আলোচনা ১০১
মরণোত্তর পদক দেয়া, খেতার দেয়া কিংবা মৃত্যু পরবর্তী তার নামে রাস্তার, ভবনের নামকরণ করা… এসবই রাষ্ট্রীয় এবং সামাজিক রেওয়াজ। কোন কোন ক্ষেত্রে হয়তো প্রয়োজন আছে যেমন রাস্তার বা ভবনের নামকরণ করা, তাকে স্মরণীয় করে রাখার একটা প্রচেষ্টা, যদিও আজকাল নামকরন নিয়ে চলে রাজনীতির খেলা। কিন্তু মরণোত্তর পদক দেয়া ব্যাপারটা খুবই আজব। বেঁচে থাকাকালীন সময়ে যিনি তার কাজের স্বীকৃতি পেলেন না, তার কাজের যথার্থ মুল্যায়ন হল না, মৃত্যু পরবর্তী সেই খেতাব কিংবা পদক দিয়ে পরের প্রজন্মের কি উপকার হয় জানি না। সাধারনভাবে বুঝতে পারি, পুরো বিষয়টি এক ধরনের রাজনীতি এবং একজনের কর্মফলকে অন্যের ভোগের সামগ্রী তৈরি করা।
কবি মোঃ সায়িদুল আলম তার কাব্য ‘মমি করা কফিন’তে সে বিষয়টি নিয়েই চিন্তিত এবং বেশ জোড়ালসভাবেই বলতে চিয়েছেন, মানুষের কর্মফল নিয়ে বাণিজ্য করা বাদ দিয়ে বরং তিনি কাজের মধ্যে দিয়ে যে পরিবর্তনের ডাক দিয়েছিলেন, মানুষের মুক্তির জন্য যে পথ তৈরি করে দিয়েছিলেন সেটাকেই এগিয়ে নিয়ে যাওয়া, তার অভিজ্ঞতা প্রসূত বক্তব্য আপামর জনসাধারণের পৌঁছে দেয়াই উত্তম। কেবল মাত্র তাকে নিয়ে প্রতি বছর বছর ‘স্মরণীয় অনুষ্ঠান’ করার মধ্যে কারো জন্যই কোন উপকার নাই। কবির ভাষায়- “কি হবে আর দাঁড়িয়ে থেকে, মমি করা কফিনের পাশে। যে চলে যাবার সেত যাবেই, কেন বৃথা কাঁদ বসে শিয়রের কাছে। গাঁদা গাঁদা পুস্প অর্ঘ্য বনফুলের তোড়া, পরাও সবে মিলে নিস্প্রান সমাধি পরে। কোনোদিন কেউ কি ঢুকেছ গভীরে,অবিনাশি সৃষ্টির জীবন্ত আকাশে, যেখানে গোলাপ পাপড়ি আর ভ্রমর সুবাসে, চন্দ্র সূর্য খেলা করে সারা বেলা।
প্রতিটি মানুষ তার কৃত কর্মের মাঝেই বেঁচে থাকে, ভাল কাজের জন্য যেমন তিনি মানুষের মনে দীর্ঘদিন বেঁচে থাকে, নন্দিত থাকে আবার খারাপ কাজের জন্য মানুষের ঘৃণার মধ্যে নিন্দিত থাকে। কেউ কেউ আবার অসাধারণ কাজের জন্যে অমর হয়ে থাকে। যুগে যুগে এমন কিছু মানুষের জন্ম হয় যারা মানুষের মুক্তির সংগ্রামে নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছিলেন, মানুষের মুক্তির পথ তৈরির জন্য আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন, কবি তাদের কর্মের মধ্যে, তাদের চিন্তা প্রসূত যে বক্তব্য লপিবদ্ধ আছে বইতে, তার প্রতি মনোনিবেশ করতে উদ্বুদ্ধ করেছেন।
শেষে কবি তিরস্কার করেছেন, আমরা যারা জীবনভর উপভোগের জন্য, উপভোগের নিমিত্তে সব কাজ করি, ঐশ্বর্য ভরা পালঙ্কে ঘুমিয়ে কাটাই, ভুলে যাই সেইসব খ্যাতিমান মানুষের কথা যারা জীবন বাজী রেখে নিরাশ্রিত মানুষের কথা ভেবেছেন, মানুষের মুক্তির সংগ্রামে লিপ্ত ছিলেন। তাই শুধুমাত্র মানুষকে মৃত্যু পরবর্তী স্মরণ করাকে কবি ভণ্ডামি বলতে চেয়েছেন। এপথ ছেড়ে নুতন করে মানুষের তরে ভাবনার জন্য, শপথ নেয়ার জন্য কবি কলম ধরেছেন এবং কবিতার মাধ্যমে জাগরণের ডাক দিয়েছেন।
কবিতাটি সমসাময়িক বাস্তবতাকে চ্যালেঞ্জ করে নুতন এক বিদ্রোহের সুর তুলেছেন, ভিন্ন ধারায়, ভিন্ন ভঙ্গিতে। কবিতা সব ভেঙে চুড়ে চুরমার করে দেয় না কিন্তু খুব ধিরস্থিরতার সাথে ভেতরে পরিবর্তনের সূচনা করে, কবি সে চেষ্টাই করেছেন। কবির জন্য রইল সাধুবাদ এবং অভিনন্দন।