আলোচনা  ২৩৬

কিছুটা ধর্মীয় ভাবধারায় লেখা কবিতা, “নিয়তির বেড়া”, কবি শরীফ এমদাদ হোসেন লিখেছেন। বিজ্ঞান ভিত্তিক জীবন দর্শন যাদের, তারা “নিয়তি” বলে কিছু বিশ্বাস করে না, তাদের মতে, নিয়তি বা ভাগ্য” বলে কিছু নেই, মানুষ তার কর্মের মাধ্যমে তার সফলতা অর্জন করে, কেউ কেউ আরো একধাপ এগিয়ে বলে, “মানুষ তার স্বপ্নের চেয়েও  বড়”।

নিয়তি, ভাগ্য, কপাল ইত্যাদি শব্দগুলো এক অদৃশ্য শক্তির দিক ইঙ্গিত করে, অর্থাৎ আমরা আমাদের নিজের ভাগ্য বা নিয়তির নিয়ন্ত্রক নই, আমরা কাজ করতে পারি, প্রত্যাশ করতে পারি, কিন্তু দিনশেষে ফলাফল নিয়ন্ত্রন করতে পারি না অর্থাৎ আমরা নিজেদের ভাগ্য বা নিয়তি নিজেরা নির্ধারন করতে পারি না, তার জন্য আমাদের পরাশক্তি/ অদৃশ্য শক্তির কাছে আত্মসমর্পন করতেই হবে।

অন্যদিকে, বিশ্বাসীদের অর্থাৎ অদৃশ্য শক্তিতে বিশ্বাসী মানুষের মধ্যেও, দুটো এক্ট্রিম অবস্থান নিতে দেখা যায়, একদল মনে করে, আমরা যা কিছুই করি না কেন, কিছুতেই কিছু হবে না, যদি না তা ভাগ্যে লিখা থাকে, আমাদের ভাগ্য আগেই লিখা হয়ে গেছে, সুতরাং এখন আর আমাদের কিছুই করার নেই। আমাদের জীবনে ভালো কিছু হলে সেটা অদৃশ্য শক্তির কৃপা আর খারাপ কিছু হলে, সেটাও আমাদের ভাগ্য। অন্যদল, সবকিছুতেই নিজেকেই দায়ী করে এবং ভাগ্য বলে চালিয়ে দিতে চায়, কোন কাজ না করে, অসল থেকে, জীবনের বিপর্যকে “ভাগ্য বা নিয়তি” বলে চালিয়ে দেয়।

কবি এমদাদ, নিয়তির বাইরেও, প্রকৃতির দিকে তাকাতে নির্দেশ করেছেন, প্রকৃতির মধ্যেই মানব জীবনের অনেক শিক্ষা, প্রায় সব শিক্ষাই লুকিয়ে আছে যদি আমরা তা আবিস্কার করতে পারি। কয়েকটি উদাহরন দিয়েছেন, প্রকৃতির মধ্যে মানবজীবনের পরম শিক্ষা-

আকাশের দিকে তাকালে আমরা “উদারতা’র চমৎকার দৃষ্টান্ত দেখতে পাই, বিশাল আকাশের উদারতা ক্ষুদ্র মানবজীবনের উপর কিভাবে প্রবাহিত হয়, তা আমাদের প্রতিদিনের, প্রতি সেকেন্ডে জীবন যাপন প্রক্রিয়ার মধ্যে লুকানো আছে কিন্তু আমরা পর্যবেক্ষন করি না, অনুধাবন করি না, বুঝতেই চাই না, গায়ের জোরে সব নিজের মত করে ভাবতে চাই, নিজের জ্ঞান গরিমার মাধ্যমে সব আবিস্কার করতে চাই, পেতে চাই, কিন্তু মানবজীবনের অস্তিত্বের জন্যই, “উদারতা”র অভ্যাস গড়ে তোলা দরকার। আবার যদি হিমালয়ের দিকে তাকাই, সেখানেও মানব জীবনের অসাধারন সব শিক্ষা আছে। হিমালয় তার নিজের উচ্চতা নিয়েও পৃথিবীর কল্যানে নিজেকে ব্যস্ত রাখেন, নিজের উচ্চতা এবং শক্তির দম্ভে পৃথিবীকে নিমিষে ধ্বংস করে দেয়ার ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও, নিজেকে বিরত রাখেন। হিমালয়ের কাছে আমাদের শেখার আছে, নিজেদের দম্ভ, অহংকার, কিভাবে নিয়ন্ত্রনে রাখতে হয়। প্রকৃতির মাঝে, মানুষের জন্য কল্যানকর শিক্ষা লুকিয়ে আছে, শুধু আবিস্কার করে নিয়ে হবে। বিজ্ঞানের শক্তিমত্তায়, নিজের জ্ঞান বুদ্ধির অহংকারে সব কিছু দখলে নেয়ার বদলে, মানবকল্যানের নিজেকে নিয়োজিত করা উত্তম এবং সে শিক্ষা প্রকৃতির মধ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। সে কারনেই কবি লিখেছেন-

তুমি যদি আকাশ হতে কোন একদিন
উদারতা কাকে বলে সত্যিই বুঝে নিতে ঠিক ঠিক
যদি তুমি হিমালয় ফুল হয়ে ফুটতে কাননে কারোর
নিশ্চয়ই দরদী খুঁজে পেতে তাৎক্ষণিক।

শেষ স্তবকে কবি আবার স্মরণ করিয়ে দেন, মানব জীবনে চক্রাকারে আসে সুখ এবং দুঃখ, আনন্দ এবং বেদনা, কস্ট এবং স্বস্তি। বিপরীতমুখী এই ঘটনাগুলো প্রত্যেক মানব জীবনের জন্য প্রযোজ্য এবং অবশ্যম্ভাবী, সেটাকেই কবি বলেছেন, “নিয়তির বেড়া”, রূপক অর্থে বেড়া, তার মানে এই নয় যে, মানুষ নিয়তির হাতে বন্দী, মানুষের বন্দিত্বকে ইঙ্গিত না করেও, নিয়তিকে মেনে নিয়ে, কর্ম করে যাওয়া এবং কর্মফলের প্রত্যাশা রাখাকে বুঝিয়েছেন।

নিয়তি, ভাগ্য, কপাল…শব্দগুলো খুব সহজ সরল নয় আবার খুব বেশি জটিলও নয়, একেকজন একেকভাবে ব্যাখা করে বিধায় শব্দগুলো জটিল আকার ধারন করে, তবে দিন শেষে, পুরোটাই অনুভবের বিষয়।

কবি’র জন্য রইলো অফুরন্ত শুভেচ্ছা।