আলোচনা ২০
কবিতাটি নানা কারনেই আমাকে আকর্ষণ করেছে, অনেক দিন থেকেই ভাবছিলাম, কবিতাটিকে আলোচনার পাতায় নিয়ে আসব, আরও বেশী করে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করাবো কিন্তু সময় করে উঠতে পারছিলাম না। রোহিঙ্গা ইস্যুতে ইমারজেন্সি কাজের কারনে,ক্যাম্পে ক্যাম্পে ঘুরছি,ফলে কবিতার আসরে আসা হচ্ছে না খুব একটা।
কবি রীনা বিশ্বাস (হাসি) যদিও কবিতার শিরোনাম ‘পুরুষ দিবস’ রেখে পুরো কবিতাটি পুরুষের মর্মবেদনা, হতাশা, অভিমান এবং সামাজিক অনুশাসন দ্বারা নানাভাবে নির্যাতিত হওয়ার কথা ফুটিয়ে তুলেছেল ফলে আপাদ দৃষ্টিতে পক্ষপাত দোষে দুষ্ট হতে পারে অনেকের কাছে। সেকারনে কবি কিছুটা সতর্কতা মুলক ব্যবস্থা নিয়েছেন, শুরুতেই একটা ফুট নোট দিয়েছেন “(সমালোচনায় না গিয়ে সহমর্মিতারসাথে কবিতাটি পাঠ করবেন। ব্যাতিক্রম সব কিছুতেই আছে, থাকবেও...।” যদিও আমার ব্যাক্তিগত দ্বিমত আছে এ জাতীয় ফুট নোট এর ব্যাপারে (নারী কিংবা পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রেই), কেন সেটা আলোচনায় বলার চেষ্টা করবো।
অনেকগুলো প্রত্যয়কে যুক্তি করে কবিতাটি লেখা হয়েছে যদিও তা সরাসরি বলা হয়নি। মানবতাবাদ, নারীবাদ কিংবা পুরুষতন্ত্র এবং তার বিপরীতে নানা ধরনের ভুল ধারনাকে কেন্দ্র করেই মুলত কবিতা। মানবতাবাদ প্রয়োগ হলে নারীবাদ আলাদা ভাবে কেন দরকার হয়? নারীবাদ কি শুধু নারীর ইস্যু নিয়েই কথা বলে? একজন পুরুষই কি কেবল পুরুষতন্ত্রের ধারক? একজন নারী কি পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার অধিকারী হতে পারে? এসব আলোচনাকে কেন্দ্র করেই নানা ধরনের ভুল ধারনা আছে সমাজে। নারীবাদের বিপরীতে কি পুরুষবাদ চালু হবে? তাহলে নারী দিবসের বিপরীতে পুরুষ দিবস দরকার।
মূলত পুরুষ তন্ত্রের মূলোৎপাটন করাটাই জরুরী বিষয়, একজন নারীও পুরুষতন্ত্রের মানসিকতা সম্পন্ন হতে পারে। সে কারনে, শাশুড়ি-ছেলের বউ দন্ধ দেখা যায় । সাধারণভাবে মনে করা হয়, নারীই নারীর শত্রু, কিন্তু মুলত ঘটনা সেরকম নয়। একজন শাশুড়ি মেয়ের জামাই এবং ছেলের বউরের সাথে একই আচরণ করেন না কেন, কারন প্রত্যেক শাশুড়ি একেকজন পুরুষতন্ত্রের ধারক। ফলে তিনি যখন মেয়ের মা তখন তিনি শক্তিহীন মানুষ আবার সেই একই মানুষ যখন ছেলের মা তখন তিনি শক্তিশালী মানুষ। তার শক্তির উৎসই তাকে এবং তার আচরণকে নিয়ন্ত্রন করে। ফলে মুল শত্রু হোল পুরুষতন্ত্র, একজন ব্যক্তি নারী কিংবা ব্যক্তি পুরুষ কেউই নন। এখানে শাশুড়ি নারী নাকি পুরুষ সেটা কোন বিষয়ই না।
সমাজে পুরুষতন্ত্র চালু থাকার কারনে, একজন নারী যেভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন, একইভাবে পুরুষরাও হন কিন্তু ভুল ধারনার কারনে, কেবল নারী নির্যাতন কিংবা নারী নিপীড়নের কথাই বার বার বলা হয় ফলে ভুল ধারনাগুলো সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। একজন পুরুষ তার কাছের মানুষ (বাবা, মা ভাই বোন) মারা গেলেও কাদতে পারে না, সে না খেয়ে থাকলেও রান্না করতে শিখে না, উপার্জন না করা পর্যন্ত বিয়ে করতে পারে না (বয়স যতই হউক), পরিবারের সমস্ত অর্থনৈতিক দায়ভার কাধে নিতে হবে, চুরি করে হলেও সংসারের খরচ মেটাতে হবে, কান্নায় বুক ফেটে গেলেও কাঁদতে পারবে না............ ইত্যাদি অসংখ্যা উদাহরন আছে (নারীর ক্ষেত্রেও অনেক উদাহরন আছে)। ফলে পুরুষতন্ত্র নারী পুরুষ উভয়কেই ক্ষতিগ্রস্ত করে।
কবি সে কথাগুলোই বলেছেন “পুরুষকে কেউ ভাবেনি, তার ব্যথার খবর নিতে কেউ কখনো আসেনি । কখনও মায়ের লাঞ্ছনা, কখনও ভগিনীর অত্যাচারে শিশুকালে বুক ফেটেছিল তার...” কিংবা “নীরব হতাশা জমাট বেঁধেছিল পাঁজরের তলে;কেউ দেখেনি তার অন্তর,কেউ বোঝেনি তার অব্যাক্ত বেদনার ভাষা......”
সমাজ নির্ধারিত আচরনেই পুরুষকে অভ্যস্ত হতে হয়, নিজের হৃদয়, অনুভুতির কোন দাম নেই, কবি যেমনটা বলেছেন “অনেকটা মেকী হাসি দিয়ে কাটিয়েছিল মন ভোলান বিনিদ্র রাত” । সমাজ বা পুরুষতন্ত্রই বলে দিয়েছে পুরুষকে কখন কি করতে হবে, কখন কঠোর থাকতে হবে কিংবা কখন নিজেকে বিলিয়ে দিতে হবে, কবির ভাষায় “পুরুষ হৃদয়হীন নয়, কঠোর হয়েছে আপন ধী-শক্তিতে নিজেকে দণ্ডায়মান রাখতে”।
ফলে কবিতাটিকে আমার দারুন লেগেছে। অনেকদিন পর, ‘পুরুষতন্ত্র কনসেপ্ট” নিয়ে লেখা কবিতা পড়লাম। পুরুষতান্ত্রিক মানুসিকতার কারনে নারীও একই ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ভিন্ন মড়কে। ফলে পুরুষের কিংবা নারীর কারোরই পুরুষতন্ত্র দ্বারা ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ার বিষয়টিকে আমি আর সহমর্মিতার বিষয় বলে ভাবতে পারি না। এটি আসলে একটি দার্শনিক লড়াই, সমাজ পরিবর্তনের লড়াই, সেটা কোনভাবেই সহমর্মিতা দিয়ে মোকাবেলা করা সম্ভব নয়। কবির জন্য অনেক শুভেচ্ছা থাকলো