আলোচনা ১৭৮
একটি উপমা’র সাহায্যে আমাদের মানব চরিত্রের এক অতি পরিচিত বৈশিষ্ট্য নিয়ে কাব্য “কে বেশী দামি”, রচনা করেছেন কবি শম্পা দত্ত। দুটো শিক্ষণীয় বিষয় বেশ চমৎকারভাবেই উঠে এসেছে কাব্যে-
১। তুলনা করার প্রচলিত পদ্ধতি যা বিপদ ডেকে আনে, আমাদের মধ্যে হতাশা তৈরী করে
২। কার কাছে সমস্যা সমাধানের জন্য কিংবা বিচারের জন্য যাবো? তিনি কতটা যোগ্য কিংবা আমার জন্য প্রযোজ্য কি না, সে বিবেচনা বোধ আমাদের মধ্যে কাজ করে কি না।
আমরা প্রায়ই নানা বিষয়ে অন্যের সাথে নিজেকে তুলনা করি এবং হতাশায় ভুগে জীবনকে নিজেরাই অতীষ্ট করে তুলি। বাবা মায়েরাও নিজের ছেলেমেয়ের দোষ গুন অন্যের সাথে তুলনা করে শাষন করে তাদের জীবন বিষিয়ে তোলে। আদতে এটা একটা ভুল পদ্ধতি। অমুক এতো ভালো রেজাল্ট করেছে, তুমি কেন পারলে না? ওতো বেশ সুন্দর গান গাইতে পারে, ছবি আঁকতে পারে, তুমি তো পারো না। এভাবে অন্যের সাথে তুলনা করে ছেলেমেয়েদের মনে হতাশা তৈরি করি ক্রমাগতই। আমরা নিজেরাও করি, আমার বন্ধ ক্যারিয়ারে খুব উন্নতি করছে, আমি কেন পারছি না, তার তো দামী গাড়ি আছে, আমার কেন নাই, তার বাড়ি এতো সুন্দর আমারটা তো পুরনো, তার হাতে আইফোন আছে, আমি তো কিনতে পারছি না ইত্যাদি। এভাবে তুলনা করা, পুরোটাই একটা ভুল পদ্ধতি। আম ভালো নাকি কলা ভালো, এটা কোন প্রশ্নই হতে পারে না। মা বেশি আদর করে নাকি বাবা বেশি, এভাবে প্রশ্ন করাটাই একটি ভুল পদ্ধতি। অথচ আমরা প্রতিনিয়ত এ ভুলটা করি, শিশুদের এরকম প্রশ্ন করে, তাদের দ্বিধায় ফেলে দিই।
দুটো ভিন্ন বস্তুর সাথে কখনো তুলনা হতে পারে না, এটা পদ্ধতিগতভাবেই (mehtodologically) ভুল। দুটো কলা বা দুটো আমের সাথে কিছুটা তুলনা হতে পারে কিন্তু সম্পুর্ন ভিন্ন দুটো বস্তু বা বিষয়ের সাথে তুলনা হতেই পারে না। পৃথিবীতে প্রত্যেকটি মানুষ ভিন্ন, আলাদা, তাদের নিজেদের বৈশিষ্ট্য, তাদের পারিপার্শিকতা, তাদের প্রেক্ষাপট ভিন্ন, ফুলে দুজন মানুষের সাথে তুলনা হতে পারে না। আমরা সচরাচর এ ভুলটাই করি এবং নিজেদের জীবনে হতাশা তৈরি করি নিজেদের অজান্তেই।
আলোচ্য কবিতায় হাস এবং মুরগী দিয়ে উপমা দেয়া হয়েছে, কে বেশী দামী, তারা কিন্ত বেশ ভালোই ছিল, সুখেই ছিল, তাদের মধ্যকার সম্পর্কও বেশ ভালোই ছিল। কিন্তু যখনই প্রশ্ন তৈরী হলো, কে বেশী দামী, তখন শুরু হলো দ্বন্দ্ব এবং যার পরিনাম নিজেদের জীবনের অবসান। যতক্ষন পর্যন্ত তারা নিজেকে কেউ কারো সাথে তুলনা করেনি, ততক্ষন পর্যন্ত কোন সমস্যা ছিলো না। আমাদের জীবনেও আমরা এমনটাই দেখতে পাই। ফলে কবিতা থেকে প্রথম লেসন হলো, একে অন্যের সাথে তুলনা সব সময়য়েই বর্জনীয় এবং সেটাই ভালো থাকার উত্তম পন্থা। ধর্মীয় বানীতেও সে কথা বার বার উচ্চারন হয়েছে। উপরের কারো সাথে নিজেকে তুলনা করো না তাহলে হতাশা তৈরী হবে, তুলনা যদি করতেই হয়, যে কোন বিষয়েই নিজের থেকে নীচের কারো সাথে তুলনা করো, তাহলেই মনে প্রশান্তি আসবে।
যখন কোন বিষয়ে দুজন বা একাধিক মানুষের মধ্যে দ্বন্দ্ব হয় তখন মিমাংসার জন্য আমরা সাধারনত তৃতীয় পক্ষের আশ্রয় নিয়ে থাকি। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে হলে, কোর্ট বা বিচারকের আশ্রয় নেই, কিন্তু অপ্রাতিষ্ঠানিক হলে, তৃতীয় কোন ব্যক্তি। কিন্তু একবারও ভেবে দেখি না, যার কাছে যাচ্ছি, তিনি নিরপেক্ষ কি না, সঠিক জাজমেন্ট দেয়ার যোগ্যতা তার আছে কি না বা যে বিষয়ের মীমাংসার জন্য যাচ্ছি, সে বিষয়ে তার অভিজ্ঞতা আছে কি না ইত্যাদি। কোন কিছু বিবেচনা না করেই, তৃতীয় পক্ষেরে আশ্রয়ে নিয়ে নিজেরাই নিজেদের সর্বনাশ ডেকে আনি। আমেরিকা কোন দেশে উপর যখন যুদ্ধ/হামলা করে তখন জাতিসংঘের কাছে যাই, বিচারের জন্য বা সমস্যাটি সমাধানের জন্য। কিন্তু জাতিসংঘ কি নিরপেক্ষ কোন সংস্থা (আদতে তাই মনে হয়), জাতিসংঘ কার/কাদের নিয়ন্ত্রনে/কাদের অর্থে চলে? সে প্রশ্ন থেকেই যায়।
আলোচ্য কবিতায় কবি সে বিষয়টিই তুলে এনেছেন, যখন মুরগী এবং হাঁসের মধ্যে “কে বেশী দামী” সমস্যা তৈরী হলো তখন তার সমাধানের জন্য, তৃতীয় পক্ষের (কাক) উপদেশ শুনে শিয়ালের (বিচারক) কাছে যাওয়া হলো, সমস্যা সমাধানের জন্য। শিয়ালকেই ভাবা হলো, মোড়ল, বিচারক, নিরপেক্ষ পার্সন, কাঁক তার সার্টিফিকেটও দিয়ে দিলো, ফলে হাঁস মুরগী দুজনেই শিয়ালের কাছে গেলো, সমস্যার সমাধান চেয়ে, কে বেশী দামী, ফলে যা হবার তাই হলো।
আমাদের ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক... জীবনে এমনটা হরহামেশাই ঘটে থাকে, কোন কিছু বিবেচনা না করেই তৃতীয় পক্ষের হস্তক্ষেপের রাস্তা তৈরী করে দিই এবং তৃতীয় পক্ষই মূল সর্বনাশটা করে কেটে পরে। কবিতায় দ্বিতীয় লেসন- কোন সমস্যা হলে, তৃতীয় পক্ষের কাছে যাবার আগে, তার নিরপেক্ষতা, যোগ্যাত, তার সৎ উদ্দেশ্য ইত্যাদি বিবেচনায় রাখা খুব জরুরী।
হাঁস এবং মুরগীর উপমা দিয়ে কবি এক দারুন কাব্য রচনা করেছেন, অথচ এ দুটো লেসন আমরা একাডেমিক্যালি অনেক থিওরী (dependency theory, cultural relativism theory etc) দিয়ে বিশ্লেষন করেছি।
কবির জন্য রইলো অফুরন্ত শুভেচ্ছা