আলোচনা ২১৪
(আসরে নুতন কবি হিসেবে অভিনন্দন এবং স্বাগত, মাত্র দুটি কবিতা প্রকাশ করেছেন)
মানুষের মূল্য আজকাল আর মানবিক মূল্যবোধ দ্বারা বিবেচিত হয় না। মানুষের মূল্য নির্ধারন হয় তার সামাজিক অবস্থান, অর্থ-বিত্তের অবস্থান কিংবা কর্মক্ষেত্রের পজিসন দ্বারা। চরম এক সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের মধ্যে দিয়েই আমাদের এখনকার যাপিত জীবন। সভ্যতার বিকাশ হচ্ছে, শিক্ষার বিস্তার ঘটছে, প্রযুক্তির উন্নয়ন হচ্ছে বলে আমরা দাবী করি কিন্তু মানবিকতার স্থান কোথায়? মানবিক মূল্যবোধের কি উন্নতি হচ্ছে নাকি অধোঃপতন হচ্ছে, সে বিচার করছি কই?
আমাদের এই সভ্য সমাজে ‘মানুষের দেহ” বিক্রি হয়!!! শত বছর আগের ক্রীতদাস প্রথা বিলুপ্ত হয়েছে কিন্তু আসলেই কি হয়েছে? মূলত ক্রীতদাস প্রথার আধুনিকরন হয়েছে নানা ফর্মে, নানা কৌশলে, তা না হলে মানুষের দেহ কেন বিক্রি হয়?
ইদানিং আমরা দেখতে পাই, গার্মেন্টস কর্মী নিহত হয় ভবন ধবসে, শ্রমিক নিহত হয় বিশাল অট্রালিকায় আগুন লেগে, শত শত শ্রমজীবি মানুষ মুহুর্তে নিহত হয় লঞ্চ ডুবে…… তারপর চাপা পরে যায় দুর্ঘটনার কাহিনী, আবার নুতন ঘটনা তৈরি হয়। রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিবর্গ, মৃত শ্রমিকের পরিবারকে ২০ হাজার, ৩০ হাজার টাকা ছুড়ে দিয়ে ঘটনার সমাপ্তি টানেন, পেছনে পরে থাকে ঘটনার মূল হোতা, নানা অনিয়মের মাষ্টার প্লানার সরকারী কর্মকর্তা আর মালিক শ্রেনী, যাদের দুর্নীতির বিষবৃক্ষে থাকে শ্রমিক হত্যার ইতিহাস। যেটাকে আমরা দুর্ঘটনা বলে চালিয়ে দেয়ার চেষ্টা করি সেগুলো মূলত হত্যা, যার কোন বিচার হয় না এ সভ্য সমাজে। মৃত শ্রমিকের দেহের দাম ধরা হয় অনিয়মকে চাপা দেয়ার জন্য। আবার কখনো কখনো রাজনৈতিক কারনে কিংবা অনৈতিক ব্যবসার অতিরিক্ত মুনাফার ভাগবাটোয়ারা নিয়েও চলে গুম, খুন, হত্যা কিংবা আহত করার নানা কাহিনী। বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই এর শিকার হয় শ্রমিক শ্রেনী কিংবা নিরিহ এবং সৎ শ্রেনীর মানুষ।
সভ্যতার এক বীভৎস চিত্রায়ন করেছেন কবি সাজ্জাদ হোছাইন সাকিব তার কাব্য “আমার দেহের দাম”তে। একজন শ্রমিক জীবনের এক করুন চিত্র, এক হাহাকার……
আমার লাশের মূল্য মাত্র পঞ্চাশ হাজার টাকা, আহত হলে বিশ হাজার টাকা। প্রয়োজনে দু হাজার টাকা দেবো তবুও আমায় লাশ করুন কিংবা আহত করুন, বিনিময়ে আমার পরিবার কিছু টাকা তো পাবে, যা দিয়ে তাদের ভরন পোষন হবে, যারা না খেয়ে আছেন দীর্ঘদিন। এটা কোন সভ্য সমাজের চিত্র!! যেখানে একজন শ্রমিক উপার্জনের অন্য কোন উপায় না পেয়ে নিজেই নিজের লাশের দাম নির্ধারন করছেন!! তিনি জানেন এ সমাজে শ্রমিক নিহত কিংবা আহত হলে কিছু টাকা পাওয়া যায়, এটাই এ সমাজের ঐতিহ্য, এ সমাজের সংস্কৃতি। এখানে আহত কিংবা নিহত হলেই টাকা পাওয়া যায়, শ্রমের বিনিময়ে উপার্জন করার সুযোগ নেই, পরিবারকে বাঁচাতে এর চেয়ে সহজ কোন উপায় একজন শ্রমিকের জানা নেই।
মৃত্যু পরবর্তী লাশ নিয়ে কোন ঝামেলা হবে না, কাউকে কোন বিচারে কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে না, কাউকেই কোন জবাবদিহিতা করতে হবে না, শ্রমিক সেটাও জানে। কিভাবে তার লাশ হবার ঘটনা চুকানো হবে তার পরিষ্কার চিত্র তার জানা আছে। শ্রমিকের মৃত্যু পরবর্তী, শোক মিছিল হবে, আইন প্রনেতা আইনের মারপ্যাচের খেলা শুরু করবে, ভোটে নির্বাচিত নেতা ঘটা করে শোক পালন উদযাপন করবে, চারদিকে একটা শোক শোক ভাব থাকবে কয়েকদিন, তারপর নুতন ঘটনার জন্মের নাড়িকাটায় সবাই ব্যস্ত থাকবে, পুরোনো ঘটনার সমাপ্তি হবে।
এ সভ্য সমাজে, একজন শ্রমিকে লাশ হবার নানা রকম উপায়ও জানা আছে। সরাসরি লাশ কিংবা আহত করতে না পারলে, ভিন্ন কিছু কৌশলও আছে, ক্যামিক্যাল স্তুপে বিলাসিলার আগুল জ্বালিয়ে দিলেই হবে, কিছুক্ষন পর, নিজেরাই দমকল বাহিনী ডেকে আগুন নেভাবার অভিনয় করা যাবে, এদিকে কিছু পোষা সাংবাদিক ডেকে যথাযথ বিচারে দাবী করে একটা প্রেস কনফারেন্স তো করাই যায়, তারপর যথারীরিতি একটা তদন্ত কমিটি গঠন করা, রিপোর্ট জমাদানের নির্দিষ্ট একটা দিন তারিখ ঠিক করা, অতঃপর মাসের পর মাস চলবে তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশের বাহানা। সবই ফর্মেট করা আছে, নির্দিষ্ট একটা ছকেই চলবে শ্রমিক হত্যার মহোউৎসব। কোথাও কোন ঝামেলা হবে না, বিনিময়ে শ্রমিক পরিবার পাবে কিছু টাকা যা দিয়ে কয়েকদিন তারা খেয়ে পড়ে বাঁচতে পারবে।
এক শ্রমিকের দেহের দাম দিয়ে তার পরিবার কিছুদিন তো বেঁচে থাকতে পারবে, তাই বা কম কি?
কবি, সভ্য সমাজের লুকানো অসভ্যতাকে ভর্সনা করেছেন, তিরস্কার করেছেন, ব্যঙ্গ করেছেন যদিও তথাকথিত সভ্য সমাজের তাতে কিছুই যায় আসে না।
কবিতা ও এক ধরনের প্রতিবাদের ভাষা, হয়তো কোন একদিন, এই নীরব প্রতিবাদ সভ্যতার মূখোশ খুলে দিয়ে নুতন সভ্যতার গোড়াপত্তন করবে, এই প্রত্যাশায়।
কবি’র জন্য রইলো অফুরান শুভেচ্ছা।