আলোচনা ৮৪
পুরুষতান্ত্রিক ধ্যান ধারনাকে আঘাত করার অভিপ্রায়কে সামনে রাখেই কাব্যটি রচিত হয়েছে বোঝা যায় কিন্তু ভিন্নধর্মী একটি কৌশল অবলম্বন করতে দেখা গেল যা একটি ভিন্ন মাত্রা দেয়। একজন নারী কিংবা পুরুষ উভয়ই ‘পুরুষতান্ত্রিক’ ধারণায় বিশ্বাসী হতে পারে কিন্ত এখানে একজন নারীকে পুরুষতান্ত্রিক ধারনার বাইরে রাখা হয়েছে। সচরাচর ‘পুরুষতান্ত্রিক জ্ঞানকাণ্ডকে’ নারী অধিকার ফ্রেমওয়ার্ক থেকে আঘাত করা হয় এবং সে প্রেক্ষাপট নির্মাণের মধ্য দিয়ে কবিতা, উপন্যাস কিংবা প্রবন্ধ লেখা হয় কিন্ত এখানে পুরুষকে “পুরুষতান্ত্রিক তথা আধিপত্য বাদী’ ভিন্ন এক অস্তিত্বের মুখোমুখি দাড় করিয়ে, নারীর ক্ষোভ, যন্ত্রণা, হতাশা কিংবা বঞ্চনাকে উপলব্ধি করার অর্থাৎ ‘নারীর চোখে নারীর জীবন’কে একজন পুরুষের উপলব্ধিতে নিয়ে আসার চেষ্টা করা হয়েছে, সত্যিই এক ভিন্নতা দেখতে পেয়েছি কবিতায়। আলোচনা করছিলাম, কবি তন্ময় দে বিশ্বাস এর কাব্য ‘ইচ্ছে ভয়’ নিয়ে।
প্রত্যেক মানুষেরই নিজের, একান্ত নিজের কিছু ইচ্ছে অনিচ্ছে থাকে, নিজেকে নিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে, নিজের সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করে, নিজের মত করে ঘুরতে ইচ্ছে করে, আরও কত কি ইচ্ছে করে!! সব সময় শুধু অর্থ, বিত্ত, সম্পদ, গাড়ি, বাড়ি, বিদেশ ভ্রমণ… মানুষকে সুখী করতে পারে না। জীবনের জন্য ওগুলোর প্রয়োজন অনস্বীকার্য কিন্তু খুব সামান্য কিছু হলেও মানুষ তা নিজের মত করে চায়, এই যেমন- একটু গুনগুনিয়ে গান গাওয়া, চাইলে একটু বৃষ্টিতে ভেজা, কবিতা লেখা কিংবা মন খারাপ হলে একা একা বসে থাকা।
কিন্তু এই সামান্য বিষয়গুলোতেও নারীর জন্য বাঁধা, নিষেধাজ্ঞা। নারী তার জীবনচক্রে কখনো মা, বোন কিংবা স্ত্রী কিন্তু সব সময়ই একজন পুরুষ তার অভিভাবক, কেউ না কেউ তার সমস্ত দায় দায়িত্ব নিয়ে থাকে, তার উপর আধিপত্য বিস্তার করে থাকে ফলে নারী আর ‘মানুষ’ থাকে না, তার প্রথম পরিচয় আর মানুষ থাকে না, নারী হয়ে যায় স্ত্রী, মা কিংবা বোন। ফলে নারী হারায় তার স্বাধীন সত্ত্বা, হারায় তার নিজস্বতা। নারী হয়ে উঠে অন্যের অধীন। নারীর খুব সামান্য যে চাওয়াটুকু থাকে তাও হারিয়ে যায় পুরুষতান্ত্রিক রক্তচক্ষুর কারনে, কবি খুব স্পষ্ট করে ফুটিয়ে তুলেছেন তার কাব্যের প্রথম ছত্রে।
পরের ছত্রে, একজন নারী ক্ষোভ প্রকাশ করে পুরুষকে বলছে-“তুমি স্বামী, তুমি প্রভূ- তুমি প্রিয়, আমার সকল ইচ্ছেরা মাথা কুটে মরে,তোমার অনুমতি প্রতীক্ষায়, আমার ইচ্ছের বাঁচা মরা সব, তোমার অঙ্গুলীহেলনে,আমার ইচ্ছেদের গলা টিপে ধরে আছো তুমি, আমার প্রিয়”। কি এক অসহায় আর্তি ফুটে উঠে!! কি এক জীবন যন্ত্রণা নারী তার সমগ্র জীবনব্যাপী উপভোগ করে!!!
এবার পুরুষকে অর্থাৎ তার স্বামী কিংবা প্রভুকে দাড় করিয়ে দিচ্ছে, অন্য এক প্রভুর সামনে এবং নারীর স্বকীয়তা হারানোর বেদনাকে তুলে ধরছে, নারী যেমন তার স্বামী/প্রভুর কাছে অসহায়, তেমনি পুরুষটিও অন্য কোন প্রভু কিংবা ক্ষমতাধর কারো কাছে অসহায়। নারীর ক্ষোভ ও বেদনাকে পুরুষের অনুভবে নিয়ে আসার চেষ্টা করেছে, একই রকম পরিস্থিতি সৃষ্টি। তাই কবি লিখেন-
“কেমন লাগবে যদি জগতের প্রভূ-অনুমোদন না করেন তোমার ইচ্ছে স্বার্থকতায়? তাঁর অনিচ্ছা অঙ্গুলীহেলনের অপেক্ষায়-বন্দি থাকে তোমার সব ইচ্ছা অনিচ্ছা?”
কবি শেষ করেছেন, ঠিক ওরকম একটি অবস্থা (নারীর বর্তমান যে অবস্থা ও অবস্থান) যদি পুরুষের হয় তবে কেমন হবে?
তোমার ভালো লাগবে প্রভূ ?
তোমার ভালো লাগবে স্বামী ?
তোমার ভয় পায়না ? লজ্জা করেনা ?
অসাধারন একটি বিষয়বস্তু নিয়ে কাব্য রচনার জন্য কবির প্রতি অভিনন্দন এবং শুভেচ্ছা।