আলোচনা ২০৩
ইহকাল থেকে প্রস্থান, পরকালে যাত্রা, অনন্ত কালের অভিযাত্রার এক অনুভূতি মাত্র। সাধারনত মধ্য বয়সের এ অনুভুতিকে কবি ধারন করেছেন তার কাব্য “এখন যদি চলে যাই”তে। যদিও মানুষের মৃত্যু কিংবা ইহকাল থেকে প্রস্থানের কোন সময় সীমা নির্ধারন করা নেই। তবুও মানুষ একটা সাধারন হিসেব করে থাকে , গড় আয়ু কিংবা পূর্ব পুরষের আয়ুর দীর্ঘতা থেকে, সেটা সব সময় সঠিক নাও হতে পারে। তবুও মানুষ প্রত্যাশা করে তার আয়ুর সময়সীমা নিয়ে এবং সেভাবে জীবনের পরিকল্পনা করে থাকে।
সাধারন নিয়মে, জীবন চক্রের, প্রথম অংশে কোনপ্রকার চিন্তা ভাবনা ছাড়াই কাটে, বাবা মা/অভিবাকদের নির্দেশনাতেই, দ্বিতীয় অংশে চরম উদ্দ্যম, উদ্দীপনা আর সাহসে ভর করে ভবিষ্যতের যাত্রায় এগিয়ে চলে। এ সময়টা সফলতা, ব্যর্থতা, হতাশা, নুতন জীবনের স্বপ্ন বিভোরতা..... এসবের উত্থান পতনের মধ্য দিয়েই নিজেকে নিয়ন্ত্রিত ঘাত প্রতিঘাতের সম্মুখীন করে সামনে এগোনোর তীব্র বাসনায় ভরপুর থাকে। অবশেষে মধ্য বয়সে এসে এক ধরনের টানাপোড়ন শুরু হয়। জীবনের একাউন্টস মেলাতে শুরু করে, ইহকালের এবং পরকালের হিসেব নিকেষ একটু একটু করে তোলপার করে মন, চিন্তার জগতে ঢেউ তোলে পাওয়া না-পাওয়ার সুক্ষ্ম হিসেব, ইহকালকে আকড়ে থাকার বাসনা এবং পরকালের নিঃশব্দ ডাক ভেতরে তোলপার করে দেয়, ভেঙ্গে চুড়ে নিজেকে নিয়ে নুতন ভাবনায় আবর্তিত করে। পেছনে ফিরে তাকানো, বর্তমানের চলমান অবস্থা এবং পরপারের অনিশ্চিত চিন্তা মানুষকে নানাভাবে আলোড়িত করে। অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যত নামক তিন কালের সম্মিলিত অভিঘাত এই মধ্যবয়সের এক চিরন্তন টানাপোড়ন, সেটা দেশ কাল পাত্র ভেদে একই রকম থাকে কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিয়ে।
কবি মোঃ আমির হোসেন, মধ্য বয়সের ঠিক এই অনুভূতিকেই কাব্যরূপ দিয়েছেন, একটা সার্ব্জনীন অনুভূতি হিসেবে। কোন প্রকার জটিলতা ছাড়া, কাব্য ঢং কিংবা রূপকতার ব্যবহার না করে, কবিতার পরতে পরতে ছড়িয়ে দিয়েছেন মধ্য বয়সের টানাপোড়নের অভিব্যক্তিগুলো। কবিতাটি আলোচনায় নির্বাচন করার একটা বিশেষ কারন হলো, জীবন চক্রের একটা বিশেষ সময়ের যা প্রায় সার্ব্জোনীন বিষয় হিসেবে ধারন করেছেন কাব্যে।
এখন যদি চলে যাই, তাহলে কি হবে? জীবনের কিছুইতো গোছানো হয়নি এখনো, ছেলের ভবিষ্যত নিশ্চিত হয়নি, মেয়েটা পড়ালেখার স্তরে এখনো, আমার অনুপস্থিতি এক ধরনের পরনির্ভরতা তৈরী করবে, অনিশ্চয়তা তৈরি করবে, অসহায়ত্ত তৈরি করবে তাদের। নিজের জীবন সঙ্গী যে সারাজীবন ধরে সমস্ত অনাকাঙ্ক্ষিত জঞ্জাল সরিয়ে সস্থিময় এক জীবন উপহার দিয়েছিলো, তার মাথায়ও আকাশ ভেঙে পড়বে, কপর্দকহীন হিসেবে ছেলে মেয়েদের নিয়ে কিভাবে চলবে তার ভবিষ্যত পরিকল্পনা... এসব ভাবনাই সার্বক্ষনিক ঝড় তোলে মধ্য বয়সে।
দূরলোকে সরে গেছে বরাত দুয়ার
থরে থরে সাজানো যে স্বপ্নের মিনার,
সেখানে দাঁড়িয়ে আছে রুদ্ধ প্রাচীর;
কে তবে জ্বেলে দেবে আলোর প্রহর,
জানা নেই হবে কিনা আলোকিত ভোর!
কবি শেষটা করেছেন ভেতর থেকে উঠে আসা এক দীর্ঘ শ্বাস দিয়ে। জীবনের স্বপ্নের মিনার সাজানো ছিল থরে থরে কিন্তু কোন এক প্রাচীরে তা রুদ্ধ হয়ে আছে, কোন আলোর নিশানা পাওয়া যাচ্ছে না, একটা আলোকিত ভোরের অপেক্ষায় প্রতিদিন কাটে।
মধ্যবয়সের এক চিরন্তন ভাবনা। আমি নিজেও মধ্য বয়স অতিক্রম করছি, মনে হচ্ছিল, কবি কি করে জানলেন আমার নিজের কথা!!!
শুভেচ্ছা রইলো কবি।