আলোচনা ১৪৪
যে কবিতা ভালো লাগে, সেগুলো আমি নানাভাবে পড়ি, উপর থেকে নীচে, কখনো শেষ থেকে পড়া শুরু করি। আবার কখনো মাঝ থেকে পড়া শুরু করি। একেক বার একেক রকম অর্থ খুঁজে পাই, ভিন্নতার স্বাদ পাই। কখনো কবি’র মতো করেই বুঝতে পারি না হয়তো কিন্তু নিজের মতো করে বোঝার চেষ্টা করি, ভীষন ভালো লাগে যখন একই কবিতা ভিন্ন ভিন্ন সময়ে পড়ি আবার ভিন্ন ভিন্ন ভাবে পড়ি, বেশ উপভোগ করি।
এই কবিতা অর্থাৎ কবি সুকান্ত দাস এর “আনলিমিটেড ওয়াইফাই”, আমি নীচে থেকে পড়া শুরু করেছিলাম। কবি’র ভাবনার সাথে আমার ভাবনা নাও মিলতে পারে, আমি আমার ভাবনা নিয়েই লিখছি। তার আগে বলে নিই, কবিতাটি আলোচনার জন্য নির্বাচন করার প্রধান কারন হলো “ওয়াইফাই” শব্দটি। বর্তমান প্রযুক্তি জেনেরেশন এ ওয়াইফাই জীবনের একটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ইস্যু, ওয়াইফাই ছাড়া তাদের জীবন প্রায় অচল। আমাদের জীবন শুরু হয়েছিল এনালগ যুগে, যুব বয়সে এসে ইমেইল এর সাথে পরিচিত হই এবং মধ্যে বয়সে এন্ড্রোয়েড ফোন সহ আধুনিক নানা প্রযুক্তির সাথে নিজেদের খাপ খাইয়ে সুবিধাভোগী হয়েছি। ফলে শব্দটি সাথে নিয়ে কবি তার কবিতায় কি বলতে চেয়েছেন, সেটাই ছিল মূল আকর্ষন। ওয়াইফাই, তাও আবার আনলিমিটেড!!
আজকাল অনেক এয়ারপোর্টে, ট্রেন স্টেশন কিংবা পাবলিক গ্যাদারিং প্লেসে, ওয়াইফাই দেয়া থাকে ফ্রি এবং আনলিমিটেড। নগর জীবনে ওয়াইফাই এখন নিত্য প্রয়োজনীয় পন্য, বাজার কম করে হলেও বাসায় ইন্টারনেট কানেকশন রাখতেই হয় এবং বাসায় একাধিক সদস্য হলে একই নেট কানেকশন দিয়ে সবাই একই সময়ে ব্যবহারের জন্য ওয়াইফাই দরকার হয়। কেউ কেউ ডাটা কিনে নেট ব্যবহার করে আবার কেউ বাসায় ওয়াইফাই, বাইরে গেলে ডাটা ব্যবহার করে। কিন্ত প্রায় সার্বক্ষনিক সময়েই আমাদের নেট কানেকশন দরকার পরে। ,
ফলে, যেখানে আনলিমিটেড ফ্রি ওয়াইফাই পাওয়া যায়, সেই জায়গার একটা বড় আকর্ষন থাকে। এখানে কবি বলছেল, ওমন আকর্ষনীয় ওয়াইফাই থাকার পরও মানুষকে তা ফেলে চলে যেতে হয়, জীবনের এতো ব্যস্ততা, এতো গতিময়তা যে অনেক আকর্ষনীয় বিষয়ও ছেড়ে দিতে হয়। এখানে একটা দ্বন্দ্ব দেখা যায়, আকর্ষনীয় বিষয় এবং জীবনের ব্যস্ততা, আপোষ করতে হয়, সারাক্ষন।
বর্তমান তথাকথিত আধুনিক জীবনে এতো ব্যস্ততা, এতো তাড়াহুড়ো থাকে আমাদের, তার সাথে যোগ হয় নানা নাগরিক যন্ত্রনা এবং বিড়ম্বনা। সবাই যখন ফিরে যায় নীড়ে তখন কিছুক্ষন আগেই মানুষের ব্যস্ততার পায়ের ছাপ দেখা যায় রাস্তায় পরে থাকা চিপস এর প্যাকেট কিংবা সিগারেটের শেষাংশের মাধ্যমে। এখানে কেউ কারো নয়, কেউ কারো জন্য নয়, সবাই লড়াই করছে ব্যস্ততার সাথে, সংগ্রাম করছে বিড়ম্বনা থেকে বাঁচতে। মানুষের সাথে আধুনিকতার লড়াই যেন চলছেই।
আমাদের যেহেতু আনলিমিটেড ওয়াইফাই আছে তাই যার তার সাথে, যখন তখন কানেক্ট হতে পারি। যতক্ষন ইচ্ছে কানেক্ট থাকবো, ইচ্ছে হলো না তো ডিস-কানেক্ট হয়ে গেলাম। এই অবাধ কানেশন, আমাদের প্রেমকেও অবাধ করে দিয়েছি, জাত-পাত, ভদ্র-অভদ্র, ছোট-বড়... কোন কিছুরই কোন সীমানা নেই। যে কেউ যে কারো সাথে কানেক্ট হতে পারে, প্রেমেও পড়তে পারে, কেউ কাউকে দেখছি না, কেউ কাউকে ভালো করে জানতেও পারছি না, শুধু কানেক্টেড হচ্ছি, যোগাযোগ করছি, প্রেমে পড়ছি, ছেড়েও যাচ্ছি, অনেকটাই স্টেশনের প্ল্যাটফর্মের মতো, অগনিত মানুষের আসা যাওয়া কিন্তু কেউ কাউকে চেনে না। আমাদের কানেক্টেড থাকাও অনেকটা সেরকমই । চেনা জানার দরকার নেই, প্রয়োজন হলেই কেনেক্ট হবো, প্রয়োজনে শেষে ডিস-কানেক্টেড হয়ে যাবো।
পুরো কবিতাটাই আমার কাছে মনে হয়েছে, তথাকথিত আধুনিকতা এবং প্রযুক্তি নিয়ে মানুষের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের পরিনতিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে। প্রযুক্তির অনেক উপযোগীতা থাকা সত্ত্বেও এর সঠিক ব্যবহারিক জ্ঞান বা সচেতনতা না থাকলে, প্রযুক্তিও ভয়ানক বিপদ ডেকে আনতে পারে।
কবির জন্য রইলো শুভেচ্ছা