপর্যায়ের অর্থাৎ তিনিও ডিরেক্টর কিন্তু অন্য ডিপার্টমেন্টের। সংস্থার বৃহত্তর সার্থে আমি সবাইকে সমন্বয় করার চেষ্টা করতাম, কিভাবে কনভারজেন্স (Convergence) তৈরি করা যায় সেটাই ছিল আমার মূল লক্ষ্য কিন্তু উনি মনে করতেন, আমি তার বাউন্ডারীতে প্রবেশ করেছি। আমার ফ্যাসিলিটেশনের গুনে, তার ডিপার্টমেন্টের অনেকেই আমার ভক্ত হয়ে উঠলো, উনি আরো ক্ষেপে উঠলেন। আমি উৎসুক হয়ে আরো বেশি সবাইকে একত্রীকরনের মাধ্যেম টীম গঠনের কাজ করতাম, উনি আরো বেশি তেলে বেগুনে জ্বলে উঠতেন। কিন্তু তখনো বিষয়টা আমি বুঝতে পারিনি, আসলে “Boundary and Cross Boundary Concept and Impact” নিয়ে আমার ধারনা তখনো খুব পরিস্কার ছিলো না, এখন যতোটা পরিস্কার। এক পর্যায়ে তিনি আমাকে নিজের “কম্পিটেটর” ভাবতে শুরু করলেন এবং শুরু হলো নোংরা রাজনীতি (সে গল্প আর এখানে বলছি না)

একদিন, একটা কুকুরকে দেখালাম, অন্য একটি কুকুরকে তাড়া করছে, তার সঙ্গী সাথী আরো কয়েকটি কুকুরও আছে। তাড়া খাওয়া কুকুরটি তাড়া খেয়ে বেশ দৌড় দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে, একটা নির্দিষ্টা এলাকা পার হবার পর, পেছনে তাড়া দেয়া কুকুরগুলো আর কিছু বলছে না, পেছনের দিকে চলে যাচ্ছে কিন্তু ইচ্ছে করলে তারা আরো কিছুদূর পর্যন্ত তাড়া করতে পারতো , সে এনার্জি তাদের ছিল, কিন্তু আর তাড়া করছে না। বুঝতে পারলাম পশু প্রানী জগতেও Boundary Concept আছে। তাড়া খাওয়া কুকুরটা ভুল করে অন্যের বাউন্ডারীতে ঢুকে পরেছিল। যখনই বাউন্ডারী ক্রস করে ফেললো এবং তখনই সে বিপদমুক্ত হয়ে গেল। তারপর ডিসকভারী চ্যানেলে বহুবার এই Boundary Concept দেখেছি, বাঘ সিংহ কিংবা অন্য প্রানীর ক্ষেত্রেও।

তো, আরো কিছুদিন পর আমি বুঝতে পারলাম, অনুমান করতে পারলাম, নোংরা রাজনীতি শুরু হয়েছে এবং তা কতদূর যেতে পারে, আমি এখানে টিকে থাকার সম্ভাবনা কতটুকু বা আমি এই নোংরা রাজনীতিতে আসলে নিজেকে জড়াবো কি না? তখন বুঝতে শুরু করলাম, নারী পরিচয় (women identity) অফিস সংকৃতিতে কে কিভাবে ব্যবহার করে, কে কতটুকু বেনিফিট পায় বা নেয়। কিভাবে সেক্সচুয়াল ইস্যুগুলো গল্পের আকার ধারন করে, কিভাবে একজনকে পরিকল্পিতভাবে ভিকটিম করা হয় ইত্যাদি ইত্যাদি। ধীরে ধীরে পরিচিত মানুষগুলো কিভাবে অপরিচিত হয়ে ওঠে, ভালো কাজও কিভাবে অকাজ হিসেবে সুপারভাইজারগন মূল্যায়ন করেন, কে কিভাবে, কাকে, কি সিগন্যাল দিচ্ছেন ইত্যাদি। বলার অপেক্ষা রাখে না, বুঝতে পারলাম, চাকুরি চেঞ্জ করা ছাড়া অন্য কোন উপায় নাই। সব ভালো, সব সময়, সবার জন্য, সব ক্ষেত্রে ভালো নাও হতে পারে। সব প্রডাক্ট সব দোকানে বিক্রি হয় না। ফলে রিজাইন করা।

এর পরের পর্ব, উক্ত রাজনীতিবিদগন, বিদায় অনুষ্ঠানে কে কি বলে, কতটা অনুভূটি প্রকাশ করে ইত্যাদি খুব ভালো ভাবে পর্যবেক্ষন করছিলাম “আমার বিদায় অনুষ্ঠানে” । মনে হলো, এতো “মিথ্যে বলার আসর” এবং এটাই অফিসিয়াল সংস্কৃতি (official Farewell Culture)। , সেদিন ওখানে বসে বসেই মনে হচ্ছিল, শুধু শুধু অফিসের টাকা খরচ করে অন্যকে জোর করে মিথ্যে বলানোর কোন মানে হয় না। আমার কারনে এখানে সবাইকে মিথ্যে বলতে হচ্ছে। বিদায় অনুষ্ঠান আয়োজন করার কি দরকার?  আমি নিশ্চিত ভাবেই জানি, এরা এখানে যা যা বলছে তার ৮০-৯০% মিথ্যে কথা। সবাই যেন মিথ্যে বলার প্রতিযোগীতায় নেমেছে। কে কতো মিথ্যেই বলতে পারে, কত সুন্দর করে মিথ্যে উপস্থাপন করতে পারে, এটা যেন তারই প্রতিযোগীতা।

উল্লেখ্য, তারপর থেকে আমি আর কোনদিন কোন অফিস থেকে ফরমাল বিদায় নেইনি। বিনয়ের সাথে “বিদায় অনুষ্ঠান প্রত্যাখান করেছি”। আমি এই অনুষ্ঠানের নাম দিয়েছি, “মিথ্যে বলার অনুষ্ঠান”,

এ ঘটনা থেকেই জন্ম  হলো এই কবিতার

বিদায় অনুষ্ঠান
-সরদার আরিফ উদ্দিন

মিথ্যের বেসাতি, প্রশংসার ছড়াছড়ি
আগে বলতে চাওয়ার হুড়োহুড়ি;
বিদায়ী মানুষটি ফেরেশতার কাছাকাছি
বিদায় অনুষ্ঠানে এমনটাই দেখে থাকি ।

গতকাল যাকে তাড়াতে চেয়েছিল
আজ তার বিদায়ে কান্নার রোল পড়লো;
অভিনয়ে কেউই কম নয়
একে অপরকে ছাড়িয়ে রয়।

বিদায় বেলায় সর্ব গুনে গুনাগুন
একটু আগেও ছিল অথর্ব, বেগুন;
বছর জুড়ে অলিখিত শত্রু, ল্যাং মারা
বিদায় বেলায় বক্তৃতা, আজ আমি বাকহারা।

বিদায়ী অনুষ্ঠানের জন্যই অপেক্ষা
মোক্ষম সুযোগ, ভাল মানুষী সাজা;
না চাইলেও, বাধ্যতামূলক অংশগ্রহন
মিথ্যের বাজারে, অনিচ্ছার অবগাহন।

মানুষ দুবার ফেরেশতা তুল্য হয়
বিদায় অনুষ্ঠানে একবার, সবাই এমনটাই কয়;
মৃত্যুর পরে, কবরে যাবার ঠিক আগে
আরেকবার ফেরেশতা হয়, দেখতে চায় আগে ভাগে।

কক্সবাজার
জানুয়ারি ১১, ২০১৭