(নোটঃ কিছু কবিতার জন্ম হয় হঠাৎ করে, তার পেছনে কোন গল্প থাকে না। কিন্তু কিছু কবিতার জন্মের পেছনে একটা গল্প থাকে, কোন একটা বিষাদ থাকে কিংবা দহন। কবিতার পেছনের গল্প গুলো পাঠক জানে না, কবি একাই বহন সেই সব গল্প, সুখের কিংবা বিষাদের)
কবিতা-৩ এর পেছনের গল্প
প্রেক্ষাপটঃ
আমরা প্রায়ই কথাচ্ছলে, আড্ডায়, সামাজিক অনুষ্ঠানে, অফিসে, এখানে সেখানে... মানুষকে কিছু প্রশ্ন করে বিব্রত করে থাকি। এটা এশিয়ান সংস্কৃতিতে আমাদের আচরনের একটা বড় ধরনের দুর্বলতা বলেই মনে হয়। অন্য কোন দেশে আমি এমনটা খুব বেশি দেখিনি। কাকে কি বলা উচিত, কি বলা যাবে, কি বলা যাবে না ইত্যাদি বিষয়ে আমাদের যতোটা সচেতন থাকা দরকার, তেমনটা থাকা হয় না। অনেক সময়ই অসভ্যের মতো অনেক কথাই বলে ফেলি, অসচেতনতার কারনে। সেটা করি, অবস্থানগত ক্ষমতার কারনে, বয়োজ্যষ্ঠতার কারনে, সামাজিক সম্পর্কের কারনে, অর্থ বিত্তের শ্রেনী বিন্যাসের কারনে ইত্যাদি নানা কারনে।
আমি তখন একটি আন্তর্জাতিক সংস্থায় (X সংস্থা) কাজ করতাম। অফিসের কাজে আমাদের প্রায়ই কর্মস্থালের বাইরে যেতে হয়, অফিসের মিটিং, কনফারেন্স, ট্রেনিং ইত্যাদি নানা কারনে। তখন অফিসিয়াল কিছু নিয়ম নীতে ফলো করতে হয় যেমন-অফিসিয়াল অনুমোদন, ট্রাভেল এরেঞ্জমেন্ট, অর্থের প্রয়োজন হলে এডভান্স ইত্যাদি। একদিন আমাকে কর্মস্থলের বাইরে যেতে হবে অফিসিয়াল কারনেই, তো প্লেনের টিকেট কাটতে হবে। ফাইন্যান্স ইউনিটে ইন্টারকমে ফোন করলাম, এডভান্স প্রসেসের জন্য। অপরপক্ষ থেকে উত্তর আসলো-
অফিস এখন কোন এডভান্স দিতে পারবে না
কেন?
নিজের টাকায় প্লেনের টিকেট কেটে নিন
আমার কাছে তো টাকা নেই (ইচ্ছে করেই বলেছিলাম)
কেন? মাত্র কয়েকদিন আগেই তো স্যালারি পেলেন? এরই মধ্যে টাকা শেষ হয়ে গেল??
আর কথা বাড়াতে রুচিতে বাধলো। টেলিফোন রেখে দিলাম।
আমার অর্জিত টাকা/স্যালারি, আমি কোথায় খরচ করবো? কখন করবো? কিভাবে করবো? আপনি জিজ্ঞেস করতে পারেন? এটা কি কোন সভ্যতার মধ্যে পড়ে? সভ্য মানুষ এমন প্রশ্ন করতে পারে? কিন্ত ক্ষমতাবলে মানুষ নিজের সভ্যজ্ঞানও হারিয়ে ফেলে।
আমরা প্রায়ই একে অন্যকে বলে থাকি-
• এতো টাকা দিয়ে কি করেন? এতো টাকা স্যালারি পান, একটা গাড়ি কেনেন না কেন?
• আপনার তো অনেক পুরনো মডেলের গাড়ি, এবার একটা ভাল দামী গাড়ি কিনুন না কেন? টাকা তো অনেক ইনকাম করেন।
• এখনো ফ্ল্যাট কেনেন নি? এতো উচু পদে চাকরি করেন, আপনার ফ্ল্যাট নেই?
কোন সভ্য মানুষ, অন্যকে এভাবে প্রশ্ন করতে পারে? এটা কোন সভ্যতার মধ্যে পড়ে? কিন্তু আমরা হরহামেশাই এমন কথা বলে থাকি, অন্যের সাথে এমন আচরন করে থাকি। আমাদের স্কুল, কলেজ বিশ্ববুদ্যালয়গুলোতে আচরন বিজ্ঞান নিয়ে কিছু শেখানো হয় না ফলে একাডেমীকভাবে অনেক শিক্ষিত মানুষও এমন অসভ্য আচরন করে থাকে। মানুষ সভ্য আচরন শেখে মূলত পরিবার থেকে। আরো কিছু উদাহরন দেয়া যাক-
• বিয়ের তো অনেকদিন হয়ে গেল, একটা সন্তান নিচ্ছেন না কেন? এবার নিয়ে নেন। সন্তান নেবে কি নেবে না সেটা তাদের স্বামী স্ত্রীর যৌথ সিধান্ত, আপনি তো তাকে এ প্রশ্ন করতে পারেন না। তাকে এ ব্যাপারে কোন পরামর্শ/উপদেশ দিতে পারেন না।
ইদানীং, আমাদের ব্যাংকিং ব্যবস্থাপনায় এরকম কিছু অসভ্য আচরন দেখা যায়। কেউ ব্যাংক থেকে, নিজের সেভিংস একাউন্ট থেকে টাকা উত্তোলন করতে গেলে একটা ফর্ম দিয়ে পূরন করতে বলা হয়, কেন টাকা তুলবো বা কি কারনে টাকার প্রয়োজন? একবার, আমি ব্যাংকে গিয়ে, এরকম একটা ফর্মে লিখলাম-
-আমার মদ খেতে খুব ইচ্ছে করছে, তাই মদ কেনার জন্য টাকা তুলছি।
-উত্তর এলো, ছিঃ ছিঃ এটা কি বলেন?
-কেন? আমার তো মদ খাবার লাইসেন্স আছে, কি সমস্যা? লাইসেন্সের কপি দেবো?
-তা থাকতে পারে, তাই বলে এভাবে ওপেন বলবেন?
-কেন, আপনি তো জিজ্ঞেস করলেন? মিথ্যে বলতে বলেন?
-আপনি লিখেন, সাংসারিক কাজে বা ব্যক্তিগত কাজে
-সবই তো ব্যক্তিগত কাজ, লিখা না-লিখার কোন মানে নেই
-এটা আমাদের লিখতে হবে, তাই লিখা
-কিন্তু এটাতো অসভ্যতা, আমার টাকা আমি কেন তুলবো, এটা আপনি জিজ্ঞেস করতে পারেন না। আর -যদি জিজ্ঞেস করেন, তাহলে আমি মদ খাওয়ার কথাই লিখবো
অবশেষে, আমার আর ফর্ম পুরন করতে হয়নি।
আবার এরকমও বলতে শোনা যায়-
• মেয়েতো অনেক বড় হয়ে গেছে, বিয়ে দিচ্ছেন না কেন?
• আপনার ডিভোর্স হল কেন?
• ডাক্তার দেখাচ্ছেন না কেন?
• কারো কাছে কোন সাহায্য চাইলে, আপনার ছেলেমেয়েরা কোথায়? তারা আপনার দেখাশোনা করে না?
সেদিন, ওই ঘটনার পর, এসব কথাই মনে হচ্ছিল, আমাদের সমাজের মানুষগুলো কতোটা অসভ্য হলে, অন্যকে এসব প্রশ্ন করে বিব্রত করতে পারে!! এবং এটা যে অসভ্যতা, সেটা মনেই করে না, যেন বা এসব প্রশ্ন করার অধিকার আছে।
এ ঘটনা থেকেই জন্ম হলো এই কবিতার
আমি কি জিজ্ঞেস করতে পারি ?
-সরদার আরিফ উদ্দিন
আমি কি জিজ্ঞেস করতে পারি ?
আপনি বেতনের টাকা দিয়ে কি করেন?
এ বছর আপনার কি বাচ্চা নেয়ার পরিকল্পনা আছে?
ব্যাংক থেকে কেন টাকা তুলছেন?
কিংবা, আপনি কত টাকা বেতন পান?
জিজ্ঞেস করতে কি পারি ?
এত টাকা ইনকাম করেন, ফ্ল্যাট কেন কেনেন না?
আপনার সংসার কেন ভেঙে গেল?
আপনি কেন ছোট ফ্ল্যাটে থাকেন!!
প্রতিদিন পাবলিক বাসে অফিসে আসেন, গাড়ী কেন কেনেন না?
হ্যাঁ পারি, এদেশে সব পারি
অফিসিয়ালি পারি
সামাজিক কথোপকথনে পারি
ব্যাংকের ফর্মে লিখে দিতে পারি
এমনকি সুপারভাইজার হলে, জুনিয়রকে এর চেয়েও বেশী বলতে পারি।
অসভ্য মানুষের ভিড়ে সব পারি
তথাকথিত শিক্ষিত হলে পারি
সভ্য মানুষের মুখোশে, অসভ্য হলে পারি;
ক্ষমতার দাপট থাকলে পারি;
সঠিক জ্ঞান না নিয়ে, পলিসি তৈরি করার সময় পারি ।
প্রশ্নের উত্তরে রিএক্ট করা যাবে না
এড়িয়ে যাবার ঊপায় থাকবে না ;
গণ্ডার হওয়া ছাড়া বিকল্প থাকবে না
এসব না পারলে, টিকে থাকা যাবে না ।
কক্সবাজার
জানুয়ারি ২৩, ২০১৮