আলোচনা ৭৪
ভাবছিলাম, সাপ্তাহিক নির্বাচিত কবিতা নিয়ে আলোচনা করলে কেমন হয়? প্রতি সপ্তাহে নির্বাচিত কবিতাগুলো খুব মন দিয়ে পড়া হয় কিন্তু আলোচনার জন্য কখনো নির্বাচন করা হয়নি, কেননা কবিতাগুলো এমনিতেই নন্দিত এবং নির্বাচিত বরং অন্য কবিতাগুলো আলোচনার জন্য নির্বাচন করেছি বরাবর। কিন্তু কবি প্রবীর চ্যাটার্জী(ভোরের পাখি) এর কাব্য ‘নস্টালজিক টেলিফোন’ ভিন্ন এক আমেজ দেয়াতে এবার তাই নিয়ে আলোচনা করার ইচ্ছে তৈরি হয়েছে।
একটা প্রবাদ প্রায়শই শোনা যায় ‘ যায় দিন ভাল, আসে দিন খারাপ”, এর বাস্তবিক সত্যতা আছে নাকি কেবলই নস্টালজিক অনুভূতি? এর ব্যাখা ভিন্ন ভিন্ন মানুষের কাছে ভিন্ন হবে তবে তুলনাটা গত কালকের সাথে আজকের তুলনা করে এমনটা বলা হয় না, খুব স্বল্প সময়ের ব্যবধানে এ প্রবাদের কোন বাস্তবতা নেই। তুলনাটা যদি মোটামুটি দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে হয় তখন তার যৌক্তিকতা খুজে পাওয়া যেতে পারে, যেমন তুলনা হতে পারে এক দশক আগে এবং পরে, তুলনা হতে পারে এক জেনারেশন আগে এবং পরে, তুলনা হতে পারে এক রিজিম এর আগে এবং পরে কিংবা হতে পারে শৈশব কৈশোর এবং মধ্য বয়সের সাথে। যে ব্যক্তি তুলনামূলক উভয় সময়ের চিত্রের সাথে পরিচিত, কেবল তার পক্ষেই তুলনা করা সম্ভব এবং নস্টালজিক হাওয়া সম্ভব। শুধুমাত্র এক সময়ের সাক্ষী কোন ব্যক্তি নস্টালজিক হতে পারে না, হওয়া সম্ভবও নয়।
প্রবীর চ্যাটার্জী (ভোরের পাখি) তার কাব্যে যোগাযোগ মাধ্যম এর অন্যতম আবিস্কার টেলিফোন এর সাথে বর্তমান সময়ের যোগাযোগ মাধ্যম সেল ফোন এর সাথে তুলনা করে নস্তালজিক হয়ে পরেছেন। কবিতায় ব্যাখা করেছেন, আগে কারো সাথে যোগাযোগ করার জন্য বিশেষত প্রামিকার সাথে যোগাযোগের ক্ষেত্রে টেলিফোন মাধ্যমের সাথে কতটা আবেগ, অপেক্ষা, উৎকণ্ঠা, অনিশ্চয়তা, উপেক্ষা ইত্যাদি কাজ করতো এবং অবশেষে সফল হলে পরে তার প্রাপ্তি, আনন্দ, উল্লাস… মনের ভেতর কিভাবে তোলপাড় করে দিত। একটি টেলিফোন এক কারনে আবেগ কিভাবে ঝরে ঝরে পড়তো, আবেগ কতটা স্থায়ী এবং কিভাবে তা জীবনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত!!
কিন্তু আজকাল, সেল ফোন এর কল্যানে একই কাজ অনেক সহজ হয়েছে, অনেক গতি প্রাপ্ত হয়েছে কিন্ত হারিয়ে গেছে সেই আবেগ, উৎকণ্ঠা এবং প্রাপ্তির বাদ ভাঙা উচ্ছাস। এই প্রজন্মের যারা শুরু থেকেই সেল ফোন ব্যবহার ক্রছে, তাদের পক্ষে টেলিফোন এর গুরুত্ব বোঝা মুশকিল, তাদের বোঝানোও কঠিন। কেনন তারা কোন আবেগিক প্রক্রিয়ার সাথে পরিচিত নয়, সেল ফোন কিংবা টেলিফোন তাদের কাছে কেবলই একটি যোগাযোগ মাধ্যম, এর বাইরে তার কোন আবেদন নেই। কিন্ত প্রবীর চ্যাটার্জী এর কাছে, টেলিফোন শুধুই যোগাযোগ মাধ্যম নয়, এর সাথে জড়িয়ে আছে আবেগ, হৃদয়ে তোলপাড় করা উচ্ছ্বাস, দূর থেকে ভেসে আসা প্রেমিকার কণ্ঠের মধুরতা, প্রেমিকার সাথে কথা বলার মরণপণ চেষ্টা ইত্যাদি।
এসবই কবিতার মুল প্রতিপাদ্য বিষয় হয়ে উঠে এসেছে ‘নস্টালজিক টেলিফোন’ কাব্যে। এখানে টেলিফোন কেবল একটি উপমা, মুল বক্তব্য, আমরা হারিয়ে ফেলেছে আমাদের জীবনের আবেগ যদিও বিজ্ঞান দিয়েছে অনেক বেগ এবং গতি। আমাদের কাজ আগের চেয়ে অনেক সহজ হয়েছে ঠিকই কিন্তু আমরা জীবনকে কাছে থাকে অনুভব করেতে ভুলে গেছি, হারিয়ে ফেলেছি জীবনের ছন্দ। কেউ কেউ মনে করেন, নস্টালজিক হওয়া কিংবা নস্টালজিক থাকা, অনেকটা ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকিয়ে থেকে, সামনে এগোতে চাওয়া আবার কেউ মনে করেন, কিছু সময় নস্টালজিক হয়ে পরার অর্থই হোল জীবনের প্রান স্পন্দনে ফিরে যাওয়া। পক্ষ বিপক্ষ নানা মত থাকার পরও, মানুষ কোন কোন সময় নস্টালজিক হয়ে পরে এটাই বাস্তবতা।
কবির জন্য রইলো অভিনন্দন, খুব সুন্দর একটি বিষয় নির্বাচন করার জন্য।