আলোচনা ১৩৩
কবিতার উপর আলোচনা লিখতে লিখতে নানা সময়েই ভাবনা আসে, কবিতাটি কেন ভালো লাগলো আমার, কেন মন ছুঁয়ে গেলো, অন্যদের কি একইভাবে আলোরিত করে? কোন কোন কবিতা অনেক বেশী ভালো লাগার কারন কি, নিজের জীবনের প্রতিচ্ছবি কিংবা ভাবনার বিচ্ছুরন? কত রকম ভাবনাই না কাজ করে মনে। এক কবিতাটি নিয়েও সেরকম এক ভাবনায় আচ্ছন্ন ছিলাম, বেশ কিছুক্ষন।
মানব জীবন এক অদ্ভুত রহস্য ঘেরা! আমরা ছোট বেলায় বড় হতে চাই, আবার বড় বেলায় ছোট হতে চাই, অবিবাহিত জীবন ছেড়ে বিবাহিত জীবন চাই আবার পরে উল্টোটা চাই, ছাত্র জীবন শেষ করে কর্মজীবন চাই আমার কর্মজীবনে গিয়ে ছাত্র জীবনে ফিরে আসার জন্য হাহাকার করি। কোন কিছুতেই, কোন অবস্থাতেই আমরা তৃপ্ত হতে পারি না, আমরা নিজ নিজ অবস্থান মেনে নিতে পারি না।
আমরা দিনের বেশীর ভাগ সময়ই হয় অতীতে বসবাস করি নয়তো ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবনায় থাকি, ‘বর্তমানে’ আমাদের থাকাই হয় না। Eckhart Tolle এর একটি বিখ্যাত বই আছে, নাম “The Power of Now”, আমার সংগ্রহে আছে, মাঝে মাঝেই পড়ি, নিজেকে বর্তমানে রাখার চেষ্টা করি, কিন্তু বেশীর ভাগ সময়ই পারি না, ঘুরে ফিরে অতীতে চলে যাই নয়তো ভবিষ্যতে পরে থাকি। গুরুত্বপূর্ণ সময় “বর্তমান”, অথচ আমরা “অতীত” যা শেষ হয়ে গেছে কিংবা ‘ভবিষ্যত” যার অস্তিত্ব জানা নেই, সেগুলো নিয়েই বর্তমানের সময়কে অপচয় করি। মানব জীবনের এ এক অদ্ভুত রহস্য। এক কাজটা আমি কিংবা আপনি একাই করি না, প্রায় সবাই এভাবেই দিন অতিবাহিত করি, যার কোন মানেই হয় না, সেটাও জানি, কিন্তু তারপরও আমাদের অতীত কিংবা ভবিষ্যতে থাকতেই বেশী ভালো লাগে কিংবা এক অনিয়ন্ত্রিত অভ্যাস যাকে বলা যায়।
কবিতায় কবি ঠিক সেরকমই অভ্যাসের কথা বলেছেন, ছোটবেলায় খুব ছোট ছোট কোন ভুলের কারনে বা অন্যায়ের কারনে বাবা মা বকুনি দেয় তখন খুব কষ্ট পাই, মনে হতে থাকে কবে বড় হবো, কবে বাবা মায়ের বকুনি থেকে মুক্তি পাবো, ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে থাকি। আবার বড় হয়ে যাবার পর, নিজেরা স্বাধীন হয়ে যাবার পর, বাবা মায়ের সেই বকুনি খুব অনুভব করি, অতীত রোমন্থন করে কষ্ট পাই। আক্ষেপ করতে থাকি, ছোটবেলার বাবা মায়ের সেই বকুনি কতই না মধুর ছিল, যদি আরেকবার ফিরে পেতাম, দীর্ঘ নিঃশ্বাস বেরিয়ে আসে মনের অজান্তেই। বাবা মা বেঁচে থাকার পরও সেই মধুর সময় আর ফিরে আসে না কিন্তু যদি বাবা মা চিরদিনের জন্য হারিয়ে যায় তখন সেই স্মৃতি বিষাদে পরিনত হয়। (উল্লেখ্য, আমি আমার বাবা মাকে ২০২০ সালে মাত্র ২১ দিনের ব্যবধানে দুজনকেই চিরদিনের জন্য হারিয়ে ফেলেছি)
কবিতাটি পড়ার সময়, নিজের জীবনের পেছনের সেই স্মৃতি, ছোটবেলার সেই যে মায়ের বকুনি ফিরে ফিরে আসছিল। মনের অজান্তেই চোখের কোণ থেকে গড়িয়ে পড়ছিল ফোঁটা ফোঁটা অশ্রু। কোন কোন কবিতা কারো জীবনের কোন অভিজ্ঞতা কিংবা স্মৃতির সাথে যদি মিলে যায় তখন সেই কবিতা হয়ে ওঠে জীবন্ত, কবিতাটি প্রান নিয়ে পাঠকের মনে জায়গা করে নেয়। এই কবিতাটি সেরকম একটি কবিতা।
কবির জন্য রইলো প্রানঢালা শুভেচ্ছা, জীবন্ত একটি কবিতা উপহার দেয়ার জন্য।