আলোচনা ২১৯
“প্রশ্ন কোর না”, এই একটি বাক্য অনেক কথা বলে দেয়, অনেক ইঙ্গিত দেয়, অনেক না বলা কথা বলা হয়ে যায়। একটি মাত্র লাইন, কয়েকটি মাত্র শব্দ কিন্ত এর ভেতরে আছে, সমাজ বাস্তবতা, শিক্ষা ব্যবস্থার নীতি, রুগ্ন হাড় আর কঙ্কালসার মানুষের বঞ্চনা, খুঁজে পাওয়া যায় শোষনের ইতিহাস। কবিতার শিরোনামই বলে দিচ্ছে কবিতার ভেতর কি থাকতে পারে, কবি কি বলতে চাচ্ছেন? সে অর্থে শিরোনামটি যথার্থ এবং পাঠকের মনোযোগ আকর্ষন করার জন্য যথেষ্ট। কবিতার শিরোনাম একটি গুরুত্বপুর্ণ বিষয়। শিরোনাম যথার্থ না হলে, কবিতার ভেতরে পাঠককে প্রবেশ করানো খুব কঠিন। কবি প্রণব লাল মজুমদার, তার কবিতার শিরোনামেই দক্ষতার পরিচয় রেখেছেন বেশ জোড়ালোভাবেই, অন্তত আমার তাই মনে হয়েছে।
বর্তমান বিশ্ব ব্যবস্থায়, সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ায়, শিক্ষা ব্যবস্থায় কোথাও প্রশ্ন করা শেখায় না, প্রশ্ন করাকে উৎসায় দেয় না, প্রশ্নকারীকে উৎসাহী করে তোলে না। বরং উল্টোভাবে, কেউ কেউ স্বভাবগতভাবে প্রশ্ন করতে অভ্যস্ত হয়ে উঠলে তাকে নানাভাবে হেনস্তা করা হয়। আমরা বর্তমানে যে ধরনের শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে বেড়ে উঠি সেটাকে বলা যায়, “মেনে নেয়ার শিক্ষা{, “মেনে নেয়ার সংস্কৃতি”তে আমরা বেড়ে উঠি এবং পরে আমরা নিজেরাও “প্রশ্ন না করার সংস্কৃতি’কে প্রমোট করে থাকি।
পাওলো ফ্রেরী নামক একজন ব্রাজেলিয়ান দার্শনিক এবং শিক্ষাবিদ এই পুরো ব্যবস্থাটাকে বলেছেন “অত্যাচারীতের শিক্ষা” অর্থাৎ অত্যাচারী হয়ে উঠবার জন্য শিক্ষা।। পরে তিনি একটু নুতন শিক্ষা ব্যবস্থার দিকে সবার নজর কাড়েন এবং তার নাম দেন “REFLECT-which is Community Empowering Methodology combination of Paolo Frere’s Philosophy and Robert Chambers Methodology. উল্লেখ্য আমি দীর্ঘদিন রিফ্লেক্ট নিয়ে কাজ করেছি, ফলে পুরো বিষয়টা সম্পর্কেই ধারনা আছে।। যে কথা বলছিলাম, প্রশ্ন করতে না পারা, প্রশ্ন করতে না শেখানো, প্রশ্ন করতে নিরুৎসাহিত করা হয় কখনো সমাজের চর্চা ও নীতির কারনে, কখনো ধর্মের দোহাই দিয়ে, কখনো বা দীর্ঘদিনের অভ্যস্ততা থেকে বেরিয়ে নুতন এক ব্যবস্থার প্রতি ভয় বা আশংকা থেকে। কবি, সে বিষয়টাই তার কাব্যে সুচারুরূপে তুলে ধরেছেন।
মুলত মানুষ যখন প্রশ্ন করতে পারে না বা করতে চায় না, তখন নানা ধরনের অন্যায়, অত্যাচার, নিপীড়ন, শোষন ইত্যাদিতে ভুক্তভোগী হয়ে থাকে এবং বিপরীত দিকে থাকা শোষক, অত্যাচারী রাষ্ট্র প্রধান, ধর্মীয় নেতা, সমাজ নেতা কিংবা আধুনিক কালের কর্পোরেট মহাজনেরা নিজেদের আখের গুছিয়ে নিতে পারেন মানুষের চোখে ধূলো দিয়ে। মানুষের রক্ত শুষে নিতে পারেন অনায়াসে আর সে কারনে তারা “প্রশ্ন করো না” সংস্কৃতিকে সমাজে জিইয়ে রাখে দিনে পর দিন, যুগের পর যুগ, শতাব্দী পর শতাব্দী। কবি প্রণব লাল মজুমদার অত্যান্ত দক্ষতার সাথে পুরো শোষন প্রক্রিয়াটিকে “প্রশ্ন করো না” কাব্যে ফুটিয়ে তুলেছেন।
একজন বৃদ্ধ বিভুক্ষ, ফুটপাতে বসে থাকা বস্তিবাসী এক গৃহস্থকে বলছে “ খাও, যেটুকু পাও, যে টুকু দিচ্ছে দু’হাত বাড়িয়ে নাও, ফিরিয়ে দিও না মোটে, ভেবে নাও এটুকু ছিলো বরাতে”। এখানে ভাগ্যকে নিয়ন্ত্রক হিসেবেই দেখা হচ্ছে, নিজের পাওনাকে ভাগ্যের সাথে সম্পৃক্ত করে দেখাঁ হচ্ছে। কতটুকু পাওয়ার কথা, কতটুকু থেকে তাকে বঞ্চিত করা হচ্ছে, সে প্রশ্নকে থামিয়ে দেয়া হচ্ছে সুপরিকল্পিতভাবে। তথাকথিত ভাগ্য বিপর্য্যের পেছনের কারন আড়ালে থাকে যাচ্ছে।
তার পরই প্রশ্ন তৈরি হয় নিজের কাছেই- প্রশ্ন করে কি লাভ ?
কবি এক ঝটকায়, মানষের প্রশ্ন করার প্রবনতাকে ভিন্নভাবে ঘুরিয়ে দেখিয়েছেন, কিভাবে প্রশ্নগুলো নিজের কাধেই আটকে থাকে বছরের পর বছর। দুখন্ড রুটি যেটুকু পাওয়া গেলো , সেটুকু না নিলে অভুক্ত থাকতে হবে। ফলে, নিজের পাওয়া প্রশ্নটি অভুক্ত থাকার কাছে হার মেনে নিলো।
এভাবেই কবি, ধারাবাহিকভাবে, পুরো শোষন প্রক্রিয়্যাকে বাবুর দর্জির দোকান, বাবুর সমাজসেবী ইমেজ, তার দর্জির দোকানে ফুটো প্যান্ট তৈরি এবং তার মধ্যে দিয়ে মানুষের কষ্টার্জিত অর্থ বেরিয়ে যাওয়া… ইত্যাদি দৃশ্যপটে পুরো একটি রাষ্ট্র ব্যবস্থায় কিভাবে দুর্বত্তায়নের মাধ্যেমে মানুষ থেকে ট্যাক্স আদায় করা হয় এবং তা শোষণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তথাকথিত বাবুরা ধনী হয়ে ওঠে এবং সমাজসেবার নামে মানুষের প্রশ্নগুলোকে গিলে ফেলতে বাধ্য করে।
কবিতার আকার খুব বেশি বড় না হলেও, পুরো ক্যানভাসটি বিশালতাকে ধারন করেছে অল্প শব্দে। কবি খুব অল্প পরিসরে, মানুষের শোষন আর বঞ্চনার পুরো প্রক্রিয়াটিকে রূপায়ন করেছেন বেশ দক্ষতার সাথে। কবিতাটি আমার ভীষন ভালো লেগেছে। কবি’র জন্য রইলো শুভেচ্ছা।