কবিতা-১০ এর পেছনের গল্প

মাঝে মাঝে নিজেকে খুব হতভাগা মনে হয়, এমন একটা সমাজে/দেশে আমার জন্ম হয়েছে এবং বেড়ে উঠেছি যেখানে প্রতি পদে পদে শুধু মুখোশের সাথে পরিচিত হতে হয়।ছোট বেলায় বাবা-মা এক ধরনের শিক্ষা দিয়ে বড় করে করে তোলেন, বাস্তব জীবনে তার মিল খুঁজে পাই না, স্কুল কুলেজে যে বই পড়ে পড়ে বিদ্যা অর্জন করি তার সাথে কর্মজীবনের কোন মিল থাকে না।মিল অমিলের চেয়েও ভয়ংকর বিষয়, বেশীর ভাগ সময়ই তা সাঙ্ঘরসিক আকার ধারন করে। স্পষ্টভাষী মানুষকে এ সমাজ খারাপ চোখে দেখে, সত্য উচ্চারণ এবং ন্যায়ের পথ অবলম্বনকে বোকামি ভাবা হয়, এখানে কেবল চলে মুখোশের খেলা। চারদিকে এতো মুখোষ দেখি, হতাশায় থাকি কখনো বা ক্ষোভে ফেটে পড়ি, কোন মুখোশ আর কোনটা আসল বুঝতে না পারি, কি এক যন্ত্রনায় জীবন অতিবাহিত করি!!!

কবিতাটির জন্ম কয়েক মাস আগে একদিন অফিস থেকে ফিরে, অশান্ত মনে যখন সমুদ্রেবীচে একা একা বসে ভাবছিলাম, তখন বারবার মনে পড়ছিল বেশ কয়েক বছর আগে একই ভুল আমি আজকের মত আগেও করেছিলাম এবং আমার চাকরী নড়বড়ে হয়ে গিয়েছিল। এশিয়া রিজিওনাল পরিচালকের লেখার উপর সমালোচনা করেছিলাম, তার লেখায় প্রকাশিত কিছু যুক্তির কাউন্তার যুক্তি (counter logic) দাড় করিয়েছিলাম। আমি ভুলে গিয়েছিলাম, আমি নিজ দেশের একটি আন্তর্জাতিক সংস্থার শুধুমাত্র একজন পরিচালকের চেয়ারে বসে রিজিয়নাল পরিচালকের (Asia Regional Director) লেখা পড়ছি এবং মন্তব্য দিচ্ছি। এতটা সত্য উচ্চারন দেশীয় পরিচালক (Country Director) এবং রিজিওনাল পরিচালক (Regional Director) কোন ভাবেই মেনে নিতে পারেনি ফলে যা হবার তাই হয়েছে, এর পরের ২মাসের মধ্যে আমি চাকরি ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলাম। আমাদের প্রফেশনাল জগতে এটাকে বলে ‘ কৌশলী হওয়া’ কিংবা  ‘ডিপ্লোম্যাটিক থাকা’, আমি সেখানে খুব সফল ভাবে ম্যানেজ করতে পারিনি। তারপর বেশ অনেক বছর হল আমি এখন অনেক বেশী কৌশলী এবং ডিপ্লোম্যাটিক। অথচ আমি যখন কানাডায় পড়াশুনা করেছি, বাঘা বাঘা সব প্রফেসরদের সাথে নির্দ্বিধায় তর্ক করেছি, তাদের লেখার উপর সমালোচনা লিখেছি নিঃসঙ্কোচে। এত বছর পর অসাবধানতাবসত আবারো প্রায় একই ভুল করলাম যার খেসারত আমাকে অনেকদিন দিতে হবে। মুলত সামাজিক এবং প্রফেশনাল চাপে পড়ে নিজেরও মাঝে মাঝে মুখোশ পড়তে হয় কিন্তু মন থেকে মেনে নিতে পারি না, সেই যন্ত্রণা থেকেই এই কবিতার জন্ম।

এ ঘটনা থেকেই জন্ম  হলো এই কবিতার


স্পষ্ট উচ্চারণের দায়ভার
- সরদার আরিফ উদ্দিন

শিক্ষক শিখিয়েছিলেন
স্পষ্ট উচ্চারন করতে হবে
তাতে করে নাকি অনেক নাম হবে;
বাবা-মা শিখিয়েছিলেন
সত্য কথা বলতে
তাতে করে নাকি, মানুষ হয়ে উঠবো!!

অনেক চর্চায় স্পষ্ট উচ্চারনে
অভ্যস্ত আমি
অভিজ্ঞতার ভারে ভারাক্রান্ত; দেখি চোখ খুলে
আমি’র জায়গায় গবেট দেখা মেলে;
কৌশলী হতে না পারার তকমা লাগে কপালে
শ্রমফল যায় বিফলে
মানুষের অবয়ব থাকে না আমলে
নিজেকে দেখি, সত্য উচ্চারনের দায়ভারের শেকলে।

অস্পষ্ট উচ্চারনের
সুবিধে অনেক;
না বোঝার দন্ত হাসি মেলে
আড়ষ্টতা থাকে পিলে চমকে দিলে
মিউ মিউ করা বিড়াল গুলো চাদরের তলে
আড়াল করা ইচ্ছেগুলো চলে হেলে দুলে
সালামের জবাবে ব্যাস্ত আমি, তখন ‘কলা গাছ আঙুল ফুলে’।

বই পড়া শিক্ষা, গুরুজনের দীক্ষা
বাস্তবতায় মেলে না, আছে অনেক সমীক্ষা;
যে দেবতা যে ফুলে তুষ্ট
একটাই মূল মন্ত্র ‘সন্তুষ্ট’
ভুল শিক্ষায় জীবন পার
কে নেবে স্পষ্ট উচ্চারনের দায়ভার?
কে নেবে ‘মানুষ’ হবার দায়ভার?

অগাস্ট ১৭, ২০১৮
মিরপুর, ঢাকা