আলোচনা ১৮৩
নিঃসঙ্গতা, একাকীত্ব, বিচ্ছিন্নতাবোধ… ইত্যাদি শব্দগুলো কাছাকাছি কিন্তু ভিন্ন ভিন্ন অর্থ, ভিন্ন ভিন্ন প্রেক্ষাপটকে ধারন করে। সাধারনত যে কোন লেখায় শব্দগুলো প্রায় একই অর্থে ব্যবহৃত হয়ে থাকে কিন্ত কাব্য রচনার ক্ষেত্রে বেশ সচেতনভাবেই শব্দের ব্যবহার দেখা যায়।
অনেকের মাঝে থেকেও একাকীত্ত আসতে পারে, প্রিয় সঙ্গীর সাথে থেকেও নিঃসঙ্গতা বোধ হতে পারে আবার কোনকিছুর সাথে বিচ্ছিন্ন না থেকেও বিচ্ছিন্নতাবোধে আক্রান্ত হতে পারে মানুষের মন।
“আমার ঘরে শুধু আমি নই, অন্য কেউ বসবাস করে”, কবিতার শুরুটা এভাবেই করেছেন কবি “মানব রহমান” তার কাব্য “নিঃসঙ্গতার সমাবেশ” কাব্যে। অসাধারন!!
বিখ্যাত কয়েকটি গান আছে, যা জীবনের এক গভীর এক দর্শনকে ধারন করে যেমন-
“বাড়ীর পাশে আর্শীনগর, আমি এক দিনও না দেখিলাম তারে, সে আর লালন এক ঘরেতে তবু লক্ষ্য যোজন দূরে...”
“আমার ঘরে বসত করে ক’জনা”
আলোচ্য কবিতাটিও অনেকটা সেই ঘরানার। মানুষের মন বড় বিচিত্র, এর কূল পাওয়া দুস্কর !! আপাদত দৃষ্টিতে আমরা ব্যাখা করে থাকি, কোন কিছু না পেলে, কোন অভাব বোধ থেকে, সঙ্গীর অবহেলা থেকে, বিরহ থেকে কিংবা এ জাতীয় নানা কারনে মানুষের মন নিঃসঙ্গতা অনুভব করতে পারে। কিন্তু এই কবিতায় অনুভবের এক ভিন্ন দর্শন যা জাগতিক বিষয় কিংবা পাওয়া, না-পাওয়া দিয়ে ব্যাখা করা যায় না। জীবন সম্পর্কে গভীর দৃষ্টিভঙ্গি দিয়েই তার জবাব মেলে হয়তো।
আলোচ্য কবিতায় কবি নিঃসঙ্গতার সাথে আরো একটি শব্দ, “সমাবেশ” যোগ করেছেন। তবে কি নিঃসঙ্গতা পরিমানগত কোন বিষয়? অনেকগুলো নিঃসঙ্গতা একসাথে থাকার কারনে তার সমাবেশ হয়েছে নাকি, নিঃসঙ্গতার গভীরতা বোঝাতে সমাবেশ বুঝিয়েছেন?
আমার ঘরে আমি একা নই, অন্য কেউ বসবাস করে, আরো অনেকেই বাস করে-ফলে নিঃসঙ্গতার রূপভেদ আছে, একই আমি ভিন্ন ভিন্ন কারনে, ভিন্ন ভিন্ন ভাবে নিঃসঙ্গতা অনুভব করি।
আমার নিঃসঙ্গতার মধ্যে অতীতের ভীড় আছে-হৃদয় স্পর্শ করা একটি লাইন। অতীতের অনেক ঘটনা, অনেক মানুষ কিংবা একজন মানুষের অনেক স্মৃতি, অতীতের নানা প্রেক্ষাপট, নানামুখী ঘাত প্রতিঘাত... নিঃসঙ্গতাকে বাড়িয়ে তুলেছে যদিও এক ঘরে এখন সবই আছে, বস্তুগত বিষয়ের প্রাচুর্য্য আছে, অনেক মানুষ আছে কিন্তু তারপরও নিঃসঙ্গতার অনুভব আছে, ফিরে যাওয়া অতীত মুখের স্মৃতি আছে।
কবিতা জুড়েই যেমন কাব্যভাব আছে তেমনি ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে দর্শন, ফলে কবিতাটিকে দর্শনকাব্যও বলা যায়-
কথক হয়ে গল্প আসে
চারপেশের দেয়ালিকা জুড়ে
কপাট বদ্ধ ঘড়ে আর্তনাদ করে আসে
সব ক্ষত বিক্ষত শরীর
এক রাশ অন্ধকার হাতে
প্রেমিকার মোহ, কান্নার মিছিল, মীরযাফর এর বিশ্বাসঘাতকতা, ঘাত-প্রতিঘাতের বিষাক্ত মন, অনাকাঙ্খিত সমাবেশ, কপাট বদ্ধ আর্তনাদ, ক্ষত বিক্ষত শরীর, অন্ধাকার হাত, গল্পের কথকতা... সবই আছে এক ঘরে, এসবই নিঃসঙ্গতার উপকরন, নিঃসঙ্গতার সমাবেশ এখানেই গেঁথে আছে।
অনেক দিন পর একটা ভীষন ভালো লাগার কবিতা। আলোচনায় খুব বেশী পারদর্শীতা না থাকায় কবিতার আসল রূপ হয়তো ফুটিয়ে তুলতে পারলাম না। কিন্তু এটুকু বলতে পারি, আমার ভীষন ভালো লেগেছে কবিতাটি, দীর্ঘদিন মনকে আলোরিত করবে।
কবি’র জন্য রইলো অফুরান শুভেচ্ছা।