আলোচনা ১২
একবার অফিসের কাজে ইউ কে’তে, বিকেলে রেস্টুরেন্টে বসে খেতে খেতে অফিস কলিগ জিজ্ঞেস করেছিল- ছুটির দিনে কিংবা সাপ্তাহিক ছুটিতে তোমরা কি কর? উত্তরে বলেছিলাম- তোমাদের দেশে, তোমরা বছরে ৩৬৫দিন উদযাপন করো কিন্তু আমাদের দেশে বেশীর ভাগ মানুষ একটাই দিন বছরে ৩৬৫ বার উদযাপন করে। উত্তরটা বুঝতে না পেরে অনেকক্ষণ হা করে তাকিয়েছিল। সবার জীবনে বৈচিত্র্য থাকে না। বেকার কিংবা অসফল মানুষগুলো ঠিক তেমনি একটাই দিন বার বার উদযাপন করে। কবি অতনু তার কাব্য ‘নিত্য দিনযাপন’ এ এমনই এক কষ্টকর সময়ের কথা, বীভৎস এক সময়ের কথা উচ্চারন করিয়েছেন ২৮ বছরের এক যুবকের মুখে।
কবিতাটি পড়তে পড়তে ফিরে গিয়েছিলাম ২১ বছর আগে নিজের জীবনে। ভাবছিলাম, একই ঘটনা, একই কষ্ট, একই অনুভূতি কি করে ২১ বছর পর আবার ফিরে এলো অন্য কোন যুবকের জীবনে। ভাবনায় খেলছিল, কিছু কষ্ট, কিছু যন্ত্রণা কি সার্বজনীন ? সব দেশে, সব সমাজে, সব মানুষের জন্য কি একই রকম? কি সেটা? বেকার কিংবা অসফলতার কষ্ট কিন্তু তারচেয়েও বড় কষ্ট আশে পাশের মানুষগুলোর আচরণ, মানুষের বাকা চোখ, মানুষের অঙ্গুলি তুলে দেখানো …… তুই ব্যর্থ, তুই অসফল, তুই অকর্মণ্য, তুই বেকার, তুই অ-কাজের, তোকে দিয়ে কিচ্ছু হবে না , তোকে দিয়ে হাল চাষও হবে না…………
মানুষটা তখন বেঁচে থেকেও মরে যায়, জীবন্ত লাশ হয়ে ঘুরে বেড়ায়। নিজের প্রতি আস্থা, নিজের উপর বিশ্বাস , নিজের আত্মবিশ্বাস সব, সব হারিয়ে অর্থহীন মনে করে নিজের জীবনকে। সফলতা কিংবা ব্যার্থতার কোন সার্বজনীন মানদণ্ড নেই কিন্তু সমাজ আরোপিত মানদণ্ড মানুষকে ঠোকরে ঠোকরে খায়। ‘মাটিতে গা ঘষ্টে ঘষ্টে আঠাশে পা দিল’, বলেই কি ব্যর্থ? কে ঠিক করেছে ২৮ বছেরের মানদণ্ড ? যুবকের মনে এই ভাবনাই বা এলো কি করে? সমাজ, পরিবার, আত্মীয় স্বজন, দেশ, সংস্কৃতি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান-- এত এত প্রতিষ্ঠান,এদের কাজ কি?? শুধু জীবন্ত লাশ তৈরি করা??
কোথাও শান্তি নেই, কোন কাজেই মন নেই (ঘুমের মধ্যেই জেগে উঠা, পায়চারি করা, অকারনে বাস্তায় ঘোরাফেরা), এমনকি মানুষের স্পর্শও ভাল লাগে না, অস্থির মন (হঠাৎ করে বেড়িয়ে পড়া, বাসে উঠা আবার পরিকল্পনা ছাড়াই নেমে পরা), একধরনের অস্থিরতা, উদাসীনতা মনে কাজ করে সব সময়। এরকম সময়, ‘বেকারের, কোন কাজ নেই” তাই তাকে দিয়েই সবাই ‘জুতা সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ’ করাতে চায়, উপায় না পায়ে যুবক মাথা কুঁজো করে সব মেনে নেয়, সব কাজ করে বলা যায়, করতে বাধ্য হয় (বাজার করা, যখন তখন পাড়ার দোকান যাওয়া)
বাবা-মা’র মুখের দিকেও তাকাতে পারে না, লজ্জা হীনমন্যতা তাকে ঘিরে ধরে। অন্ধকারে লুকাতে চায়, নিজের শরীরের সাথে মিশে যেতে চায়, নিজের সাথেই নিজে কথা বলে, খোশমেজাজে মৃত্যু নিয়ে অশরীরীদের সঙ্গে গল্প করে। ভাল কোন সুখবর কিংবা নিজের জন্মদিনের মত ভাল দিনগুলোকেও উদযাপন করতে পারে না, ভয়ে, অপমানে, লজ্জায়।
এত আপমানিত জীবনেও কেবল একটি শক্তিই তাকে বাঁচিয়ে রাখে, যদিও তাতে উত্তাপ নেই কিন্তু তারপরও ‘ভালবাসার শক্তি’ তাকে উজ্জীবিত রাখে আর একটি স্বপ্ন “বাবা একদিন পাহাড়ে যেতে চেয়েছিল” তাকে নুতন করে বাঁচতে শেখায়।
অনেক শুভেচ্ছা রইলো কবি, ভাল থাকবেন সব সময়।