আলোচনা ১৫৭
হতাশায় আক্রান্ত হয়নি এমন মানুষ বোধ হয় নেই এই পৃথিবীতে। কেউ সামষিক সময়ের জন্য আবার কেউবা দীর্ঘ সময়ের জন্য। হতাশায় আক্রান্ত হওয়া যেমন বাস্তবতা তেমনি হতাশাকে এক সময় জয় করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসা সেটাও বাস্তবটা। প্রকৃতির অদ্ভুত সব নিয়ম কানুন আছে, সবটা মানুষ এখনো আবিস্কার করতে পারেনি।
হতাশা (depression) যখন বছরের পর বছর ধরে থাকে যাকে বলা হয় chronic depression, সেটাকেই কবি কাব্যিকভাবে বলেছেন “হতাশার চাদর”, অর্থাৎ আপদমস্তক হতাশায় ভরপুর, মানে চাদরে ঢাকা। মানুষের জীবনে কেন এই হতাশা, তা নিয়ে মনোবিজ্ঞানি, মনস্তাত্তিক, নৃবিজ্ঞানী এবং সমাজ বিজ্ঞানীদের বিস্তর গবেষনা আছে কিন্তু গবেষনার ফলফল কোন একরৈখিক সরলরেখা দ্বারা আটকানো যায় না। হতাশা একটি বহুমূখী কারন এবং ফলাফলের সমষ্টি। অন্যদিকে, ধর্মতাত্তিকগন থেকে শুরু করে যোগী বিশেষজ্ঞগন হতাশা থেকে মুক্তির নানা উপায় বা ফর্মুলা বলে থাকেন। পৃথিবীর সকল ধর্মই হতাশার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের একটি সফল ফর্মুলা বলে থাকেন, সেটা হলো, জাগতিক লোভ, লালসা, চাওয়া পাওয়া, আশা নিরাশা থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রেখে পরকালের প্রাপ্তির জন্য চেষ্টা করা এবং সেদিকেই মনোনিবেশ করা। তাহলেই হতাশা থেকে মুক্ত থাকা যাবে।
আমি নিজেও মাঝে মাঝে হতাশা দ্বারা আক্রান্ত হয়ে পড়ি, তখন তাও তে চিং পড়ি (২৫০০ বছর আগের চীনা দর্শন), ধর্মীয় গ্রন্থের তাফসীর পড়ি, মোটিভেশনাল বই পড়ি এবং ভিডিও ক্লিপ দেখে থাকি। কিন্তু পারতো পক্ষে কোন মনোবিজ্ঞানীর দ্বারস্থ হই না, ভিন্ন একটি কারনে। একেকজন একেকভাবে নিজেকে হতাশা থেকে মুক্ত রাখে, হতাশাকে জয় করে থাকে। আমি যেমন, হতাশার Root Cause Analysis করি হতাশার Cause Effect Analysis করি এবং নিজে নিজেই wayout বের করে থাকি।
আলোচ্য কবিতায়, কবি হতাশার একটি মাত্র কারন খুঁজে পেয়েছেন এবং সেটা নিয়েই পুরো কবিতা রচনা করেছেন, আর সেটা হলো অর্থের অভাব। অর্থ না থাকার কারনে যেমন হতাশা তৈরী হয় আবার অর্থের প্রাচুর্যের কারনেও হতাশা তৈরী হয়। যে কারনে, নানা ধরনের প্রবাদ প্রচলিত আছে “ অর্থই সকল অনর্থের মূল’, কিন্ত যার কাছে অর্থ নেই, এমনকি যৎসামান্য অর্থও নেই, তার কাছে এই প্রবাদ বাক্যের কোন গ্রহনযোগ্যতে নেই। ফলে, অর্থ থাকা এবং না থাকা, অর্থের কারনে হতাশা আসা বা না- আসা পুরো বিষয়টিই প্রেক্ষিত নির্ভর। সময়ের কাছেই এর উত্তর মেলে।
কবি তার কবিতায়, জীবন, স্বপ্ন, সুখ, অর্থ এবং হতাশা, এই পাঁচটি শব্দকে একটি সরলরেখায় ফেলে কাব্য রচনা করেছেন। একটি অন্যটির সাথে হয়তো যোগসূত্র আছে কিন্তু একটি অপরটির কারন ও ফলাফল কোন অর্থেই নয়। ধারনা করি, কবি হতাশায় থাকার কারনে, পুরো বিষয়টি গুলিয়ে ফেলেছেন। হতাশা এবং অভাব দুটি ভিন্ন অর্থ এবং এর উৎস বা ফলাফলও ভিন্ন হতে পারে। এমন না যে-
অর্থ থাকলে স্বপ্ন পূরন হবে, স্বপ্ন পূরন হলে জীবনে সুখ আসবে, সুখ আসলে জীবন পরিপূর্ন হবে এবং তখন আর কোন হতাশা থাকবে না। জীবন এবং জীবনের প্রেক্ষিত এতোটা সরল রৈখিক নয়, জীবনকে কোনভাবেই এরকম ফর্মুলা দ্বারা ব্যাখা করা যায় না। এর মাঝে নানাবিধ কারন থাকে, অর্থ আছে, কোন অভাব নেই, সুখও আছে কিন্তু তারপরও জীবনে হতাশা আসতে পারে, এরকম উদাহরন আমাদের আশেপাশেই ভুড়ি ভুড়ি আছে।
তবে, কবিতায় শেষে গিয়ে কবি, হতাশা থেকে মুক্তির জন্য ধর্মের আশ্রয় নিয়েছেন। এটাও খুব স্বাভাবিক, মানুষ যখন আর কোন কূল কিনারা খুঁজে পায় না, নিজের আত্মবিশ্বাস ভাঙতে ভাঙতে তলানীতে চলে যায়, তখন শেষ ভরসাস্থল হিসেবে “ধর্মের কাছেই আশ্রয় খোঁজে, এখানেই আশ্রম মেলে”
কবিতাটি আরো বিস্তর আলোচনা করা যেতো, কিন্তু এখানেই থামলাম, পাঠককে মূল বিষয় বোঝাতে পেরেছি বলেই আমার ধারনা
কবির জন্য রইলো শুভেচ্ছা।