আলোচনা ২৩৫
মানুষের জীবন আসলেই কি খুব জটিল, নাকি আমরাই জটিল করে তুলি?
আমরা একে অপরের সাথে যোগাযোগ করি, কথার মাধ্যমে, শব্দের মাধ্যমে, ভাষা আমাদের শব্দের মাধ্যমে কথা শেখায়, কিন্তু এই যে কথা, এই যে শব্দ, এগুলোই কি আমাদের জীবনকে ক্রমাগত জটিল করে তোলে?
শব্দ, অনুভূতি প্রকাশকে সহাহয়তা করে, অভিযোগ, অনুযোগ, অভিমান, অনুরাগ…কে প্রকাশ করতে সহায়ত করে। কিন্তু শব্দের পেছনেও নানা রাজনীতি থাকে, শব্দ নিজেই রাজনীতি তৈরি করে। শব্দের মাধ্যেমে আমরা অনুভুতিকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র খন্ডে বিভক্ত করি, আরো গভীরে যেতে চাই। অন্যদিকে, শব্দের গভীরে যেতে গিয়ে, নানা রাজনীতির ফাঁদ তৈরি করি।
যেমন-ভালোবাসা, প্রেম, পছন্দ করা, সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য অন্যের কাছাকাছি থাকা, ইত্যাদি শব্দগুলো, অনুভূতি প্রকাশের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্রের দিকে যাত্রা, দিন শেষে শব্দের জটিলতা তৈরি করে আবার নিজেরাই হারিয়ে যাই, সঠিক ব্যাখা দিতে পারি না।
আলোচ্য কবিতা, “আমি বোকা হতে চাই”, কবি ইরফান মাহমুদ, কবিতায় এরকম একটি শব্দ চক্র নিয়েই তার ভাবনা তুলে ধরেছেন। মানুষের চারিত্রিক বিশিষ্ট্যকে ব্যখা করার জন্য, আমরা বেশ কিছু শব্দ ব্যবহার করে থাকি, চালাক, চতুর, বোকা, সহজ, সরল, ধূর্ত ইত্যাদি। চালাক শব্দটি পজিটিভ অর্থে ব্যবহার করি আবার কখনো ব্যঙ্গ করে বলে থাকি, “শেয়ালের মতো চালাক” অর্থাৎ ধূর্ত।
আলোচ্য কবিতায়, কবি ‘বোকা” শব্দের একটি ব্যাখা বা সংজ্ঞা দার করিয়েছেন, নিজের মত করে, অন্যরা কবি’র সাথে একমত নাও হতে পারে কিন্তু তিনি, ‘বোকা” হতে পারার কিছু সহজ সরল উপাদান ব্যাখা করেছেন এবং সেগুলোকে জীবনের আদর্শ হিসেবে উপস্থাপন করেছেন বা মেনে নিয়েছেন।
• বোকা হতে হলে, জটিলতা পরিহার করতে হবে
• বোকা হতে হলে, পৃথিবীকে শিশুর চোখে দেখতে হবে, অর্থাৎ নিরহংকার, নির্ভাবনা, যুদ্ধ বিগ্রহ, আধিপত্য… বাদ দিতে হবে
• বোকা হতে হলে হাসতে হবে, কাঁদতে হবে, অভিমান করতে হবে, অভিযোগ করতে হবে, অর্থাৎ অনুভূতিতে সকল প্রকার কৃত্তিমতা পরিহার করতে হবে
• বোকা হতে হলে-ভুল করতে হবে, ভুল স্বীকার করতে হবে, ভুল থেকেই শিখতে হবে
• বোকা হতে হলে, অল্পতে তুষ্ট হতে হবে, ত্যাগী হতে হবে
• বোকা হতে হলে, অন্যের উপর আস্থা রাখতে হবে, ভালোবাসতে হবে, বিশ্বাস স্থাপন করতে হবে
• বোকা হতে হলে-নিজেকে নির্মল হাসিতে ভরিয়ে রাখতে হবে, পৃথিবীর যাবতীয় জটিলতা পরিহার করে, একটি সুন্দর সমাজ, দেশ ও পৃথিবীর গড়ে তোলার আত্ম প্রত্যয় থাকতে হবে
আমরা সচরাচর যে শব্দকে পজিটিভ বা ভালো বলে মনে করে থাকি কিংবা সমাজে প্রচলিত ভালো শব্দ বলে সবাই স্বীকার করি, সে সব শব্দের সমাহার করে, “বোকা”, শব্দের ব্যাখা দাড় করিয়েছেন।
কিন্তু প্রায় অধিকাংশ শব্দই নিরপেক্ষ শব্দ নয় (আসলে কোন শব্দ কি নিরপেক্ষ হয়? এটা আমার নিজের প্রশ্ন?), শব্দগুলো আপেক্ষিকতায় ভরপুর যেমন-
• জটিলতাঃ আসলে কোনটাকে জটিলতা বলবো? কি হলে জটিল হবে আর কি হলে জটিল হবে না? কে ঠিক করবে জটিলতা?
• সহজেঃ কোনটা সহজ আর কোনটা কঠিন? কার জন্য সহজ কিংবা কার জন্য কঠিন? সকল পরিস্থিতিতে একই বিষয় বা কাজ কি সহজ কিংবা জটিল? এ প্রশ্ন থেকেই যায়
• দোষীঃ কে কাকে দোষী করবে? কেন করবে? দোষীর পেছনের প্রেক্ষাপট কি?
• ত্যাগীঃ আসলে কোনটা ত্যাগ বলা হয়? ত্যাগের পেছনের গল্প কি? সকল ত্যাগই কি সত্যিকার অর্থে ত্যাগ? ত্যাগ বলতে আসলেই কি কিছু আছে?
তালিকা করলে, এরকম আরো করা যাবে। পুরো কবিতাটিতে, “বোকা’র যে সংজ্ঞা তৈরি করেছেন কবি, তার নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গিতে, সেখানে অসংখ্যা, প্রেক্ষিত নির্ভর শব্দ এবং আপেক্ষিক শব্দের সমাহার দেখা যায়, প্রত্যাকটি শব্দ নিয়ে আলাদা আলাদা ব্যাখার দাবী রাখে।
কবি, নিজের মতো করে, “বোকা” হবার বা বোকা থাকার একটি পথ বাতলে দিয়েছেন এবং “বোকা” থাকাকে পজিটিভ অর্থে নিয়েছেন, সে কারনে কবি’র রইলো অফুরন্ত শুভেচ্ছা।