আলোচনা ১৫৬
কিছু শব্দ আমরা প্রতিনিয়তই ব্যবহার করি কিন্তু খুব ভালো করে ব্যখা করতে পারি না, নিজেরা বুঝি কিন্তু অন্যকে বোঝাতে পারি না যেমন- বিশ্বাস, মূল্যবোধ, সংস্কার, কু-সংস্কার, দহন ইত্যাদি। আজকের আলোচ্য কবিতা তেমনটি একটি বহুল প্রচলিত কিন্তু বেশ কঠিন একটি কনসেপ্ট নিয়ে লেখা, “মূল্যবোধ”, কবি, মোঃ শাহজাহান আলী।
যে বোধের দ্বারা কোন বস্তুর অবস্তুগত মূল্য নির্ধারন করা হয় তাহাই মূল্যবোধ। সবার বোঝার জন্য একটি উদাহরন দেয়া যাক-
একটি লাল কলম এবং একটি কালো কলম। দুটো রং ই কলম দুটোর গুন (adjective), যা কলমের মধ্যেই নিহিত আছে। পৃথিবীর সবাই লাল কলমকে লাল এবং কালো কলমকে কালোই বলবে। কোন পার্থক্য হবে না। কলমের রঙের কারনে কলমের দামেরও কোন পার্থক্য হবে না। দামের পার্থক্য হবে, কলমের ভালো কোম্পানী/ব্রান্ড কিংবা কলমের ভেতর কালির কারনে।
কিন্তু যদি বলা হয়, কলম দুটি ভা্লো নাকি খারাপ? কোনটি ভালো কিংবা কোনটি খারাপ? যখনই ভালো/মন্দের প্রশ্ন আসলো, তখনই একেক জন একেকটাকে ভালো কিংবা মন্দ বলবে, পৃথিবীর সবাই একই রকম বলবে না। ভালো কিংবা মন্দ, এ দুটিও কলমের গুন (adjective) কিন্তু এই গুনটি কলমের মধ্যে নিহিত নেই। এই গুনটি আমরা যারা কলমটি ভালো কিংবা মন্দ বিচার করছি তাদের মগজের মধ্যে। আমার হয়তো, চিকন লেখা পছন্দ ফলে যে কলমটি দিয়ে চিকন লেখা হবে, সেটা আমার কাছে ভালো অন্যটি মন্দ,অন্যজন হয়তো মোটা লেখা পছন্দ করেন, ফলে তার কাছে অন্য কলমটি ভালো। ফলে ভালো-মন্দ, সৎ-অসৎ, ন্যায়-অন্যায় ইত্যাদি বিষয়গুলো বস্তুর মধ্যকার নিহিত কোন গুন দ্বারা বিচার করা হয় না, বিচারটা হয় সম্পুর্নভাবেই যিনি বিচার করছেন তার ইচ্ছে –অনিচ্ছে, তার পছন্দ-অপছন্দ অনুযায়ী। ফলে, যিনি চিকন লেখা পছন্দ করবেন তার কাছে সেই কলমটি দাম বেশী অন্যটির দাম কম। তাহলে, দামের পার্থক্য হয় মুলত বস্তুর অবস্তুগত গুনের কারনে। বস্তুর অবস্তুগুন থাকে বস্তুর বাইরে।
কলম দুটির উদাহরন থেকে বোঝা যায়, লাল এবং কালো বস্তুর বস্তুগত মূল্য, যেটা বস্তুর মধ্যেই নিহিত আছে কিন্তু সেটা দ্বারা তার মূল্য নির্ধারন হয় না, কিন্ত ভাল কিংবা মন্দ, কলম দুটির অবস্তুগত গুন যেটা বস্তুর মধ্যে নিহিত নেই, নিহিত আছে বাইরে অন্য কারো কাছে, যেটা বস্তুর মূল্য নির্ধারন করে। ফলে, কোন কিছুর মুল্য নির্ধারন হয় মূলত, ব্যক্তির এবং সমাজের ইচ্ছে-অনিচ্ছা, নীতি-অভ্যাস, চর্চা- সংস্কৃতি, বিশ্বাস-অবিশ্বাস ইত্যাদি দ্বারা। তাহলে উপসংহার টানা যায়- যে বোধ (ইচ্ছে-অনিচ্ছা, নীতি-অভ্যাস, চর্চা- সংস্কৃতি, বিশ্বাস-অবিশ্বাস) আমার মধ্যে আছে, সমাজ যেটা আমার মধ্যে তৈরি করে দিয়েছে, সেটা আমি লালন করি এবং সেভাবেই কোন কিছুর মূল্য দিয়ে থাকি।
অনেক দেশেই দেখা যায়, কালো মেয়ের বিয়ে হবে না, বাবা মায়ের দুশ্চিন্তা, যৌতুক দিতে হবে ইত্যাদি। কিন্তু একজন কবি লিখেন- “কালো মেয়ের তার কালো হরিণ চোখ”, কবির কাছে কালো মেয়ের মূল্য বেশী, কালো মেয়েই তার বেশী পছন্দ। আফ্রিকার কালো মেয়ের কি প্রেম হয় না? ওখানে কি কেউ কালো মেয়ের প্রেমে পাগল হয় না? আমার মধ্যে সমাজ, যে “সুন্দরের” ছবি একে দিয়েছে, আমি সেটা দ্বারাই চালিত এবং নিয়ন্ত্রিত। ফলে, আমি/আমার সমাজ মনে করে, সুন্দর মানেই ফর্সা, গায়ের রঙ কালো মানেই আর সুন্দর হলো না। তাই মুল্যবোধ, যে বোধের দ্বারা কোন বস্তুর অবস্তুগত মূল্য নির্ধারন করা হয় সেটাই মূল্যবোধ, ফলে মূল্যবোধ, দেশে দেশে ভিন্ন হবে কিংবা একই মূল্যবোধের বিবর্তন হবে, পরিবর্তন হবে, সেটাই স্বাভাবিক। মূল্যবোধের অবক্ষয় বলে যে শব্দ আছে, সেটা মূলত চর্চিত অভ্যাস আকড়ে রাখার প্রচেষ্টা।
এতোক্ষন “মূল্যবোধ” কনসেপ্ট নিয়েই আলোচনা করলাম, এবার দেখা যাক, কবি তার কবিতায় কি বলতে চেয়েছেন-
আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে যে ধরনের “মূল্যবোধ” দীর্ঘকাল ধরে চর্চা হয়ে আসছিল, কালের ধারায় তার মধ্যে মধ্যে কিছু পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে, কিছু মূল্যবোধ ব্যাপক মাত্রায় পরিবর্তিত হচ্ছে, কিছু আবার সীমা অতিক্রম করে যাচ্ছে। কবিতায় তাই কিছু আক্ষেপের সুর ভেসে উঠেছে।
ছেলে তার বাবাকে গালি দিচ্ছে “শালা” বলে, প্রবীন মানুষেরা এখন সমাজ তথা পরিবারের কাছে জঞ্জাল, আগে শিক্ষকদের যেভাবে ভক্তি ও শ্রদ্ধা করা হতো এখন তা কমে গেছে, মুফতি মুহাদ্দিসদের এখন আর আগের মতো করে কুর্নিশ করা হয় না ইত্যাদি ইত্যাদি।
প্রশ্ন থেকে যায়, নৈতিকতা এবং মূল্যবোধ কি একই অর্থ বহন করে? মূল্যবোধের পরিবর্তন মানেই কি নৈতিকতার স্খলন? কবি, পরিস্কার করে কিছু বলেননি, বরং মুল্যবোধ এবং নৈতিকতাকে একই দাগে মেপেছেন। মূল্যবোধ এবং নৈতিকতা চর্চা হচ্ছে কি না তার মাপুনি (সূচক) কি একই হবে? মূল্যবোধের পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী কিন্তু নৈতিকতার পরিবর্তনও কি একই সাথে হাত ধরাধরি করে চলবে? নৈতিকতা কি আপেক্ষিক কোন শব্দ? যেমনটা পূর্বে আলোচনা করেছি, মূল্যবোধ সংস্কৃতি নির্ভর একটি চর্চা?
মোটা দাগে, কবিতাটিকে একপাক্ষিক ভাবনা দ্বারাই চালিত বলে মনে হয়েছে। তার চেয়েও বেশী মনে হয়েছে, মুল্যবোধের পরিবর্তন বা অবক্ষয় নিয়ে কবি অনেক বেশি চিন্তিত। বৈশ্বিক পরিবর্তনের হাওয়ায়, নিজেদের বংশ পরম্পরায় চর্চিত মূল্যবোধগুলো কতটুকু ধরে রাখা যাবে, সেটা মিলিয়ন ডলারের প্রশ্ন।
কবির জন্য রইলো শুভেচ্ছা