আলোচনা ৩১

চারদিকে যখন নারী আন্দোলনের ঝর বইছে, নারী মুক্তির জন্য সবাই একাত্ম ঘোষণা করছে, দেশে দেশে শুরু হয়েছে নানা আয়োজন, নানা কার্যক্রম। নারীর অর্থনৈতিক মুক্তি চাই, সামাজিক ও সাংস্কৃতিকভাবে নারী স্বাধীনতা চাই ইত্যাদি শ্লোগানে শ্লোগানে মুখরিত হচ্ছে চারদিক, নারী মুক্তির সূচক যখন কোন দেশের উন্নয়নের প্রধানতম সুচকে পরিনত হচ্ছে, ঠিক তখন কবি এম এ সালাম একটি ভিন্ন দৃষ্টিতে নারী মুক্তির বিষয়টিকে দেখার আহ্বান জানিয়েছেন তার “ নষ্টা নারীর নীড়ে” কবিতায়। তিনি বাস্তবতার এক কঠিন রূপ উপস্থাপন করেছেন এই কবিতায়।

নারী মুক্তির একটি অন্যতম উপায় হল, নারীর পুনরুৎপাদন কাজ অপেক্ষা উৎপাদনমূলক কাজে অংশগ্রহণ বাড়ানো, পুরুষের পাশাপাশি নারীরও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সিদ্ধান্তগ্রহন প্রক্রিয়ার অংশগ্রহন বাড়ানো, আয়মূলক কাজে নারীর সম্পৃক্ততা বাড়ানো এবং সর্বোপরি প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে এবং উৎপাদনমূলক কাজে নারীর কন্ট্রোল এবং এক্সেস তারই নিয়ন্ত্রনে রাখা। মোটামুটিভাবে বিশ্বব্যাপী সকল দেশের রাষ্ট্রপ্রধান এবং সংস্থা প্রধানগণ একমত হয়ে আন্তর্জাতিকভাবে নারীমুক্তির সনদ (সিডও) এ স্বাক্ষর করেছেন এবং সে অনুযায়ী সামগ্রিক কার্যক্রম ঢেলে সাজিয়েছেন। গত প্রায় এক শতাব্দীরও বেশী সময় ধরে এক ধারাবাহিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নারী মুক্তির আন্দোলন এগিয়ে চলছে।

নারী মুক্তির এ আন্দলনের আবহের মধ্যে এক শ্রেণীর পুরুষ ক্রমাগতই নারী আন্দোলনের অগ্রযাত্রাকে পেছনে টেনে নেবার কাজে ব্যস্ত সারাক্ষন। সামাজিকভাবে, সাংস্কৃতিকভাবে নারীকে হেয় করার জন্য নানা আয়োজনে ব্যস্ত থাকেন, “নারী মুক্তির কঠিন ঝাণ্ডা নিয়ে, চলছে অবলীলায় নোংরা খেলা” । উৎপাদন কাজে নারীর অংশগ্রহন যেমন আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে তেমনি নুতন প্রজন্মের নারীদের আগ্রহও বেড়েছে, তারা প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করছে, লেখাপড়া শিখে চাকরির বাজারে প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহন করছে আর এই সুযোগটাই গ্রহণ করছে কিছু নরপশু, নানাভাবে নারীকে আক্রমন করছে, হেয় করছে, আবার পেছনে ফিরে যাবার তাগিদও দিচ্ছে বার বার, তাই কবি লিখেছেন- “লেখাপড়া কিম্ভা চাকরির জন্য, ঘরের বাহিরে যাচ্ছে নারী,ওত পাতিয়া নরপশুরা কিন্তু, সভ্রম ও ইজ্জত নিচ্ছে কাড়ি । আত্মীয় স্বজন সবাই নিশ্চুপ, নেতার চক্কর দেখে, বিচারকেরা সবাই ছদ্দবেশী, মূলা ঝুলিয়ে রেখে”

নারী মুক্তির এ আন্দোলনকে সবাই মানুসিকভাবে মেনে নেয়নি,  কেউ বা চক্ষুলজ্জার ভয়ে শামিল হচ্ছে কেউ বা আবার নারী মুক্তির আন্দোলনে নিজের অংশগ্রহণকে পুজি হিসেবে ব্যবহার করে আখের গোছানোর কাজে ব্যস্ত ফলে ঘরের বাইরে কিংবা ভেতরে যখন নারীর অবমূল্যায়ন হচ্ছে, নারী কোন অন্যায়ের বিচারপ্রার্থী হচ্ছে তখন রাজনৈতিক নেতা, সামাজিক কিংবা ধর্মীয় নেতা এমনকি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান গুলোও সময়মত সঠিক আচরণ করছে না, নারীর প্রতি কোন প্রকার সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিচ্ছেন না, নানা অজুহাতে মুখ ঘুরিয়ে রাখছেন, সে বিষয়গুলোকেই কবি নানাভাবে বলার চেষ্টা করেছেন- “আমার মা বোনেরা ধর্ষিতা যখন, তখন নেতা কানে দিচ্ছে তুলা, মান ইজ্জত সব নিক্ষেপ কর, ওই জ্বলন্ত চুলায়। মহা উদ্দ্যামে চলছে আজি, নষ্টা বাড়ীতে সব মরদামী, একই পিয়ালায় পিতা-পুত্র খায় পিপাসার পানি”


পুরুষতান্ত্রিক বিশ্ব ব্যবস্থাপনায় নারী  নানাভাবেই বাধ্য হয় পতিতা বৃত্তি কাজে অংশগ্রহণ করতে তাই তৈরি হয় পতিতালয়। আবার পুরুষই নানাভাবে ফুসলিয়ে, জোর করে কিংবা  পন্যের বাজারের মত নারীকে বিক্রি করে পতিতালয়ে, নারী হয়ে উঠে শরীর বিক্রির পন্য। রাতের আধারে সেখানে পুরুষের গমন, শরীরের তৃষ্ণা নিবারণ,  নারীর  শরীরের উপর চলে পুরুষের আগ্রাসন।  আবার দিনের আলোয় সেই নারীর প্রতিই ছুড়ে দেয়া হয় আপমানের তীর ‘নষ্টা নারী’, এসবই পুরুষতান্ত্রিক কৌশল, নারীকে অবদমনের ইচ্ছের বহিঃপ্রকাশ । কবি বলেন-“ নষ্টার নীরে কাস্টমার সেজে, যখন তুমি যাও, মনের তৃপ্তি মিটিয়ে দিয়ে খাতায় নাম লিখাও। নষ্টার মাঝে আর তোমার মাঝে-বল পার্থাক্যে কোথায়? রিপুর তাড়ণায় বিলিয়ে দিয়েছ, দেখিয়েছো নকল চেহারায়। বুঝতে কেহর বাকী নেইরে-তুমি যে নষ্টা পুরুষ, রিপুর তাড়নায় বিকিয়ে দিয়েছো আসল মানের হুশ”

কবিতাটি আসলে নারী মুক্তির আন্দোলন এবং সমসাময়িক প্রেক্ষাপটে পুরুষের ভুমিকা তার সাথে পুরুষতান্ত্রিক ঘরানার আবরন নিয়ে অসাধারন এক কাব্য রচিত হয়েছে। কবিতাটি খুব মনোযোগ দিয়ে পড়ুয়া পাঠকের  মনোযোগ দাবী রাখে। কবির জন্য শুভেচ্ছা রইলো ।