আলোচনা ১১৭
কবি কামাল উদ্দিন আজাদ খোকন অনেক দিন ধরেই “অনিবার্য মৃত্যুর সংলাপ” নিয়ে সিরিজ লিখছেন, এ পর্যন্ত ১০টি লিখেছেন, সবগুলোই পড়ার সুযোগ হয়েছিল যদিও কোনটিরই মন্তব্য লিখিনি, আজ পড়লাম সিরিজের ১০তম কাব্যটি। মৃত্যু নিয়ে অনেকেই কবিতা, উপন্যাস কিংবা গল্প লিখছেন, মৃত্যু পরবর্তী জীবন নিয়ে আমাদের কোন ধারণা নেই, কল্পনাপ্রসূত হয়ে অনেক কিছুই ভাবতে পারি, লিখতে পারি, অনেকেই আবার মৃত্যু পূর্ববর্তী অনুভুতি নিয়ে লিখছেন। কবি, সাহিত্যিক কিংবা গল্পকারদের ‘মৃত্যু অনুষঙ্গ’ নিয়ে লেখাগুলো সংগ্রহ করছি, একটি বিশ্লেষণ মুলক প্রবন্ধ লিখছি, শেষ হলেই আসরের পাতায় শেয়ার করবো ভাবছিলাম। আগামী এক বছরে এরকম ১৫টি (যেমন- মৃত্যু, চাঁদ, প্রেম-বিরহ, মানবতাবাদ, পিতা-মাতা, ঋতু বৈচিত্র্য ইত্যাদি) অনুষঙ্গ নিয়ে কাজ করার / গবেষণা করার ইচ্ছে রয়েছে, কেন এই প্রত্যয়গুলো বেশী ভাবাচ্ছে, এর ভেতরের মর্মবাণীগুলো কিভাবে প্রভাবিত করছে ইত্যাদি।
মনসুর আহম্মদ “রবীন্দ্রনাথের মৃত্যু দর্শন’ নিয়ে লিখেছেন- এই ধরণীতে মানুষ সবচাইতে বেশী ভয় করে মরণকে। মানুষ সব সময় মরণকে এড়িয়ে পালিয়ে বেড়াতে চায়। মহাদেব সাহা তার ‘মৃত্যুর প্রাচীন ভাষ্য’তেঁ লিখেন- “কোনো কোনো মুহূর্তে এই মৃত্যুও হয়ে ওঠে জীবনের গূঢ় অভিষেক আরো গভীর বাঙ্ময়। সে-মৃত্যু প্রার্থনা করি, সে-মৃত্যু প্রণাম করে যায় একদিকে তুমি, একদিকে মৃত্যুর মৌনতা যেন বৃক্ষের ছায়ায় আরো শুদ্ধ পুণ্যশীল”। হুমায়ূন আহম্মেদ তার অসংখ্য লেখায় ‘মৃত্যুকে’ নানা ভাবে দেখেছেন-
• “মৃত্যুর সময় পাশে কেউ থাকবে না, এর চেয়ে ভয়াবহ বোধ হয় আর কিছুই নেই। শেষ বিদায় নেয়ার সময় অন্তত কোনো একজন মানুষকে বলে যাওয়া দরকার। নিঃসঙ্গ ঘর থেকে একা একা চলে যাওয়া যা্য় না,যাওয়া উচিত নয়। এটা হৃদ্য়হীন ব্যাপার” .. (বই-দেবী)
• “মৃত্যু টের পাওয়া যায়। তার পদশব্দক্ষীন কিন্তু অত্যন্ত তীক্ষ্ণ” ... (বই- তোমাকে)
• “অসম্ভব ক্ষমতাবান লোকেরা প্রা্য় সময়ই নিঃসঙ্গ অবস্থায় মারা যায়” ... (বই- আকাশ জোড়া মেঘ)
• “আমরা জানি একদিন আমরা মরে যাব এই জন্যেই পৃথিবীটাকে এত সুন্দর লাগে। যদি জানতাম আমাদের মৃত্যু নেই তাহলে পৃথিবীটা কখনোই এত সুন্দর লাগতো না” ... (বই-মেঘ বলেছে যাব যাব )
মাওলানা জালালউদ্দিন রুমি তার কাব্য “যখন আমার মৃত্যু আসবে’তে লিখেছেন- “যখন আমার কফিন নিয়ে যাবে, তুমি কখনো এটা ভেবোনা- আমি এ পৃথিবী থেকে হারিয়ে যাচ্ছি!...”। মৃত্যুজনিত শোক থেকে উচ্চারিত হয়েছিল আদিকবি বাল্মীকির প্রথম শ্লোক। “সম্মুখ সমরে পড়ি, বীর চূড়ামণি / বীরবাহু চলি যবে গেলা যমপুরে অকালে”, -বীরবাহুর মৃত্যু সংবাদ দিয়ে শুরু হয়েছে মাইকেল মধুসূদন দত্তের “মেঘনাদবধ কাব্য”। রবীন্দ্রনাথের দীর্ঘ ব্যক্তিগত জীবনে বারবার মৃত্যু এসে ছায়া ফেলে গেছে। ১৮৭৫ সালে রবীন্দ্রনাথ মা’কে হারান, ১৮৮৪-তে বৌঠান কাদম্বরী দেবী, ১৮৯৯-এ বলেন্দ্রনাথ ঠাকুর, ১৯০২-এ স্ত্রী মৃণালিনী দেবী, ১৯০৩-এ মধ্যম কন্যা রেণুকা, ১৯০৫-এ পিতৃদেব, ১৯০৭-এ ছোটছেলে শমী, ১৯১৮-তে কন্যা মাধবীলতা, ১৯৩২-এ আদরের নাতি নীতুকে হারিয়েছিলেন। ব্যক্তিগত শোককে রবীন্দ্রনাথ পেরেছেন বিশ্বাতীত করে তুলতে। পরিবর্তনশীল জীবনের সঙ্গে মৃত্যুর বহমানতাকে কবি এই পর্বে মিলিয়ে দিতে পেরেছেন। নিজে তিনি তখন ‘মৃত্যু-রাখাল’।
আসরের কবি কামাল উদ্দিন আজাদ খোকন, হঠাৎ করেই “অনিবার্য মৃত্যুর সংলাপ” নিয়ে সিরিজ লিখতে শুরু করলেন কেন? অনেকদিন থেকেই ভাবছিলাম, মৃত্যু তাকে এতটা প্রভাবিত করছে কেন, সেই আগ্রহ থেকেই সবগুলো সিরিজ পড়ে ফেলা এবং আলোচনার পাতায় সবার মনোযোগ আকর্ষণ করার চেষ্টা।
অনিবার্য মৃত্যুর সংলাপ ১ এর মুল প্রতিপাদ্য বিষয়- সময়ের গতিধারার সাথে মৃত্যুর সম্পর্ক অনিবার্য, সময় এগিয়ে গিয়েই মৃত্যুর কাছে পৌঁছে দেয় কিন্তু মৃত্যু অনিবার্য জেনেও আমরা প্রস্তুত থাকি না।
অনিবার্য মৃত্যুর সংলাপ ২ এর মুল প্রতিপাদ্য বিষয়- জীবনের অমোঘ পরিণতি এবং ভয়, আমরা সারাক্ষন মৃত্যু ভয়ে ভীত থাকি, থেমে থেমে কথা বলি, আমরা যত চেষ্টাই করি, মৃত্যু থেকে পালাবার কোন উপায় নাই।
অনিবার্য মৃত্যুর সংলাপ ৩ এর মুল প্রতিপাদ্য বিষয়- আমাদের জীবন এনং তার ছন্দ যতটা আশ্চর্যজনক, মৃত্যুও ততটাই আশ্চর্যজনক। মৃত্যুর ডাক আমারা সব সময় শুনতে পাই, যাকে কবি বলেছেন ‘মৃত্যুর কোলাহল”
অনিবার্য মৃত্যুর সংলাপ ৪-৯ এর মুল প্রতিপাদ্য বিষয়- ঘুরে ফিরে বার বার মৃত্যু ভয়, সংক্ষিপ্ত এই জীবনের মায়া ছেড়ে আমাদের একদিন চলে যেতেই হবে, নিয়তির এক অমোঘ পরিণতি হল মৃত্যু, মৃত্যুর মিছিলের যাত্রা পথ ধরেই আমাদের আসল ঠিকানায় পৌঁছে যাওয়া ইত্যাদি।
সর্বশেষ, অনিবার্য মৃত্যুর সংলাপ ১০ এর মুল প্রতিপাদ্য বিষয়- আমাদের সময় ফুরিয়ে যাচ্ছে খুব দ্রুতই, কথা কম বলে কাজ বেশী করা উচিৎ, জীবনকে যতটা বেশী উপভোগ করার জন্য কাজে মনোনিবেশ করা দরকার, জীবনের সাঁতার কেটেই ওপারে মৃত্যুর দুয়ার, কোন আবদারই এ পথ পরিক্রমার পরিবর্তন করতে পারে না।
কবি এতগুলো সিরিজ লিখছেন কিন্তু মৃত্যুকে ভিন্ন ভিন্ন মাত্রায় দেখার সুযোগ পাননি, কেবল মৃত্যুভয়ই বার বার প্রভাবিত করেছে তাকে নানা ভাবে, নানা ঢঙে। সব মৃত্যু মানব সমাজকে একই বার্তা দেয় না (অকাল মৃত্যু, বার্ধক্য জনিত মৃত্যু ইত্যাদি), একেকটা মৃত্যু একেক রকম অনুভুতি দেয়, সেই বৈচিত্র্য এত গুলো সিরিজ এর মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায় না। সবগুলো সিরিজ এর সারমর্ম “মৃত্যু অনিবার্য, এর থেকে মুক্তি নেই”
কবির জন্য রইলো অফুরান শুভেচ্ছা।