আমরা প্রায়ই বলে থাকি, কবিতা সমাজ পরিবর্তনের হাতিয়ার, দিন বদলের সুতিকাগার কিংবা কবিতা বদলে দিতে পারে অন্যায়, অত্যাচার ইত্যাদি ইত্যাদি। তার মানে কবিতার প্রভাবের পরিসর অনেক বড়, ব্যক্তি থেকে সমাজ, রাষ্ট এমনকি বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট পর্যন্ত!! সাহিত্যের বিভাগ বিভাজনে, কবিতাকেও আমরা নানাভাবে দেখতে চাই, মধ্যযুগের কবিতা, আধুনিক কবিতা, উত্তর আধুনিক কবিতা ইত্যাদি। তাহলে সময় এবং প্রেক্ষিত বিবেচনায় কবিতার সময়কাল, ধরন, গঠন পরিবর্তিত হচ্ছে। অর্থাৎ প্রেক্ষাপট একজন কবিকে প্রভাবিত করে প্রথম, পরে তার কবিতা প্রেক্ষাপটের উপর প্রভাব ফেলে, বিষয়টি কি এতো সরল সমীকরন?
গত ১০০ বছরের পৃথিবীকে আমরা, বিশ্বের অর্থনীতি, সমাজনীতি, রাজনীতি ইত্যাদিকে মোটাদাগে কয়েকটা বিভাজনে দেখতে চেষ্টা করি, বিশ্লেষন করি এবং সে অনুযায়ী নুতন দিক নির্দেশনা তৈরি করি। যেমন-
১। প্রথম বিশ্ব যুদ্ধ পুর্ব এবং যুদ্ধ উত্তর প্রেক্ষাপট
২। দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধ পুর্ব এবং যুদ্ধ উত্তর প্রেক্ষাপট
৩। কোল্ড ওয়ার পূর্ব এবং কোল্ড ওয়ার উত্তর প্রেক্ষাপট
৪। টুইন টাওয়ার হামলা পূর্ব এবং হামলা উত্তর প্রেক্ষাপট
৫। আরব বসন্ত পূর্ব এবং বসন্ত উত্তর প্রেক্ষাপট
৬। কোভিড-১৯ পূর্ব এবং কোভিড উত্তর প্রেক্কাপট
৭। এছারা আরো কিছু আঞ্চলিক প্রেক্ষাপট তো আছেই।
(নোটঃ উপরোক্ত প্রেক্ষাপটঃ কবি এবং কবিতার উপর প্রভাব নিয়ে পরে বিস্তারিত লিখবো)
সাহিত্য চর্চা, কবিতা চর্চা কিংবা অন্যকোন শিল্প মাধ্যমের সাথে জড়িত ব্যক্তিবর্গও উপরোক্ত প্রেক্ষাপটের বাইরে কেউ নন, ফলে স্বাভাবিকভাবেই তার চিন্তা চেতনা, ভাবনার উপর এর প্রভাব পড়বে এবং তিনি তার ভাবনায় তা প্রতিফলিত করবেন।
তাহলে, একটি কবিতা সর্বপ্রথম একজন কবিকেই প্রভাবিত করবে সবচেয়ে বেশি যিনিই এর স্রষ্টা। তারপর অন্য একজন কবি যিনি একই শিল্প মাধ্যমের সাথে কাজ করেছেন, একই রকম অভ্যস্ততায় আছেন, তার পর অন্যান্য শিল্প মাধ্যমের সাথে জড়িত যারা আছেন এবং তারও পর কবিতা পাঠক এবং সবশেষে আমজনতা। যদি এভাবে বোঝার চেষ্টা করি-
১। কবি নিজেই
২। অন্যান্য কবি এবং সাহিত্যিক
৩। অন্যান্য শিল্পী (যেমন-চিত্র শিল্পী, ফটোগ্রাফার, ভাস্কর্য ইত্যাদি)
৪। কবিতা পাঠক
৫। আম-জনতা
তাত্ত্বিকভাবেই আমরা জানি, কেসকেড ডাউন (CaseCade Down), পদ্ধতি প্রতি স্টেপেই কিছু হারায় এবং প্রতিস্টেপ থেকে নুতন কিছু গ্রহন করে পুরনোর সাথে সংযুক্ত হয়, ফলে পদ্ধতি নির্মানে স্রষ্ঠাকেই সর্বাধিক সচেতন থাকতে হয়, তার কাছ থেকেই সর্বাধিক সূক্ষ্মতার দাবী করা হয়।
কোন প্রকার গবেষনা ছাড়াই, বাহ্যিক পর্যবেক্ষন থেকেই বলা যায়, কবিতা আম-জনতা পর্যন্ত পৌছায় না, কাঠামোগতভাবেই সে সুযোগ নেই। কবিতা চারদেয়ালের ভেতরেই পাঠ হয়, কবি এবং কবিকূল নিজেরাই নিজেদের কবিতা শোনেন এবং হাত তালি দিয়ে থাকেন। ইদানিং প্রযুক্তির কল্যানে এবং আবৃত্তি শিল্পীদের ব্যবস্থাপনায় কিছু দূরের আম-জনতা পর্যন্ত পৌঁছে হয়তো কিন্তু সেটাও খুব সিলেক্টিভ । মাঠে ঘাটে, হাটে বাজারে বন্দরে কবিতা পাঠ হয় না, কবিতা হাতিয়ার হিসেবে সেভাবে কাজ করে না। অবশ্য বিশেষ কিছু প্রেক্ষাপট (যেমন-যুদ্ধকালীন সময়, বড় কোন ক্রাইসিস) বাদ দিলে, সারাবছর কবিতার জন্ম এবং বিস্তৃতি চার দেয়ালের ভেতরেই কিংবা বছরে একবার একুশে বই মেলা পর্যন্তই।
এরপর নীচ থেকে উপরের দিকে যেতে থাকলে, কবিতা পাঠক। যে কোন বইয়ের পাঠক আজকাল দূরবীন দিয়ে খুজতে হয়, কোন কোন পাঠক আবার বই পড়েন কিন্তু অন-লাইন ভিত্তিক, প্রিন্ট বই খুব একটা কেনেন না, পড়েনও না। সারা বছর পাঠক সংখ্যা এবং বই বিক্রির সংখ্যা হিসেব করলে তা পরিসংখ্যানগত ভাবে ইনসিগফিকেন্ট। এর মধ্যে কবিতা পাঠকের সংখ্যা সমুদ্রের এক ফোটা জল হবে কি না সন্দেহ। তবে যে, আমরা দাবী করি-কবিতা পাঠককে প্রভাবিত করে এবং সমাজ বদলের হাতিয়ার হিসেবে কাজ করে?? ফাঁকা আওয়াজ???
আরো উপরের দিকে গেলে, অন্যান্য শিল্পী (যেমন-চিত্র শিল্পী, ফটোগ্রাফার, ভাস্কর্য ইত্যাদি, অন্যান্য কবি এবং সাহিত্যিক, তারা কবিতা পড়েন? খুব কি উৎসাহব্যঞ্জক চিত্র? তাহলে কবিতা কিভাবে, কাকে প্রভাবিত করছে?
সবশেষে, কবি নিজেই কি কবিতা পড়েন? কবিতা লিখেন বটে কিন্তু পড়েন কি? নিজে কবিতা লিখেন মানে দাঁড়ায়, নিজের ভাবনা চিন্তা, চেতনা অন্যের মাঝে ছড়িয়ে দিতে চান এবং ঐ যে, সমাজ পরিবর্তনের হাতির, সেখানে নিজেকে সম্পৃক্ত করে আত্মতৃপ্তি পেতে চান, এর বেশি আর কি? অন্যের কবিতা পড়েন না, সময় পান না বা ইচ্ছে করেই পড়তে চান না, মানে দাঁড়ায়, অন্যের ভাবনা দ্বারা নিজে প্রভাবিত হতে চান না। নিজের ভাবনাকেই শ্রেষ্ঠ মনে করেন।
আমরা যখন বলি, কবিতা পরিবর্তনের হাতিয়ার, কি পরিবর্তনের কথা কল্পনা করি? কে পরিবর্তন করবে? কার জন্য পরিবর্তন করবে? কিভাবে পরিবর্তন হবে? প্রশ্নগুলো প্রাসঙ্গিক ভাবেই আসে। পরিবর্তনের মূল বিষয়গুলো-
• নীতি পরিবর্তন হবে, যে নীতি অন্যায় অবিচার শোষন থেকে মানুষকে মুক্ত করবে
• মানুষের মানবাধিকার সমুন্নত থাকবে
• দারিদ্র্যমুক্ত, সমতাভিত্তিক, ন্যায্য সমাজ প্রতিষ্ঠা পাবে, মর্যাদার ভিত্তি স্থাপন হবে
• মানুষ সহনশীলতা, সততা, সমমর্মিতা ইত্যাদির আলোয় আলোকিত হবে
• মানুষ তার মৌলিক অধিকার ভোগ করবে, কেউ কারো অধিকার হরন করবে না ইত্যাদি।
মোটা দাগে, মানুষের আচরন পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে, ব্যাপক সচেতনতার মাধ্যমে উপরের বিষয়গুলো অনুধাবন করবে এবং নিয়মিত চর্চার মধ্যে দিয়ে পরিবর্তনে দিকে ধাবিত হবে। এটাই তো মূল বিষয়?
উপরের আলোচনায় দেখেছি, কবিতা তো কেউ পড়ে না, তাহলে কিভাবে ঘটবে বিষয়টি?
আচ্ছা ঠিক আছে, কবিতা কেউ যদি নাও পড়ে, একজন কবি তো পড়ে? তাহলে তার আচরনের মধ্যে তো পরিবর্তন হবে নাকি? তার চিন্তা চেতনা, ভাবনা, আচরন, সহনশীলতা, সহমর্মীতা, অন্যের সাথে আচরন, ভাষা ব্যবহারে নৈতিকতা, শব্দ প্রয়োগে সচেতনতা, কথা বলার স্টাইল, মন্তব্য করার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সতর্কতা, অন্যকে গ্রহন করার মানষিকতা ইত্যাদি ক্ষেত্রে তো পরিবর্তন আশা করা যেতেই পারে।
একজন কবি, নিজের হয়তো ভাষায় উপর ভালো দখল আছে, কবিতার ব্যকরণ জানেন ভালো, ছন্দ তাল লয় ইত্যাদিও ভাল বোঝেন, ফলে খুব সহজেই একটি ভালো, মান সম্পন্ন কবিতা লিখে ফেলতে পারেন এবং মনে মনে প্রত্যাশা করে থাকতে পারেন তার কবিতায় প্রভাবিত হয়ে অন্যরা তার আচরন পরিবর্তন করবেন। কিন্তু কবি, নিজে নিজের আচরন পরিবর্তন করবেন না, তাহলে কবিতার প্রভাব কতদূর বিস্তৃতি পাবে??
প্রথম আলো’র একটি ক্যাম্পেইন “ বদলে যাও, বদলে দাও”
কিন্তু বলে না “চলো বদলে যাই”
অন্যেকে বদলে যেতে বলা খুব সহজ কাজ কিন্তু নিজে বদলে যাওয়া খুব কঠিন।
(নোটঃ কবিতার আসরে নিয়মিত আমি সহ অন্তত ১০০জন কবি আছেন, এই লেখার ফ্রেমে ফেলে আমরা ভেবে দেখতে পারি, আমাদের আচরন এবং কবিতার মাধ্যমে আমরা কিভাবে প্রভাব ফেলছি সমাজে? নূন্যতম আসরের পাতায়?)