বিশ্ব কবিতাসভায় আধুনিকতার সুত্রপাত হয়েছিল উনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে এবং বাংলা কবিতায় এর ঢেউ এসে লাগে বিংশ শতাব্দির দ্বিতীয়-তৃতীয় দশকে। রেনেসাঁ ও প্রাজ্ঞযুগ পেরিয়ে শিল্পবিল্পবের উত্তাল সময়টিতে ইউরোপে কবিতা আধুনিকতার দিকে বাঁক নিতে থাকে এবং আধুনিক কবিতার বিকাশযাত্রার বিকাশ ঘটেছে নানা রকমের আন্দোলন, মতবাদ, তত্ত্ব ও ঘরানার মধ্য দিয়ে, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য এনং জনপ্রিয় কয়েকটি ঘরানা হোল-বাস্তুবাদ (রিয়ালিজম), ধারণাবাদ (ইম্প্রেশনিজম), প্রকাশবাদ (এক্সপ্রেশনিজম), আকারবাদ (ফরমালিজম), নয়া আকারবাদ (নিউ ফরমালিজম), বস্তুনিষ্ঠবাদ (অবজেকটিভিজম), প্রক্ষেপণবাদ (প্রজেকটিভিজম), প্রতীকবাদ (সিম্বলিজম), ভবিস্যবাদ (ফিউচারিজম), খেয়ালবাদ (দাদাইজম), গঠনবাদ (কনসট্রাকটিভিসম), পরাস্তুতবাদ (সুরিয়ালিজম), ক্লাসিজম, রোমান্টিসিজম। এছাড়াও অঞ্চলভিত্তিক নানা ঘরানার উদ্ভব দেখা যায় কবিতার আঙ্গিক এবং বোধগত মাত্রা পরিবর্তনে যেমন- যদ্রিচ্ছা (ঔলিপো), হারলেম রেনেসাঁ, সান ফ্রান্সিসকো রেনেসাঁ, বিট জেনারেশন, ব্রিটিশ পোয়েট্রি রিভাইভাল, মার্শাল পোয়েট্রি (মাঙ্গলিক কাব্য), মিস্ত্রিক কাব্য (কুয়াশাময় কাব্য), কনফেশনাল কাব্য (স্বীকারোক্তিমূলক কাব্য), স্পোকেন ওয়ার্ড (শব্দচ্চার), পারফরমেন্স পোয়েট্রি (কৃতিকাব্য) ,ল্যাংগুয়েজ কাব্য (ভাষা কাব্য), পোষ্ট ল্যাংগুয়েজ কাব্য (উত্তর ভাষা কাব্য) ইত্যাদি। এর মধ্যে আবার কবিতা প্রবেশ করেছে উত্তর আধুনিক পর্বে ।
বাংলা কবিতাও বিশ্বের সঙ্গে সমান তালে তাল মিলিয়ে বিকশিত ও বিবর্তিত হয়েছে তার নিজস্ব দীপ্তি এবং মহিমা বজায় রেখে। বাংলা কবিতায় প্রথম পশ্চিমের ছোঁয়া লাগান মাইকেল মধুসূদন দত্ত যদিও তিনি আধুনিক সময়ের কবি নন কিন্তু তিনি মননে ছিলেন পুরাদস্তর আধুনিক কবি। এরপরের মহানায়ক কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তার প্রজ্ঞাস্পর্শে বাংলা কবিতা রাতারাতি কৈশোর পেরিয়ে যৌবনে পদার্পণ করে। ধীরে ধীরে বাংলা কবিতা শক্ত অবস্থান নেয় ইংরেজি শিক্ষিত পাঁচ পঞ্চপাণ্ডব খ্যাত কবিগন (জীবনানন্দ দাশ, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, অমিয় চক্রবর্তী, বিষ্ণু দে এবং বুদ্ধদেব বসু) যখন বিশ্বকবিতার মঞ্চে আবির্ভূত হন। এরপর বাংলা কবিতাকে আর পেছনে তাকাতে হয়নি। বাংলাদেশ পর্বে কোলকাতার কবিদের সাথে সমান তালে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশের আধুনিক কবিগন (শামসুর রহমান, রুদ্র মুহাম্মদ শহিদুল্লাহ, দাউদ হায়দার, নিরমলেন্দু গুন প্রমুখ) বাংলা কবিতাকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন নিজেদের স্বকীয়তা বজায় র্রেখে। গত সাত আট দশক ধরে বাংলা কবিতা অনেক চড়াই উৎরাই পেরিয়ে আজ স্বমহিমায় উদ্ভাসিত। বাংলাদেশে এখন কবিতা চর্চা হচ্ছে, স্কুলে-কলেজে, ক্লাবে, শহরে-গ্রামে সর্বত্। প্রতিবছর বাংলাদেশে আয়োজন হচ্ছে জাতীয় বই মেলা, প্রকাশ হচ্ছে শত শত কবিতার বই। কবিতার ভার্চুয়াল জগতও থেমে নেই, অসংখ্য ব্লগ, ওয়েবসাইট , কবিতা প্রকাশ পোর্টাল তৈরি হয়েছে। বাংলা কবি ও কবিতা ডটকম একটি উল্লেখযোগ্য ভার্চুয়াল কবিতা প্রকাশ ও চর্চা কেন্দ্র, লক্ষাধিক কবিতা এরই মধ্যে প্রকাশ পেয়েছে এখানে। এই আসরেরই একজন শক্তিমান লেখক, কবি খলিলুর রহমান, কিছুদিন আগেই তার দু’টি একক কাব্য গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে, যার একটি ‘যে স্মৃতি কথা বলে’ নিয়েই আজকের আলোচনা।
গ্রন্থটির শিরোনাম “যে স্মৃতি কথা বলে”, যথার্থই নামকরণ, প্রত্যেকটি কবিতা একেকটা সময়ের স্মৃতিকে ধারণ করে লেখা হয়েছে যা কবি’কে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে সারাক্ষন আবার তা জীবন্ত হয়ে নিজেই কথা বলছে পাঠকের সাথে । বইয়ের প্রচ্ছদ একেছেন কবি কন্যা ফামিদা ফারজানা রহমান (অপি) যিনি কবি এবং কবি’র কবিতাকে অন্তরে ধারণ করেই প্রচ্ছদ ভাবনায় তা দারুণভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। বইয়ের শিরোনাম এবং প্রচ্ছদ নিজেই পাঠককে নিয়ে যাচ্ছে জীবনের পরতে পরতে ছড়িয়ে থাকা স্মৃতি বিজড়িত সেই গ্রাম বাংলার চিরচেনা জীবনকে ফেলা আসা এক করুন আর্তিতে। বইটিতে স্থান পেয়েছে ৭৭টি কবিতা, যা একটি পরিপূর্ণ জীবনের ব্যাখা দেয়, ‘মাগো তোমায় মনে পড়ে’, ‘আত্ম পরিচায়’, ‘দুমুঠো ভাতের জন্য’ এবং ‘পিছন ফিরে চাওয়া” যেমন আত্মম্ভরিতামুক্ত একটি আত্মকথন তেমনি ‘সে আমার ব্যর্থতা’, ‘স্বার্থপরতা’, ‘প্রত্যাখান’ কিংবা ‘পতি পত্নির ঝগড়া’ স্পষ্ট এক উদারনৈতিক উচ্চারন। সবার পক্ষে এত স্পষ্ট উচ্চারন সম্ভব হয় না, নিজের প্রতি অগাধ আস্থা এবং অন্যের প্রতি সুবিচার প্রতিষ্ঠায় অবিচল থাকা মানুষের পক্ষেই তা সম্ভব হয়, কবি খলিলুর রহমান সে সাহস দেখিয়েছেন নিষ্ঠার সাথে।
বইয়ে স্থান পাওয়া কবিতাগুলো পড়তে পড়তে নানা ভাবনায় আচ্ছন্ন ছিলাম, কবিতাগুলো কি কবি’র নিজের জীবনের ঘটনা প্রবাহ? হতে পারে কিন্তু তা আবার অনেকের জীবনকেই একইভাবে ছুঁয়ে যায়। সে অর্থে কাব্যগ্রন্থটিকে বলতে পারি ‘আত্মজীবনী মুলক কাব্যগ্রন্থ’ আবার কাব্য বিবেচনায় বাস্তুবাদ (রিয়ালিজম) এবং প্রকাশবাদ (এক্সপ্রেশনিজম) ধারার সমন্বয়ও বলতে পারি। আবার যখন ‘অন্য রকম যুদ্ধ’, ‘বঙ্গবন্ধু’ কিংবা ‘ম্যান্দেলা’ কবিতাগুলো পড়ি তখন দেখতে পাই কবির বস্তুনিষ্ঠ চেতনার বহিঃপ্রকাশ, সুতরাং কবি বস্তুনিষ্ঠবাদ (অবজেকটিভিজম) কিংবা গঠনবাদ (কনসট্রাকটিভিসম) সমন্বয় করেছেন এমনটা বললে ভুল হবার কথা নয়। অন্যদিকে ‘রোমান্টিসিজম’ বাদ দেই কিভাবে? অনেকগুলো কবিতাই প্রেম-বিরহকে স্পর্শ করেছে যা প্রত্যেক মানুষের জীবনে এক অবশ্যম্ভাবী অনুষঙ্গ। প্রকৃতির সাথে জীবনের মম্মেলন প্রকাশ পেয়েছে প্রেম এবং বিরহ দুটো অনুষঙ্গের মাধ্যমেই, ‘এ গান শুধু তোমার তরে’, পাথরে লেখা যে নাম’, ‘প্রথম আলাপ’ কিংবা তোমার না থাকা দিনে’ ।
মানব জীবন কোন সরলীকরণ রেখা দ্বারা আঁকা যায় না কিংবা কোন নির্ধারিত সমীকরণে বাঁধাও যায় না। জীবনের শুরুটা দেখে যেমন শেষটা প্রক্ষেপন করা যায় না আবার শেষটা দেখেও শুরুর চিত্রটা অনুমান করা যায় না। প্রকৃতির এক অদ্ভুত খেয়াল জড়িয়ে থাকে মানব জীবনের পড়তে পড়তে। সেখানে যেমন থাকে হাসি কান্না আনন্দ বেদনা, থাকে প্রেম-বিরহ ব্যর্থতা সফলতা আবার ক্ষনে ক্ষনে বাক নেয়া সময়ে যোগ হয় নানা অনুসঙ্গ, থাকে বিদ্রোহ দেশপ্রেম বন্ধুত্বকে ধারণ করার মত অসাধারণ কিছু গুনাবলি, সবার জীবনে এত কিছুর সম্মেলনে এত বর্ণাঢ্যতা হয়তোবা থাকে না কিংবা জীবনকে এত বৈচিত্র্যে উপভোগ করার সুযোগ তৈরি হয় না। কিন্তু কবি, আলোচ্য গ্রন্থে জীবনের এক অসাধারন বৈচিত্র্যের রূপ পাঠককে উপহার দিয়েছেন।
কবিতার গঠন এবং প্রকৃতি কেমন হবে, অনুভূতির প্রকাশ হলেই কি তা কবিতা বিবেচনায় নেয়া যাবে কিনা, কাব্য গুন এবং মান কেমন হবে ইত্যাদি নানা বিতর্কে কবি এবং কবিতা উভয়েই বিতর্কিত নানা জনে, নানা প্ল্যাটফর্মে। কবিতায় কাব্যরূপ এর প্রাধান্য নাকি বক্তব্য রূপ প্রাধান্য পাবে সে বিতর্ক যেমন রয়েছে তেমনি রয়েছে কবিতায় দুর্বোধ্য এবং সহজ শব্দের ব্যবহার নিয়েও । কবিতা সম্পর্কে আমার নিজের একটা মতামত আছে, যে কবিতা কবি ছাড়া অন্য কেউ (সাধারণ পাঠক) বুঝতে পারে না আমি সেগুলো কবিতা মানতে খুব একটা ইচ্ছুক নই, পড়তেও ইচ্ছুক নই আবার যে কবিতা কাব্যগুনে কিংবা রূপকতার দোহাই দিয়ে উতরে যায় কিন্তু বক্তব্যবিহীন কতগুলো শব্দের সমষ্টি, আমি সে গুলোকেও কবিতা বলি না। কবি খলিলুর রহমান এর ‘যে স্মৃতি কথা বলে’ কাব্যগ্রন্থে স্থান পাওয়া কবিতাগুলো সহজ সরল শব্দে অনেকটা সার্বজনীন ভাষায় লিখিত হওয়ায় তা প্রত্যেক পাঠকের মনকে ছুঁয়ে যাবে বলে আমার বিশ্বাস যেমনটা আমাকে আলোড়িত করেছে বলেই তার কাব্যের উপর আলোচনা লিখছি/অনুভুতি ব্যক্ত করছি।
সবশেষে, বেশ কিছু কবিতায় কবি জোর করে ছন্দ মেলাতে চেষ্টা করেছেন বলে মনে হয়েছে, ফলে একটু বেসুরো লাগছিল, পড়তে গিয়ে আটকে যাচ্ছিলাম, ঠিক শ্রুতিমধুর লাগছিল না। আমার মনে হয়, শব্দের ছন্দ অপেক্ষা লয় এবং তাল এর ছন্দের দিকে কবি আর একটু বেশী নজর দিতে পারতেন।
অনেক সাহস করে কবি ও কবিতা আসরের শক্তিমান কবি খলিলুর রহমান এর একক কাব্য গ্রন্থের উপর আলোচনা লিখলাম, মুলত বইটি পড়ার পর আমার অনুভুতি ব্যক্তি করলাম মাত্র। আমি সেই অর্থে কাব্য আলোচক নই, ভুল হলে ক্ষমা করবেন কবি।
কবি খলিলুর রহমান আমার অত্যন্ত শ্রদ্ধাভাজন একজন ব্যক্তিত্ব, কবির দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ একইভাবে সংগ্রহে রাখার এবং প্রত্যেকটি কবিতা পড়ার ইচ্ছে থাকলো । কবি’র প্রতি রইলো আমার সালাম এবং শ্রদ্ধা।