আলোচনা ১২৯

আলোচনার  জন্য এই কবিতাটি নির্বাচন করার একটি বিশেষ কারন হলো, তাওবাদী কাব্য দর্শন এবং ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গির একটি সমন্বয় দেখতে পাচ্ছি। গত দুবছর আমি তাওবাদ নিয়ে বেশ পড়াশুনা করেছিলাম। তাওবাদ এর ৮২টি কাব্য দর্শন বাংলাদেশের ৩জন কবি অনুবাদ করেছেন (৩টি বইই কিনেছিলাম, আমার সংগ্রহে আছে) এবং গত অগাষ্ট-২০২১ থেকে তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব নিয়ে পড়ছি, ফলে কবিতাটি, আমার ভালো লাগার স্থান দখল করে নেয়। বলে নেয়া ভালো, আমি মুলত কবিতা আলোচনা করি, কবিতা পড়ার পর আমার অনুভূতি ব্যক্ত করার জন্য, কবিতার ব্যকরণগত দিক ভালো জানি না কিংবা কাব্যমানে কবিতাটি উত্তীর্ণ কিনা, সে বিবেচনাও মাথায় থাকে না।

কবিতার শুরুটাই হয়েছে, তাওবাদী দর্শন দিয়ে, আক্ষরিক অর্থে এর কোন অর্থ খুঁজে পাওয়া যাবে না কিন্তু একটি দর্শন লুকানো আছে যেমন-

প্রতিযোগিতায় হারতে হবে আমাকে
তবেই আমি জিতবো;

কোন প্রতিযোগীতায় “হেরে গেলে” আবার “জেতা” হয় কেমন করে? এর কোন আক্ষরিক অর্থ নেই।  তাওবাদ যেমন বলে, “সফলতাও ব্যর্থতার মতোই ভয়াবহ”, সফলতা যদি ভয়াবহ হবে তবে আর মানুষ সফলতার পেছনে ছুটছে কেন? এখানে মূল দর্শন হলো, মানুষকে কোন এক জায়গায় থামতে হবে, তা না হলে, সফলতার পেছনে ছুটতে ছুটতে জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠে, কাজেই ব্যর্থতা যেমন মানুষকে বিমর্ষ করে তোলে, তেমনি ক্রমাগত সফলতার চিন্তাও মানুষকে হতাশার দিকে ঠেলে দেয়, যে কারনে সফলতাও ব্যর্থতার মতোই ভয়ংকর। এই কবিতায়, “হেরে গেলেই” জেতার মনোভাব তৈরী হবে, জেতার জন্য কঠোর প্রশিক্ষন শুরু হবে, জেতার জন্য মরিয়া হয়ে উঠবে মন, ফলে এখানে হেরে যাওয়াটা পরবর্তীতে “জেতার” ফাউন্ডেশন তৈরীর রূপকার হিসেবে কাজ করবে। কোন প্রতিযোগীতায় জেতার যে আনন্দ,জেতার যে স্বাদ, উচ্ছাস, উল্লাস, তা হেরে যাবার ফলে ভেতরটা কুঁড়ে কুঁড়ে খাবে, সেটাই তৈরী করবে জেতার স্বাদ গ্রহন করার অদম্য এক তাড়না। একইভাবে অন্যের সফলতা কিংবা তাদের অনেক কিছু আছে কিন্তু আমার নেই, সেটা মনঃকষ্টের একটা বড় কারন। কিন্তু এখানে নিজেকে সংযত রাখার একটা তাগিদ রাখা হয়েছে।

তার পরপরই, নিজেকে সংযত রাখার উপায় বলা হলো, কিভাবে নিজেকে সংযত রাখবো আমি, ফলে  সৃষ্টিকর্তার কাছে (যে কোন ধর্মেই সৃষ্টিকর্তা আছে) নিজেকে সপে দেয়া, তার কাছেই প্রত্যাশা করা, তার কাছে নিজের যতটুকু আছে, আগে তার শোকরিয়া জ্ঞাপন করে, তার জন্য কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করার পরে নিজের চাওয়ার জন্য আবার প্রার্থনা করা। আরবী শব্দে যেমন বলা হয়, লা-তাখাফ ( দুশ্চিন্তা করবেন না, আল্লাহর উপর সব ছেড়ে দিন) কিংবা লা-তাসখাত (আল্লাহর ফয়সালায় অসন্তুষ্ট হবেন না)। ফলে কবিতার মধ্যে একটা চমৎকার ছন্দ খুঁজে পাই।

প্রথমে নিজেকে উদ্দীপ্ত করার জন্য “তাওবাদী দর্শন”,ব্যবহার হলো পারে আবার হতাশা থেকে মুক্ত করার জন্য “ধর্মীয় দর্শন” ব্যবহার হলো। অল্প কথায়, দারুন এক কাব্য, বেশ ভালো লাগলো

কবির জন্য রইলো শুভেচ্ছা

নোটঃ
তাও তে চিং বা তাওবাদঃ খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে উত্তর চীনে লাওসি’র জন্ম।তিনি পৃথিবীর প্রাচীনতম দার্শনিকদের একজন।লাওসি ‘তাও-তে-চিং’ নামক গ্রন্থে তাঁর নিজস্ব দার্শনিক মতবাদ সংকলিত করেন।এ গ্রন্থের নাম থেকেই তাওবাদ শব্দটির উৎপত্তি। তাওবাদ চীনের নিজস্ব ধর্মীয়, দার্শনিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, যা গত দুই হাজার বছরেরও অধিক কাল যাবত চীনের সামাজিক জীবনকে প্রভাবিত করে এসেছে। তাওবাদকে চীনের লোকজ ঐতিহ্য ও কনফুসীয় ঐতিহ্যের সংযোগকারী হিসেবেও বিবেচনা করা হয়। সুনির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে, তাওবাদের মূলভিত্তি হলো লাওসি নামক চীনা দার্শনিকের লেখনী।এর পাশাপাশি চুয়াং-ৎসু নামক অপর এক চীনা দার্শনিকের রচনাও তাওবাদের ওপর যথেষ্ট প্রভাব ফেলেছে।

‘তাও’ মানে পথ। আধ্যাত্মিক সাধনার মাধ্যমে সে পথে সবকিছ পরিচালিত করা হয়।এ পথ অনাদি, অনন্ত, অপরিবর্তনীয়। তাওকে বিবেচনা করা হয় অতীন্দ্রিয়, রহস্যময়, সর্ব ব্যাপীসত্ত্বা, নীতি, আকৃতি, বস্তু বা অস্তিত্ব হিসেবে। মহাবিশ্ব, প্রকৃতি বা মানবদেহের বৈশিষ্ট্য বুঝতে একে ব্যবহার করা যায়। ‘ইন’ ও ‘ইয়্যাং’ নামক দু’টি বিপরীতমুখী শক্তি দ্বারা তাওবাদের যুক্তি ব্যাখ্যা করা হয়। এ দু’টি শক্তি একে অপরের পরিপূরক এবং পরস্পর-নির্ভরশীল মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে এরা বিভিন্ন প্রক্রিয়া ও প্রণালীতে ভারসাম্য আনে। ‘ইন’ ও ‘ইয়্যাং’ এর বৈপরীত্য ও ঘাত-প্রতিঘাতের কারণেই প্রকৃতিতে উৎপাদন, প্রজনন ও রূপান্তরের অসীম চক্র নিয়ত প্রবহমান থাকে। তাওবাদ মূলত এ বিশ্বজনীন অভিজ্ঞতারই ব্যাখ্যা।এর অন্যতম লক্ষ্য হলো মানুষ, প্রকৃতি ও জীবনে তিন-ধরণের উৎকর্ষ আনয়ন করা: যথা সুস্বাস্থ্য, সামাজিক ভারসাম্য এবং গভীরতর আত্মোপলদ্ধি। লাওসি প্রবর্তিত দার্শনিক মতবাদ খ্রিস্টপূর্ব ২য় শতক পর্যন্ত চীনে ব্যাপকভাবে সমাদৃত ছিল। প্রাচীন চীনের উন্নতির মূলে ছিল তাওদর্শন ও এ ধর্মের মূল আদর্শের চর্চা।পরে চীন দেশে বৌদ্ধধর্ম তাও-দর্শনের সংস্পর্শে এসে নতুন রূপ লাভ করে।জাপানের শিন্টো ধর্মেও এর মূল সুত্রগুলোর প্রয়োগ দেখা যায়। তাওবাদ ৮২টি দর্শন কাব্য নিয়ে রচিত যেখানে বৈপরীত্য ও ঘাত-প্রতিঘাতের উপকরন দেখা যায়, যেমন-


সাফল্য ব্যর্থতার মতোই ভয়াবহ
আশা ও ভয়ের মতো ভয়ংকর।

ভেতরই বাহিরের ভিত্তি।
স্থিরতাই গতির উৎস।

অশান্তিকে গলা টিপে মেরে ফেলো না
এর ও আছে পূর্ণতা পাবার অধিকার।