আলোচনা ২১২
প্রচার, আত্মপ্রচার, প্রচার বিমুখ... শব্দগুলো নানামুখী ভাবনা তৈরি করে। কোন ভালো কাজ যা সমাজের জন্য মঙ্গল, যা অন্যকে উৎসাহিত করে, যা প্রচার করলে সামষ্টিক উন্নতি হবার সম্ভাবনা থাকে... সেগুলো প্রচার করলে ক্ষতি ? বরং প্রচার বিমুখ হলে, নিজের কোন উদ্ভাবন, নিজের কোন সৎ সাহসী কাজ, মানবিক কাজ গুলো অন্যের জানার বাইরে থেকে যায় ফলে সেটা অন্যদের মাঝে ছড়িয়ে যাবার সম্ভাবনা কমে যায়। এক রকম কাজে অন্যদেরকে উৎসাহিত করার সুযোগ থাকে না। ফলে এসব ক্ষেত্রে প্রচার বিমুখ হবার চেয়ে প্রচারমুখী হওয়াই ভালো।
আমাদের ছোটবেলায় অনেক শুনতাম, “ নিজে যাকে বড় বলে, বড় সেই নয়, লোকে যাকে বড় বলে বড় সেই হয়” কিন্তু এখন উল্টো কথাও শোনা যায়, “নিজে যাকে বড় বলে, বড় সেই হয়, লোকে কাকে কি বলে, তা শুনিবার নয়”। পট পরিবর্তন হবার কারনে, কথা উল্টে গেছে। আবার এটাও শোনা যায়-“নিজের ঢোল নিজে পেটানোই ভালো, অন্যকে পেটাতে দিলে তা ফাটাইয়া ফেলবার সম্ভাবনা থাকে”। এখানে আত্মপ্রচারকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে, যুক্তি হলো, নিজের সম্পর্কে নিজেরই সবচেয়ে বেশী ভালো জানা থাকে, অন্যরা নিজের সম্পর্কে খুব অল্পই জানে, ফলে ভুল ভাবে প্রচার করার সম্ভাবনা থেকেই যায়, সেই যুক্তিতে নিজের প্রচার নিজের কৌশলেই করা দরকার। যাকে আত্মপ্রচার বলা হয়।
আবার পন্য প্রচার করার জন্য ভিন্ন শব্দ ব্যবহার হয়, যাকে “বিপনন” বলা হয়, “প্রচারেই প্রসার”, অন্যথায় পন্য বিক্রি হবে না। পুন্য বিক্রির ক্ষেত্রে, বাজার ব্যবস্থাপনা এবং পন্য বিপননের ক্ষেত্রে “প্রচার’ এর কোন বিকল্প নেই। কিন্তু পন্য ছাড়া,মানুষের কোন ভালো কাজ, কোন উদ্ভাবন, কোন উৎসাহ উদ্দীপনামূলক কাজ...কি প্রচার হবে না? কে প্রচার করেবে? কিভাবে প্রচার করবে? ইত্যাদি প্রশ্নগুলো সামনে আসলেই সমস্যা তৈরী হয় আর তখনই “আত্মপ্রচার” শব্দটি ঝামেলা তৈরী করে।
“আত্মপ্রচার”, মানে নিজের কাজ নিজেই প্রচার করা, নিজেকে নিজেই প্রচার করা, প্রকাশ করা, নানা কৌশলে তা উপস্থাপন করা, ইনিয়ে বিনিয়ে নিজেকেই বড় করে তোলা, নিজের গুন, নিজের ক্ষমতা, নিজের জ্ঞান, নিজের দক্ষতা...প্রকাশ করা এবং এর মাধ্যমে অন্যকে নিঃশব্দে হীন করা, ছোট করার একটা প্রচ্ছন্ন উদ্দেশ্য থাকা। কিন্তু যদি উদ্দেশ্য মহৎ থাকে, নিজের ভালো কোন কাজ প্রচারের পেছনে অন্যকে উৎসাহ দেয়ার, অন্যকে সম্প্রক্ত করার উদ্দেশ্য থাকে, তাহলে কোন সমস্যা নেই। কিন্তু সেক্ষেত্রে নিজের ভালো কাজ বা নিজের ভালো কিছুকে প্রচার করার দায়িত্ব নিজে না নিয়ে, অন্যরাই সে দায়িত্ব নিয়ে থাকে সাধারনত। ফলে, আত্মপ্রচার তিনটে কারনে নেগেটিভ ইমেজ তৈরী করে, ১) আত্মপ্রচারের মাধ্যমে যদি অন্যকে হেয় করার প্রবনতা থাকে ২) আত্মপ্রচারের মাধ্যমে যদি মন্দকাজকেও ভালো হিসেবে উপস্থাপন করা হয় এবং ৩) আত্মপ্রচারের মাধ্যমে যদি সামষ্টিক কল্যান না দেখে নিজের কল্যান বা উন্নতির জন্য করা হয়। অন্যথায় আত্মপ্রচার খারাপ কিছু না, বলা যায় উল্লেখিত তিনটি উদ্দেশ্য বাদ দিলে আত্মপ্রচার করার কোন প্রয়োজনই হয় না, তখন প্রচার হয় যেটা অন্যরা করে থাকে।
ধর্মীয় মূল্যবোধে, আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে দেখানোর জন্য বা কারো কাছ থেকে প্রশংসা, সম্মান কিংবা পুরস্কার লাভের জন্য কাজ করাকে ‘রিয়া’ বলা হয়। বাংলায় আমরা একে আত্মপ্রচার, প্রদর্শননেশা ও প্রদর্শনিচ্ছা বলতে পারি। কোরআন ও হাদিসে এর ভয়াবহতা সম্পর্কে সতর্ক করা হয়েছে। রাসুল (সা.) রিয়াকে ছোট শিরক বলে আখ্যায়িত করেছেন।
আলোচ্য কবিতায়, আলোচিত আত্মপ্রচারের সবগুলো বৈশিষ্ট্যই দেখতে পাই ফলে তা প্রচারের একটা নেগেটিভ ফর্ম হিসেবে দেখাঁ যায়। কবি, যদিও খুব মজার ছলে/ ব্যংগাত্মক ভাবে লিখেছেন কিন্তু এটাই এখন বাস্তবতা। এখন সবাই আত্মপ্রচারে ব্যস্ত থাকে, তার সাথে যুক্ত হয়েছে আধুনিক প্রযুক্তি এবং সোস্যাল মিডিয়া। নানাধরনের প্রযুক্তিগত সুবিধে এবং সোস্যাল মিডিয়ার (যেসন ফেস বুক, ইউটিউব ইত্যাদি) কারনে মানুষ আরো বেশী আত্মপ্রচারে উদ্বুদ্ধ হয়ে পরেছে। আত্মপ্রচার বিমুখ মানুষ নিজেদের টিকিয়ে রাখার সামর্থ হারাছে। যাকে সামাজিক মূল্যবোধের চরম অবক্ষয় হিসেবে সমাজ বিজ্ঞানী এবং নৃবিজ্ঞানীগন উল্লেখ করে থাকেন।
কবি একটি দৃশ্যকল্প একেছেন তার কবিতায়, একজন আত্মপ্রচারমুখী মানুষের। তিনি মিডিয়া কর্মীদের এবং চিত্রগ্রাহককে রেডি থাকতে বলছেন, পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা দিবস বা এরকম কোন একটি কারনে খালি বোতল, খালি মোড়ক পরিস্কার করবেন, সেই কাজটাই তিনি প্রচার করতে চান সবার কাছে। তিনি একজন সমাজ সেবক, তিনি সামাজিক কাজে নিজেকে সব সময় সসম্পৃক্ত রাখেন... এমনটাই প্রচার করতে চান। তাই তিনি বেশ আয়োজন করে, সবাইকে নিয়ে এই কাজটির দৃশ্যায়ন করবেন এবং প্রচার করবেন।
তিনি একা একা এই কাজটি করবেন না, ছবিতে সবাইকে থাকতে বলেছেন যেন প্রচার হয় তিনিই একজন ভালো সংগঠক, তার জনসম্পৃক্তা আছে, তিনি খুব সহজেই পিপল মোবিলাইজ করতে পারেন ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্ত একই সময়ে তিনি ভিন্ন ভিন্ন পোষাকে ছবি তুলবেন যেন জনগন বুঝতে পারেন, তিনি একাধিক দিনে, বেশ অনেকদিন ধরেই এ ধরনের সামাজিক কাজ করে থাকেন। আত্মপ্রচারনার ধোকাবাজির এক চরম নমুনা প্রকাশ পায় এখানে।
এর পরে, তার নির্দেশনা, এসব ছবি সকল মিডিয়াতে প্রচার করার জন্য এবং তারজন্য মিডিয়া কর্মীকে, মিডিয়া সেন্টারকে প্রতিমাসে ভাতা প্রদানও করবেন। বিনিময়ে তিনি জনগনের সামনে নিজেকে একজন সমাজ সেবক, একজন আত্মনিবেদিত সমাজকর্মী, একজন মানবদরদী ... হিসেবে মর্যাদা পাবেন, সম্মান পাবেন, বাহবা পাবেন (এমন কি এর জন্য হয়তো রাষ্ট্রের কাছ থেকে নানা ধরনের প্রনোদনা কিংবা কোন প্রকার আর্থিক বেনিফিটও পাবেন)
ছোট একটি খন্ডচিত্রে কবি নির্লজ্জ আত্মপ্রচারনার নমুনা দেখিয়েছেন মাত্র যা আমরা প্রতিনিয়ত আমাদের চারপাশে এ ধরনের ভন্ড আত্মপ্রচারকদের দেখা পাই।
কবি’র জন্য রইলো শুভেচ্ছা।