আলোচনা ২০৫
কবি শরীফ এমদাদ এর একটি কবিতা মাত্র কিছুদিন আগেই আলোচনার পাতায় নিয়ে এসছিলাম, এই কবিতাটিও খুব হৃদয়গ্রাহী এবং ভিন্ন কিছু মাত্রা যোগ করেছে। সাধারনঁত এরকম বিরহের বা শোকের কবিতাগুলো একমাত্রায় হয়ে থাকে, একমুখী হয়ে থাকে কিন্তু এই কবিতাটি বহুমাত্রিকতার গুন অর্জন করেছে, শোকের ছাড়াকে মাকড়সার জালের মতো নানাবিধ বিষয়ের সাথে সম্পর্কিত করেছে।
১। ইহকালের সাথে পরকালের একটা কানেক্টিভিটি তৈরি করে তুলনামূলক প্রেক্ষাপট দেখিয়েছেন
২। অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যতের সাথে কানেক্ট করেছেন
৩। নষ্টালজিয়ায় আক্রান্ত হয়েছেন এবং
৪। উপরের সবগুলো বিষয়ের সাথে শোকের ছায়াকে নিবিড়ভাবে আকড়ে রেখেছেন
বাবাকে একটি চিঠি লিখতে চেয়েছিলেন, মনের কথাগুলো খুলে বলতে চেয়েছিলেন, যে বাবা অনন্ত কালের যাত্রায় পাড়ি জমিয়েছেন, যার সাথে আর কোনদিনও দেখা হবে না। বিশ্বাসের জায়গা থেকে ধারনা করা হচ্ছে তিনি মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ তায়ালার হাফাজতে আছেন এবং রূপক অর্থে আল্লাহর ঠিকানায় চিঠি পৌঁছাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু অজানা এক কারনে সে চিঠি আর লিখা হয়নি, অপ্রত্যাশিতভাবে সে চিঠি এসে পড়েছে পাঠকের কাছে।
বর্তমানে দিনযাপন কেমন যাচ্ছে সেটাই জানাতে চেয়েছেন বাবাকে। ছোটবেলায় বাবা মা এর তত্তবাধায়নে থাকার সময় জীবন যন্ত্রনার, জীবনের রূঢ় বাস্তবতা টের পাওয়া যায় না কিন্তু যখন থেকে নিজের জীবন নিজের দায়িত্বে এসে পরে তখনই মানুষ মুখোমুখী হতে শুরু করে কঠিন বাস্তবতার সাথে, আর সেটা অনেকের কাছেই সুখকর হয়ে ওঠে না। এখানে লেখকের জীবনের একটি কঠিন বাস্তবতাকে পরপারে থাকা বাবাকে জানাতে চেয়েছেন। বাবাকে সব কথা বলে নিজের মনকে হালকা করতে চেয়েছেন, মানুষিক শান্তির অন্বেষণ করেছেন যদিও বাবা এখন আর কোন সাহায্যই করতে পারবেন না কিন্তু এক ধরনের মানষিক শান্তি পাওয়া যেতে পারে। মানুষ অন্যের কাছ থেকে সব সময় সাহায্য প্রাপ্তির আশা না করেও নিজের কষ্টের কথা শেয়ার করতে চায় শুধুমাত্র মানুষিক প্রশান্তির প্রত্যাশায়। এখানেও তাই, বাবকে (মা তো বটেই), এর পরম আশ্রয়ের জায়গা হিসেবে স্মরন করা হয়েছে যদিও তিনি ইহজগতের সব রকম ধরাছোয়ার বাইরে।
নিজের জীবনের ক্লান্তি, জীর্ন শীর্ন দেহের হাড়ভাঙা খাটুনি, সংসারের টানাপোড়ন... এসবই ছিল বাবার সাথে কথোপকথন। নিজের বর্তমান জীবনের টানাপোড়নের সাথে তুলনা করে বাবার অবস্থা কেমন হতে পারে, কল্পনায় এক ধরনের শংকা অনুভব করেছেন তাই প্রশ্ন রেখেছে বাবার কাছে, বাবা তুমি কেমন আছো সেখানে (পরপারে)? সেখানে কি তোমাকে খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা... এসবের জন্য ভাবতে হয়? সেখানে কি খাদ্যভাবে জঠরে জ্বালা অনুভব হয়? সেখানে কি খাদ্যের নিশ্চয়তা আছে ? সেখানে কি হাড়ভাঙ্গা খাটুনির পরও অর্থের টানাটানি লেগে থাকে? ইহকাল এবং পরকালের একটি তুলনামূলক চমৎকার চিত্রায়ন। বর্তমান পৃথীবিতে মানুষের মৌলিক অধিকারগুলো কিভাবে লঙ্ঘিত হচ্ছে, কিভাবে একজন অন্যজনের নূন্যতম চাহিদাগুলো হরন করছে, সেটাই বাবাকে বলতে চেয়েছেন, কেননা বাবা ইহকাল এবং পরকাল উভয়টাকে দেখার অভিজ্ঞতা সম্পন্ন। অসাধারন এক রূপকের মাধ্যেমে, সভ্য সমাজের অসভ্যতাকে কবি আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়েছেন।
ব্যক্তি জীবন ছাড়িয়ে এরপর কবি নজর দিয়েছেন, সামষ্টীক জীবনের প্রতি, সংসার জীবন, সমাজনীতি, রাষ্ট্রনীতি, নৈতিকতা ইত্যাদি। এখানে বাবার সংসার জীবন ভালো ছিল না, “তুমি তো কত সময় রেগে গিয়ে বলতে, মরেও তোমাকে চালাতে হবে এ আজন্ম দুঃখের সংসার”, কিন্তু ওখানে সংসার জীবন কেমন? খুব কি সুখের সংসার জীবন সেখানে? সারাজীবন যে সুখের অন্বেষণ আমা্রা সংসার জীবনে খুঁজে বেড়াই, সেটা কি ওখানে পাওয়া যায়? এখানে যতোটা সামাজিক এবং প্রাতিষ্ঠানিক নিপীড়ন (যেমন-চালচোর, ডালচোর, সুদখোর, জুয়াখোর, ঘুষখোর, নেশাখোর, চেয়ারম্যান মেম্বারদের অত্যাচার, ভাতা বন্ধের হুমকী, চরম হানাহানি) আছে সেটা কি ওখানে একই রকম? বর্তমান সামাজিক, প্রাতিষ্ঠানিক এবং রাষ্ট্রীয় দুঃশাষনের প্রতি তীব্র এক কঠাক্ষ ফুটিয়ে তুলেছেন।
বর্তমান বিশ্ব, সমাজ, সংসার, রাষ্ট্র এবং নানাধরনের অনৈতিকতা ও অত্যাচারের নীপিড়নে মানুষের জীবন কতোটা ভঙ্গুর তা নানা পদ্ধতিতে কবি কটাক্ষ করেছেন, তীব্র এক ঘৃনায়, তীব্র এক যন্ত্রনায়। কখনো, বর্তমান সময়ের সাথে পরকালের জীবন ব্যবস্থার তুলনামূলক রূপকতায় আবার কখনো নষ্টালজিয়ার মাধ্যেম।
কবি, বাবার চলে যাবার সময় এবং কারনের স্মৃতিচারণ করেছেন, বৈশাখের এক ঝড়ে ঘরের টিনের চাল উড়ে গিয়ে বাবার সমাধি হয়, “বৈশাখ তাই দুঃখ হয়ে আসে প্রতিবার আমাদের ঘরে”, কেন বৈশাখ মানুষের জন্য আতঙ্ক? কেন বৈশাখে মানুষের জীবনের কোন নিরাপত্তা নেই? বাবার স্মৃতি চারনে করতে গিয়ে কয়েকটি মৌলিক প্রশ্নের অবতারনা করেছেন।
কবিতার শেষে লিখেছেন-
একদিন সত্যি সত্যিই তোমাকে লিখতে হবে চিঠি
সুখ হারিয়ে আমরা ভীষণ অসুখ নিয়ে আছি।
একটি চিঠির মহড়া, পুরো চিঠি একদিন সত্যি সত্যিই লিখবেন কবি, তখন হয়তো আরো অনেক বেদনা, অনেক কষ্ট, অনেক অনিয়মের কথা জানতে পারবো আমরা।
কবিতার কাঠামোটি আমার বেশ লেগেছে। বাবার কাছে অলিখিত চিঠি লিখার নামে নিজের ভেতরের নানা প্রশ্ন, নানা অসংগতি, নানা অনিয়মের কথ অকপটে বলেছেন। অনেক কথাই আমরা বলতে পারি না, সমাজের রক্তচক্ষুর ভয়ে কিন্তু চিঠি লিখতে পারি নির্ভয়ে। কবি সেই কৌশলটাই অবলম্বন করেছেন। সাধারনত, বাবা হারানোতে বুকের ভেতর যে কান্নার হাহাকার থাকে, যে কষ্টগুলো মানুষ প্রতিনিয়ত গিলে ফেলে, যে হাহাকারে মানুষ বোবা হয়ে যায়, কবিতাটিতে ঠিক সেরকম কোন অনুভূতি নেই তবে ভিন্নতা আছে। ভিন্নতার কারনে আমার ভালো লেগেছে।
কবির জন্য রইলো শুভেচ্ছা।