আলোচনা ২৪
ব্যঙ্গ করে বললেও, কবি গোপাল চন্দ্র সরকার অসাধারণ ভাবে মধ্যবিত্তের শ্রেণী চরিত্র বিশেষণ করেছেন তার “মধ্যবিত্ত পরিবার’ কাব্যে। প্রত্যেকটি শ্রেণীর একেকটি নির্দিষ্ট চরিত্র থাকে এবং শ্রেণী চরিত্র দ্বারাই ব্যক্তির আচার আচরণ প্রকাশ হয়ে থাকে অল্প কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া। মধ্যবিত্ত শ্রেণীর জীবনযাপন অনেকটা বৈপরীত্য প্রবাহের মধ্য দিয়ে কাটে, যেটাকে ক্রাঞ্চ মডেল দিয়ে ব্যাখা করা যায়। চার পাশের চাপ, উপর-নিচ চাপ, পাশাপাশি চাপ, আবার নিজের সাথে নিজের চাপ এবং অন্যের সাথে নিজের চাপ। চতুরমুখি চাপে পরে আবার নিজের আসল চরিত্র হারায়। ফলে অন্যরা মধ্যবিত্তে অবস্থান করা ব্যক্তিকে সহজে ভুল বুঝতে ছাড়ে না। কবি খুবই দক্ষতার সাথে এই শ্রেণী চরিত্র নানা কথার ফুলঝুরিতে উপস্থাপন করেছেন।
“ওরা কাজে কম, কথায় বেশি, মধ্যবিত্তের, এই হল, রাশি ! পারেনা উঠিতে উপর গাছে, সদা ভাবনায় মনটি নাচে”, মধ্যবিত্তের নানা কিছু ম্যানেজ করে চলতে হয়, নানান জনের সাথে উঠা বসা করতে হয়, নানামুখী মানুষের সাথে সামঞ্জস্য বজায় রেখে চলাফেরা করতে হয় ফলে কথা একটু বেশীই বলতে হয়, সময়ের বিচারে তাই কাজের চেয়ে কথাই বেশী মনে হয়। অনেক সময় নিম্নবিত্ত এবং উচ্চবিত্তের মাঝে ব্রিজ হিসেবেই কাজ করতে মধ্যবিত্তকে তাই কথার জাদুতেই সবার মনরক্ষা করে চলতে হয়।
মধ্যবিত্ত শ্রেণীতে অবস্থান করার কারনে ভয়াবহ অভিজ্ঞতার মধ্যে জীবন চলে, তার থেকে মুক্তি পেতেই শ্রেণী অবস্থান পরিবর্তন করার এক তীব্র বাসনা, এক স্বাভাবিক স্বপ্ন থাকে মধ্যবিত্তের প্রায় সবার। আবার সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে বেড়ে উঠে তার টনটনে মূল্যবোধ, জাগ্রত থাকে তার মানবিক অনুভূতিগুলো ফলে তীব্র আত্মসম্মান বোধ থাকে, যাকে অন্যরা ভুল বুঝে কিংবা ব্যঙ্গ করে বলে ‘ঠুনকো তাদের মান-সম্মান’। অন্যদিকে, জীবনের সময়ের স্বল্পতার কারনে এক জেনারেশনেই সে তার মুক্তি, তার শ্রেণী চরিত্রের বদল এবং অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য খুব দ্রুতই ‘গাড়ি বাড়ি এবং জীবনের নিরাপত্তা’ চায়, যাকে অন্যরা ব্যঙ্গ করে বলে ‘ঘোড়া রোগ’।
কাজের বেলায়, শৌখিন বাবু , ঝুটঝামেলায়, বেজায় কাবু ! নিছক কথায়, খৈ ছোটে-ফুরোয় না তার কথা মোটে- কবি বোধহয় একটু ভুল বুঝলেন এখানে, মধ্যবিত্ত কখনই ঝুটঝামেলায় কাবু হয় না বরং তাকে কৌশলী হতে হয় প্রতিনিয়ত ফলে আপাত মনে হয় পারে ঝুট ঝামেলা এড়িয়ে চলায় চেষ্টা করে কিন্তু মুলত ঝুট ঝামেলাকে ম্যানেজ করেই মধ্যবিত্তের প্রতিনিয়ত টিকে থাকা।
অল্পবিদ্যায় ,বাজায় ঢোল ,বাজনা তার, আবোল তাবোল ! পূজো-পার্বণে, খরচায় মাতে , যদিও থাকে না পয়সা হাতে । খেয়ে ঘোল, মাংসের ঢেঁকুর ! মান বাঁচাতে ,পোষে কুকুর । এখানে কবি মধ্যবিত্তের সক্ষমতার অভাবকে সত্যিই ব্যঙ্গ করলেন, কিন্তু মধ্যবিত্তের কিছুই করার থাকে না। মাঝে মাঝে একটু শখ আহ্লাদ করে একই শ্রেণীর মধ্যে আবার যারা একটু উচুতে অবস্থান করেন তাদের কাউকে কাউকে ‘কুকুর পোষ’তে দেখা যায় বটে কিন্তু সেটা সার্বজনীন নাও হতে পারে।
সব মিলিয়ে কবিতাটি মধ্যবিত্ত শ্রেণী চরিত্রের এক অসাধারন চিত্রায়ন মনে হয়েছে। কবির জন্য শুভেচ্ছা রইলো।