আলোচনা ৪৭
কবি তমাল ব্যানার্জি তার ‘ঠোঁটকাটা’ কাব্যে শেষটা করেছেন দুটো শব্দ দিয়ে, ‘তারকাটা’ এবং ‘ঠোঁটকাটা’। বেশ ভাল লেগেছে শেষ দুটো শব্দ, তারকাটা প্রকাশ্যে কোন অসুবিধা সৃষ্টি করে না কিন্তু ভেতরে ভেতরে যন্ত্রণা দেয় খুব। অন্যদিকে ‘ঠোঁটকাটা’ ভেতরে কোন যন্ত্রণা দেয় না, যা বলার বা যা করার প্রকাশ্যে করে। কিন্তু আমাদের সংস্কৃতিতে ঠোঁটকাটা অপেক্ষা তারকাটার কদর বেশী । আমারা প্রকাশ্যে কোন সমালোচনা সইতে পারি না, গোপনে যে যাই বলুক তা হজম করতে পারি নীরবে অথচ হবার কথা উল্টোটা। শেষ দু শব্দে কবি আমাদের আচরণের প্রতি তির্যক তীর ছুঁড়েছেন।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অনেক সুফল আছে, সভ্যতার এগিয়ে যাবার ক্ষেত্রে প্রযুক্তির অনেক অবদান আছে কিন্তু তার কিছু কুফলও আছে। অন্যরা যেখানে শুধুই ভাল দিক দেখে, তারকাটার মত নীরব থেকে হজম করে সব, কবি সেখানে ‘ঠোঁটকাটার’ মত প্রকাশ্যে ভাল মন্দ দুটো দিকই বলেছেন। প্রযুক্তি আমাদের দিয়েছে গতি কিন্তু কেড়ে নিয়েছে আবেগ।
আগে আমরা প্রিয়জন কিংবা দুরপ্রবাসে থেকে নুতন বউ এর চিঠির জন্য দিন গুনতাম, হাতের লেখা চিঠির ঘ্রান নিতাম, প্রিয়জনের সান্নিধ্য খুজে পেতাম চিঠির মধ্যে, আবেগ ঝরে পরতো হাতের লেখায়, তাতে অপেক্ষার দিন গুনে হয়তো কষ্ট পেতাম কিন্তু পরক্ষনেই হারিয়ে যেতাম প্রিয়জনের আবেগ মিশ্রিত কথায়, দূরে থেকেও কাছেই অনুভব করতাম তাকে। কিন্তু এখন প্রযুক্তির কল্যাণে সেকেন্ডে ইমেইল পাই, স্কাইপে কথা বলি, ভাইবার এর মাধ্যমে বিনা খরচে ঘণ্টার ঘণ্টা আলাপ করতে পারি। প্রতি সেকেন্ডে ফেবু এর কল্যানে ছবি সহ আপডেট পাই। ফলে এখন আর চিঠি লেখার প্রয়োজন হয় না। আবেগ মিশ্রিত হাতের লেখা আর পাই না। টাইপ করা শব্দে সব একই রকম, কোন ভুল নেই, মেশিনে একই ছাঁচে লেখা সব ইমেইল। আগে হাতের লেখা বুঝতে হয়তো কষ্ট হতো, কিছু বানান হয়তো ভুল থাকতো কিন্তু ভুল বানানের সঠিক অর্থ খুজে বের করার যে আনন্দ তা এখন আর পাই না। প্রযুক্তির কল্যানে স্পষ্ট ঝকেঝকে লেখা, নির্ভুল বানান কিন্তু আবেগের সেই আকর্ষণ আর নেই।
একটি চিঠির জন্য পিয়নের পথপানে চেয়া থাকা, চিঠি প্রাপ্তির পর, খাম খোলার পূর্ব পর্যন্ত কপালে আবেগের ঘাম, বুক ধড়ফড় করা, পুরো শরীর জুড়ে যে শিহরণন তা কি আর ইমেইল এ পাওয়া যায়? যখন তখন ইমেইল, ফেবু কিংবা মোবাইল এ কথা বলার মাধ্যমে দুশ্চিন্তা মুক্ত হয়েছি অনেক কিন্তু হারিয়েছি আমাদের আবেগ, আমাদের অপেক্ষার সুখ, আমাদের অনুভবের অনুভূতিগুলো । এখন সারাক্ষণ হ্যালোতেই খুশি, ক্ষনিকের কথা, শুধু আপডেট জানা, আনন্দ বেদনার কাব্য জীবনে থেকে হারিয়ে ফেলা, এইতো !!
আমাদের এখন গতি দরকার, গাড়ি চলছে দুরন্ত গতিতে, জেট বিমান উত্তরোত্তর তার গতি বাড়াচ্ছে, প্রযুক্তির একটাই নেশা, মানুষের চলার গতি বাড়িয়ে দেয়া, প্রতি সেকেন্ডে আকাশে হাজার হাজার প্লেন উড়ছে, প্রকৃতির যে পরিবেশ তার ছন্দপতন ঘটছে, আকাশে উড়ে বেড়ানো পাখিরা আর নিরাপদ নয়, মানব সভ্যতার কাছে তাদের অস্তিত্ব হুমকির মুখে, আমরা এখন আর প্রকৃতির মুক্ত আকাশে পাখি দেখি না, দেখতে চাইও না বরং বারান্দার খাচার পাখিই আমাদের ক্ষনিকের আনন্দ দেয়। প্রযুক্তির কাছে আমরা যেমন নিজেদের বন্দী করেছি তেমনি ‘বন্দী দশা’ আমাদের আনন্দের উৎস। পাখির গানের সুর, পাখির বসন্তের ধবনি আমাদের মন টানে না বরং আমরা রিমোট দিয়ে কলিং বেলে, গাড়িতে, সাউন্দ সিস্টেমে পাখির সুর রেকর্ড করে শুনি।
আমরা যারা মধ্য বয়সী কিংবা আগের প্রজন্মের, তাদের প্রত্যেকের শিশুকাল কেটেছে ‘চাঁদের চরকা কাটা বুড়ির’ গল্প শুনে, রাতের পর রাত চাঁদের দিকে তাকিয়ে থেকেছি, চরকা কাটা বুড়িকে কল্পনায় একেছি, বুড়ীকে নিয়ে নানা রঙয়ে নিজেদের মাতিয়ে রেখেছি। আমাদের কল্পনার রাজ্য তৈরিতে চাঁদের বুড়ীর অবদান অসীম কিন্তু এখন আর কেউ চাঁদের বুড়িকে নিয়ে ভাবে না, ভাবার সময় নেই, রিমোট কন্ট্রোল কেন্দ্রিক গেম আমাদের বাচ্চাদের সময় কেড়ে নিয়েছে। ফেবু আমাদের সময়কে সংকুচিত করেছে, আমাদের সময় নেই বাচ্চাদের চাঁদের বুড়ির গল্প শোনাবার। প্রযুক্তির কল্যানে জেনে গেছি, চরকা কাটা বুড়ি বলে কিছু নেই ফলে তাকে নিয়ে ভাবার দরকার কি? বুড়িকে নিয়ে আমাদের যে আবেগ ছিল, আমাদের কল্পনার রাজ্য ছিল তা যুক্তির বিচারে হেরে গেছে।
প্রযুক্তি আমাদের আবেগ কেড়ে নিয়েছে, আমাদের ইন্দ্রিয় শক্তিগুলোকে গ্রাস করেছে, আমাদের আনন্দ-বেদনা, আমাদের স্বাদ- ক্ষুধা, আমাদের হাসি-কান্না সব, এক কথায় সব কেড়ে নিয়েছে, বিনিময়ে দিয়েছে, দুরন্ত গতিতে ছুটে চলার সাহস আর প্রয়োজন। আমরা মানুষের ক্ষিদে দূর করার, মানুষের অমরত্ব দানের আবিস্কারের নেশায় মেতে উঠেছি।
কবি এভাবেই, খুব অল্প কথায় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অপ্রয়োজনীয় ব্যবহারের উপর সতর্ক দৃষ্টি রাখার প্রতি ইঙ্গিত করেছেন এই কবিতায়। প্রযুক্তি মানব প্রজন্মকে ‘রোবট প্রজন্মে’ রূপান্তরিত করেছে, আমাদের সে বিষয়ে সতর্কতা অবল্বন করা দরকার তা না হলে একদিন আমরা সবাই রোবটই হয়ে যাব। কবির জন্য একরাশ শুভেচ্ছা রইলো।