আলোচনা ১৯৪
বাংলা কবিতা আসরে মাঝে মাঝে ধর্মীয় ইস্যু নিয়ে কাব্যরূপ পাওয়া যায়, কখনো ধর্মীয় অনুশাসন, কখনো বিধি নিষেধ আবার কখনো বা ধর্মের মূল দর্শন নিয়ে লেখা যদিও বেশীর ভাগ লেখাই ইসলাম ধর্মীয় ইস্যুতে লেখা অন্যান্য ধর্মীয় দর্শন নিয়ে লেখা খুব একটা পাই না। কখনো বা ধর্ম এবং মানবিক ভাবধারাকে সমন্বয় করে লেখা হয় অনেক কবিতা। আমিও বেশ কয়েকটি এ জাতীয় কবিতা আলোচনায় রেখেছিলাম এবং প্রকাশও করেছিলাম। আজকের লিখাটিও সেরকম একটি বহুল আলোচিত ইস্যু যা কিনা ইসলাম ধর্মে নিষেধাজ্ঞার গুলোর মধ্যে অন্যতম একটি নিষেধাজ্ঞা, “গীবত”।
গীবতঃ কোন ব্যক্তির অনুপস্থিতিতে তার এমন কোন দোষত্রুটি বর্ণনা করা যা শুনলে তিনি অসন্তুষ্ট হবে, তাকে শরীয়তের ভাষায় “গীবত” বলা হয়, তা বাচনিক অথবা লেখনীর মাধ্যমে অথবা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের অথবা অন্য কোন পন্থায়ই বর্ণ্না করা হউক না কেন। যার সম্পর্কে গীবত করা হচ্ছে তিনি মুসলিম কিংবা অমুসলিমও হতে পারেন। যদি এমন দোষ বর্ণনা করা হয়, যা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির মধ্যে নেই তবে তা “মিথ্যে অপবাদ” হিসেবে গন্য হয়। গীবত হলো ব্যক্তির এমন দোষ ত্রুটি বর্ণনা করা যা প্রকৃতই ব্যক্তির মধ্যে রয়েছে। নানা ধরনের গীবত হতে পারে যেমন- দৈহিক কাঠামোগত, পোশাক পরিচ্ছদগত, বংশগত বিষয়, অভ্যাস-আচরনগত বিষয় ইত্যাদি। তবে কোন কোন ক্ষেত্রে গীবতের বৈধতা দেয়া হয়েছে। প্রধানত ৬টি ক্ষেত্রে তবে মতান্তরে ভিন্নতা আছে। গীবতকারী এবং গীবত শ্রবনকারী উভয়কেই চরম হুশিয়ারী দেয়া হয়েছে ইসলাম ধর্মে। গীবত শ্রেনীভুক্ত আরেকটি শব্দ “চোগলখোরি” নিয়েও ইসলাম ভয়াবহভাবে নিষেধাজ্ঞা জারী করেছে। কোন ব্যক্তির ক্ষতিসাধন বা একে অপরের মধ্যে শত্রুতা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে একজনের কথা অপরজনের নিকট বলে বেড়ানোকে “চোগকখোরি” বলা হয় এবং যিনি এ কাজটি করেন তাকে “চোগলখোর” বলা হয়। ফলে তিনটি শব্দ, “গীবত”, “অপবাদ” এবং “চোগলখোরী” একই শ্রেনীভুক্ত এবং খুব কাছাকাছি শব্দ কিন্তু কিছুটা ভিন্নতা আছে এবং অপরাধের মাত্রা হিসেবে তারতম্য রয়েছে। সবচেয়ে ভয়ানক অপরাধ হিসেবে গন্য “গীবত”, যা আজকের আলোচ্য বিষয়।
কবিতার শিরোনাম “গীবতের মায়াজাল”, এখানে মায়াজল শব্দটি একটি বিশেষ ব্যঞ্জনা তৈরী করেছে। যে কোন কিছু, যখন আমরা বলি, এটা করা নিষেধ, এটা করা যাবে না, ওটা করা বারন ইত্যাদি, তখন বিষয়টি খুব একটা জোড়ালোভাবে মনে দাগ কাটে না, মনে হয় এ তো হরহামেশাই হচ্ছে, এ আর এমন কি ইত্যাদি টাইপের মনোভাব থাকে মনে। কিন্তু “মায়াজাল” শব্দটি দিয়ে, একটা আটকে যাওয়া অবস্থা বোঝানো হয়, মাকড়শার জালে যেমন পোকামাকড় আটকে যায়, মাছ ধরার জালে যেমন মাছ আটকে যায়। মায়াজাল, মানে ভালোবাসা, প্রেম, মমতা, স্নেহ... ইত্যাদি অনুভূতিগুলো মানুষকে “মায়াজালে” আটকে রাখে, টেনে ধরে, ছুটে যেতে দেয় না, বেরিয়ে যেতে চাইলেও বারবার আটকে রাখে। এখানে কবি “গীবত’কে” মায়াজাল এর মতো দেখেছেন। জেনে বুঝেও আমরা এর থেকে বের হতে পারি না অনেকসময়।
গীবত চর্চা এমন একটা আচরন যা আমাদের মনে এক ধরনের পৈচাষিক আনন্দ দেয়, অন্যের অনুপস্থিতে তার সম্পর্কের কিছু বলা যেন আমাদের এক আনন্দের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে এমন একটা দিন পাওয়া দুস্কর হয়ে যার যেদিন কোন গীবত করা হয় না, এক মিনিটও গীবত হয় না এমন দিন আমাদের বেশীরভাগ মানুষের জীবনেই হয় না। অনেকে বেশ সচেতন থাকার পরও মনের অজান্তেই গীবত চর্চা করে ফেলি, ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়েও গীবত শুনে ফেলি, গীবত শোনা থেকে নিজেকে সরিয়ে আনা খুব কঠিন একটি কাজ। গীবত করা এবং গীবত শোনা, দুটো বিষয়কে যোগ করে যদি আমাদের জীবন কল্পনা করি, এর থেকে হয়তো বা আমরা কেউই মুক্ত না। সচেতনভাবে অনেকেই মুক্ত থাকতেই চাই কিন্তু তারপরও মুক্তি মেলে না। এটাকেই মূলত কবি “মায়াজাল” শব্দে বোঝাতে চেয়েছেন।
শুরুটা করেছেন, মানুষের সম্মান মানুষই নষ্ট করে, ক্রমাগত দুর্নাম করে, তিলকে তাল করে উপস্থাপন করে অন্যকে ছোট করে। মানুষকে অন্য কোন প্রানী কি অপমান করতে পারে? মানুষ যেমন মানুষকে অপমান করতে পারে আবার অন্য প্রানীকে মানুষই তার মর্যাদা বিনষ্ট করতে পারে। তাই কবি শুরুটা মানুষকেই মানুষের শত্রু হিসেবে অবিহিত করেছেন।
ইনিয়ে বিনিয়ে, অন্যের খুত খুঁজে বের করা, সত্যকে মিথ্যে এবং মিথ্যেকে সত্য হিসেবে উপস্থাপন করা, কারনে অকারনে অন্যকে হেয় করা, অন্যের সম্পর্কে একজন থেকে বহুজনে প্রবাহিত করে গোটা সমাজকে কুলষিত করা, কেউ ভালো কাজ করলেও তার পেছনে কোন খারাপ উদ্দেশ্য আছে এমনটা প্রমান করা ইত্যাদি হলো গীবতের কেন্দ্রীয় বিষয়। গীবত অনেকটা আমাদের জীবনে অক্সিজেন নেয়ার মতো ব্যাপার হয়ে গেছে, গীবত ছাড়া যেন আমরা বাচতেই পারবো না।
আমাদের মধ্যে অনেকেই, যথেষ্ট মাত্রায় ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলি, ধর্মীয় রীতি রেওয়াজ, আদেশ নিষেধ, করণীয় বর্জনীয় ইত্যাদি বিষয়গুলো বেশ গুরুত্বের সাথে পালন করে থাকি কিন্তু “গীবত”, যে বিষয়ের উপর ইসলাম ধর্মের মূল গ্রন্থ “কোরআন” এবং রসুল (সাঃ) এর জীবন দর্শন অর্থাৎ হাদীস গ্রন্থে বারবার নিষেধাজ্ঞা জারী হয়েছে এবং এর জন্য পরকালের চরম শাস্তির ঘোষনাও দেয়া হয়েছে, কিন্তু তারপরও আমরা “গীবত” থেকে মুক্ত রাখতে পারি না নিজেকে, এটাই “গীবতের মায়াজাল”।
খুব ভালো একটি উপপাদ্য নিয়ে কাব্য রচনার জন্য কবি’র জন্য রইলো অফুরান শুভেচ্ছা।