আলোচনা ২১৫
কবিতাটি পড়ে আমি দুভাবে ভেবেছি-প্রথমত, দর্শন ভাবনা হিসেবে এবং পরে ব্যঙ্গাত্মক কাব্য হিসেবে।
প্রথম ভাবনা হিসেবে-কবিতাটিকে আমি দর্শন কাব্য বলতে বেশি আগ্রহী। চীনা তাও তে চিং দর্শন, কনফুসিয়াস দর্শন এমনকি আমাদের এই উপমহাদেশের লালন শাহ এর দর্শনের সাথে অনেক মিল খুঁজে পাই। খুব সাধারন চিন্তায় “বাহিরে ভিতরে” এর কূল কিনারা পাওয়া মুশকিল। একই সত্ত্বার মধ্যে ‘বাহির’ এবং ‘ভেতর” এর সত্ত্বা বোঝা একটু কঠিন বৈকি, এটা একটা উঁচুস্তরের দর্শন। যেমনঃ
চাকার মাঝে স্পোক
বৃত্তের মাঝে শূন্যতা
ফলাফল গতি
----(তাও দর্শনকাব্য)
তোমার ঘরে বাস করে কারা
ও মন জান না
তোমার ঘরে বসত করে
কয় জনা মন জান না
এক জনে ছবি আঁকে
এক মনে, ওরে মন
আরেক জনে বসে বসে
রঙ মাখে, ওরে মন.....
-----(ফোক গান)
কিংবা
সেথা এক পড়শি বসত করে।
আমি একদিনও না দেখিলাম তাঁরে।।
কি বলবো সেই পড়শির কথা
তার হস্তপদ স্কন্ধমাথা নাইরে।
ক্ষণেক থাকে শূন্যের উপর
ক্ষণেক ভাসে নীরে।।
পড়শি যদি আমায় ছুঁতো
যম যাতনা সকল যেতো দূরে।
সে আর লালন একখানে রয়
তবু লক্ষ যোজন ফাঁক রে।।
-----(লালন গীতি)
কিংবা
জীবন নামের রেলগাড়িটা
পায় না খুঁজে ষ্টেশন... -----(ফোক গান)
প্রত্যেক মানুষের মধ্যে “ভেতর” এবং “বাহির” নামক দুটো সত্ত্বা থাকে। সত্ত্বা দুটোর মধ্যকার দ্বন্দ্ব সব সময় চোখে পড়ে না এমনি কি ব্যক্তি নিজেও সব সময় তা টের পায় না। খুব সচেতন এবং আধ্যাত্মিক চর্চার মানুষেরা দুটো সত্ত্বার উপর সমভাবে নিয়ন্ত্রন রাখতে পারে। একটু সচেতন মানুষ, তার শিক্ষা এবং সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়া তাকে অনেক সময়ই সচেতন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে “বাহির এবং ভেতর” এর আচরনগত সমন্বয় সাধন করতে সহায়তা করে থাকে। কিন্তু একেবারেই সাধারন মানুষ, খুব অসচেতন মানুষের পক্ষে দুটো সত্ত্বা মধ্যেকার দ্বন্দ্ব অনভুব করা সম্ভব হয় না এবং তারা সার্বক্ষনিক একটি দ্বান্দিক প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়েই জীবন পরিচালিত করে থেকে যা তাদের প্রতিদিনের আচরনে প্রকাশ পায়। কবি আলোচ্য কবিতায় সেই “বাহির এবং ভেতর’ এর দ্বন্দ্ব প্রকাশ করেছেন নিপুন এক দক্ষতায়।
বাইরে থেকে দেখা যায়, আমি একজন মানবিক মানুষ, দর্শন চর্চা করি, জ্ঞানী হিসেব পরিচিত, পুঁথি পড়ি, ধার্মিক হিসেবে খ্যাত, সামাজিক ন্যায় বিচার এবং সমতার কথা বলি, মানুষের কষ্টের কথা ভাবি, সমতা আনয়নের ভাষন দিই, সমতার ভাবনায় প্রতিদিন পার করে, হেটে যাই বিনয়ভাবে ইত্যাদি। এসবই আমার বাইরের রূপ, কিন্তু ভেতর আছে ভিন্নতা। আমি খুব ভালো করে জানি, মানুষের অসহায়ত্তকে নিয়ে কিভাবে খেলতে হয়, কিভাবে একপক্ষকে অন্যপক্ষের বিরুদ্ধে উস্কে দিয়ে ফায়দা লুটতে হয়, কিভাবে মানুষের আবেগকে নিজের উদ্দেশ্য পূরনে কাজে লাগাতে হয়, নিজের মনগড়া দর্শন আওড়ে কিভাবে মানুষকে বশীভুত করতে হয় ইত্যাদি। বাহির এবং ভেতরের বিপরীতমুখী আচরন ও ভাবনা অন্যরা বুঝতে পারে না। কেউ কেউ দ্বান্দিক এই বিষয়টা বুঝতেই পারে না আবার কেউ কেউ নিজের প্রয়োজনে ইচ্ছে করেই বিপরীতমুখী আচরন করে, বিপরীতমুখী চরিত্রের মানুষ তারা।
নানা ধরনের নৈতিকতা কেতাবি শ্লোকের আকারে অন্যকে উপদেশ দিই কিন্তু নিজে মানি না এমনকি এর প্রায়োগিকতা নিজে কখনো ভেবেও দেখিনি। সমসাময়মিক ভাবনার সাথে সমঞ্জস্যবিধান না করে কেবল বাহবা পাবার উদ্দ্যেশেই উপদেশ বানী প্রচার করি। মনে মনে আত্মসুখ খুঁজে পাই, এতে করে প্রভুর ইচ্ছে পূরন হলো কিন্তু এর গভীরে যেতে ভয় কেননা তাতে করে “নিজের ভেতরটা” প্রকাশ হয়ে পরবে!!
কবি, নানাভাবে বাহির এবং ভেতরের মধ্যকার দূরত্বকে পরিমাপ করেছেন, উন্মোচন করেছেন, সমসাময়িক আচরনমালা, তুলে ধরেছেন বিপরীতমুখী মানুষের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য অত্যন্ত ব্যাঙ্গাত্মকভাবে।
কবি’র জন্য রইলো অফুরান শুভেচ্ছা