আলোচনা ২২৯
কবিতাটি পড়তে পড়তে মনে হচ্ছিল, একজন কবি কি সার্বক্ষনিক কবি থাকেন? চলতে, ফিরতে, কাজের ফাঁকে, আড্ডায়…তার মাথায় কি কবিতা ঘোরে? কবিতা কি একজন কবি’কে গ্রাস করে ফেলে? আমরা অন্যান্য কাজ যেমন পরিকল্পনা করে করে থাকি, রুটিন মাফিক করে থাকি কিন্তু একজন কবি কি রুটিন করে কবিতা লিখেন? এমন কি হয়? এখন থেকে আগামী এক ঘন্টা কবিতা লিখবো কিংবা রাত ১০টা থেকে ১১টা কবিতা লিখবো? অথবা, এ মাসের টার্গেট, ৫টি কবিতা লিখবো? প্রশ্নগুলো খুব ভাবাচ্ছিল। একেকজন কবির কবিতা লিখার অনুপ্রেরনা বা উৎস কি সময়ের হিসেব কষে নাকি মন মেজাজের উপর নাকি, হঠাৎ করেই মাথায় চলে আসে কোন থীম, আসলে কোনটা বেশি প্রভাবিত করে?
আমি নিজেও সারাদিন প্রচুর চা পান করি ( ১২-১৫ কাপ/প্রতিদিন প্রায়), কেউ কেউ আমাকে চা খোর বলে থাকে। পরিবারের সবাই আমার উপর খুব বিরক্ত, আমার চা-সিগারেট-বই পড়া নেশার কারনে। রমজান মাসে আমার মূল কষ্টটা হয় এই কারনে। ইদানিং বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় এবং অন্যান্য দেশে নিশ্চই, চা কে কেন্দ্র করে নানামুখী এক্সপেরিমেন্ট চলে, মানুষও সেই এক্সপেরিমেন্টে অংশগ্রহন করে থাকে। আগে শুধু দু ধরনের চা এর কথা শুনতাম (দুধ চা এবং রঙ চা), কিন্তু এখন চা এর সাথে হরেক রকম উপাদান মিশ্রিত করে চা হয়, কাচা মরিচের চা, পুদিনা পাতার চা, তেতুল চা, মাল্টা চা......।
এ সুযোগে গুগল সার্চ করে, চা সম্পর্কে একটু পড়ে নিলাম,-
চা সম্পর্কে এমন অনেক চমকপ্রদ তথ্য রয়েছে যা হয়তো সবচেয়ে বেশি চায়ে আসক্ত ব্যক্তিটিও জানেনা। সারাদিন পান করা পানীয়র মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ কি কি? এই প্রশ্নের উত্তরে অনেকেই হয়তো যে কয়েটি পানীয়র নাম বলবেন তার মধ্যে অন্যতম, চা। বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় পানীয়র একটি এই চা। আমাদের চাহিদার কারণে গত তিন শতাব্দীতে এর পাতার ধরণে পরিবর্তন এসেছে বিভিন্ন মহাদেশজুড়ে, কিন্তু এর আবেদন একই রয়ে গেছে।। উটের কাফেলা থেকে শুরু করে রাজনৈতিক বিপ্লব এবং এমনকি পারলৌকিক জীবনের অনুষঙ্গ হয়ে, চা মানবজাতির জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে উঠেছে।
১. চা পানের শুরু চীনে ২০০ খ্রিস্ট-পূর্বাব্দেঃ মধ্য চীনের ইয়াং লিং সমাধিস্তম্ভে প্রাচীনকালে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়াতে যেসব নৈবেদ্য দেয়া হতো তার মধ্যে পাতা দিয়ে তৈরি শুকনো কেক দেখা যেতো। এইসব পাতার মধ্যে থাকা ক্যাফেইন এবং থিয়ানিন প্রমাণ করে যে, সেগুলো প্রকৃতপক্ষে ছিল চা পাতা যা কিনা মৃতদের সাথে দিয়ে দেয়া হতো তাদের পারলৌকিক জীবনের অনুষঙ্গ হিসেবে। দুশো বছর আগে এভাবে চায়ের ব্যবহার হওয়ার সময়কালের কথা জানা যায়।
২. সব চা আসে এক প্রজাতির উদ্ভিদ থেকেঃ যত ধরনের চা আছে সবই তৈরি হয় ক্যামেলিয়া সিনেসিস থেকে। এই চির-হরিৎ গুল্ম বা ছোট গাছ থেকে পাতা এবং পাতার কুঁড়ি সংগ্রহ করে তা চা উৎপাদনে ব্যবহার করা হয়। বিভিন্ন ধরনের চায়ের মধ্যকার পার্থক্যগুলো উদ্ভিদের চাষের ধরণ, পরিস্থিতি এবং উৎপাদন প্রক্রিয়াতে ভিন্নতা রয়েছে।
৩. ধর্মীয় অভিজ্ঞতাঃ জাপানে, চা আসে চীন থেকে ফিরে আসা জাপানি ধর্মগুরু এবং দূতদের হাত ধরে। সেটা ষষ্ঠ শতকের দিকে এবং দ্রুত তা ধর্মীয় শ্রেণীর মানুষদের পছন্দের পানীয় হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠে। আর গরম পানির সংস্পর্শে এসে হালকা সবুজ রং ধারণকারী গ্রিন টি, কয়েক শতাব্দী ধরে সংস্কৃতিবান এবং উচ্চবিত্ত সমাজের মানুষদের কাছে প্রাধান্য পেয়ে আসছে। পনেরো শতকে চায়ের সংস্কৃতির সাথে বৌদ্ধ ধর্ম-ভিক্ষুরা পরিচিত হয় চীন থেকে। কিন্তু জাপানিরা একে তাদের নিজস্ব রীতি-প্রথায় রূপ দেয়, যা একটি প্রায়-ধর্মীয় সামাজিক প্রথায় পরিণত হয়। জাপানের টি সেরেমনি বিশ্বজুড়ে সুপরিচিত
৪. রাশান ক্যারাভান চাঃ রুশদের কাছে বেশিরভাগ চা পৌঁছাতো চীন থেকে রাশিয়ার পথে ক্যারাভান রুটে। উটের কাফেলা মাসের পর মাস ধরে ভ্রমণ করে মহাদেশ জুড়ে চা বহন করে চলতো। তাদের রাতের ক্যাম্প-ফায়ারের ধোঁয়া চায়ের ওপর পড়তো এবং যতক্ষণে তারা মস্কো কিংবা সেন্ট পিটার্সবার্গ পৌঁছাতো পাতাগুলোতে ধোঁয়াটে স্বাদ তৈরি হতো আর সেখান থেকে তৈরি হওয়া সেই চায়ের স্বাদ যা আজকের দিনে রাশান ক্যারাভান চা হিসেবে পরিচিত।
বাংলাদেশে একটি চা বোর্ড আছে বাণিজ্য মন্ত্রনালয়ের অধীন। ওয়েবসাইট ভিজিট করে ইত্যকার তথ্য পাওয়া গেল, এ এক বিশাল কর্মযজ্ঞ। যাই হউক, আমাদের আলোচনা, কবি এম নাজমুল হাসান এর “এক কাপ চা” কবিতা নিয়ে।
কবিতাটি তাৎক্ষনিক ভাবে লেখা (মাথায় আসা), একটি চায়ের আড্ডাকে ঘিরে। কবি কবীর হুমায়ূন একদিন নারায়নগঞ্জ ভিজিটে গিয়েছিলেন এবং কবি নাজমুল হাসান এর সাথে নারায়নগঞ্জ এর আড্ডাস্থল নামে পরিচিত “চাষাড়া”তে তারা দুজনে “তেতুল চা” খেয়েছিলেন, সেটাই কবিতার প্রেক্ষাপট। কবিতায় সব সময় ভাব-গম্ভীরতা বজায় রাখতে হবে কিংবা ভারী কোন ইস্যু নিয়ে লিখতে হবে, এমন কোন কথা নেই। কোন এক অনুভূতিকে, কোন এক সময় বা ঘটনাকে কবি কিভাবে উপস্থাপন করেছেন, অন্যের কাছে/পাঠকের নিজের অনুভূতি পৌঁছে দিচ্ছেন কিংবা কোন ঘটনাকে জীবন্ত করে তুলছেন, সেটাই আমার কাছে মূখ্য। সব সময়, কবিতার ভাবালুতা থাকতেই হবে, এমন কোন বাধ্যবাধকতাও নেই। (উল্লেখ্য আমার নিজের দেশের বাড়িও নারায়নগঞ্জ, উল্লেখিত চাষাড়াতে আমার স্কুল জীবনের আড্ডার অনেক স্মৃতি আছে)
কবিতাটি মজা করে লিখেছেন, তেতুল চা, মাল্টা চা এবং পুদিনা পাতার চায়ের সাথে আড্ডার একটা সম্পর্ক স্থাপন করছেন। চা ছাড়া আড্ডার কোন অস্তিত্বই থাকে না। একে অপরের পরিপূরক!! চা ছাড়া আড্ডা জমে না আবার আড্ডা না জমলে চায়ের বিক্রি থাকে না। আমাদের সংস্কৃতির একটি প্রিয় অনুষঙ্গ হিসেবে চা এবং আড্ডা স্থান করে নিয়েছে। চা এর রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক বিশ্লেষন যেমন আছে, তেমনি সংস্কৃতিক বিশ্লেষনও আছে।
কবি’র জন্য রইলো অফুরান শুভেচ্ছা